ব্যস্ত নীলফামারীর সূচিশিল্পীরা

ঈদবাজারে বাহারি কাপড়ের জমিনে নকশা ফোটাতে সূচিশিল্পীরা বেশ ব্যস্ত সময় পার করছে এখন। হাতে অন্তহীন কাজ। হ্যান্ডিক্রাফটস মেয়েদের সুঁইয়ের ফোঁড়ে লুকিয়ে আছে শিল্পীদের সুখ-দুঃখ আর জীবনকাহিনী। অবহেলিত মেয়েরাই সমাজের উপহাসকে উপেক্ষা করে আজ অন্যের প্রেরণায় পরিণত হয়েছেন।

তাঁদের উৎপাদিত পণ্য সরাসরি চলে যায় ঢাকার আলিশান শপিং সেন্টার কিংবা শপিং মলগুলোতে। মূলত ঢাকার ব্যবসায়ীরা ক্যাটালগসহ বিভিন্ন ডিজাইন দেখিয়ে অর্ডার দেন ।
সালোয়ার-কামিজ-ওড়না-শাড়ির ওপর হাতের কাজ। কাজ করা হয় পাঞ্জাবি এবং ফতুয়ায়। শুধু এক রঙের কাপড়ের ওপর সুঁই দিয়ে সুতার রকমারি ডিজাইন। সঙ্গে রয়েছে চুমকি, পাথর, পাইপ, পুঁতি, গাসের নিপুণ কারুকার্য। তৈরি হয় বাহারি সব পোশাক। অজপাড়াগাঁয়ের অবহেলিত মেয়েদের হাতে তৈরি হওয়া ওইসব সামগ্রী যে কাউকে মুগ্ধ করে। ডিজাইন শেষে ২০০ কিংবা ৩০০ টাকার কাপড়টি হয়ে যায় তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা মূল্যের।
ঈদ কে সামনে রেখে উত্তরবঙ্গের নীলফামারীর বিভিন্ন এলাকায় হ্যান্ডিক্রাফটসের সূচিশিল্পীরা এখন মহাব্যস্ত সময় পাড়ি দিচ্ছে। দিন রাত ২৪ ঘণ্টা চলছে কাজ আর কাজ। ঢাকা থেকে যেভাবে বড় বড় ফ্যাশন হাউস থেকে একের পর এক ডিজাইয়ের অর্ডার আসছে তাতে সব মিলিয়ে কারুশিল্প পল্লীগুলো সরগম হয়ে উঠেছে। ঘরের ভেতর বা বাড়ির আঙ্গিনায় অথবা খোলা স্থানে যে যেভাবে পারছে বসে পড়ে শাড়ি বা সালোয়ার কামিজে হাতের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এমন দৃশ্যপট প্রতি বছরের ঈদে দেখা মিললেও এবার এ কাজে জড়িয়ে পড়েছে অনেক স্কুল কলেজের ছাত্রী ও অসহায় শিশু শ্রমিকরাও। সুন্দর নিপুণ হাতে তারা নক্সার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সারা বছরেই তারা এ কাজ করে থাকলেও তবে ঈদে ব্যস্ততা বেড়েছে অনেক।
নীলফামারীর সৈয়দপুরের শুধুমাত্র শাড়িতে কারুকাজ করছে ২২ হাজার শ্রমিক। এদের মধ্যে ১৭ হাজার নারীশ্রমিক। সৈয়দপুর উপজেলা এমব্রয়ডারি কারুশিল্প শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ওয়াকিল আহমেদ বলেন, ঢাকার সব ফ্যাশন হাউস, মার্কেট ও শপিং মলে সৈয়দপুরে বানানো এসব কারুলিল্পে শাড়ির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এখানকার কারখানাগুলো থেকে সপ্তাহে ঢাকায় ৫০ হাজারেরও বেশি শাড়ি যায়। ঢাকা থেকে জর্জেট থানকাপড় এনে তাতে নিখুঁত সব কারুকাজ করা হচ্ছে।
এ ছাড়াও সৈয়দপুর উপজেলার ঢেলাপীর উত্তরা আবাসন প্রকল্পে একটু উঁকি দিলেই চোখে পড়ে থোকায় থোকায় গোল হয়ে বসে কাজ করছেন নারী, পুরুষ ও শিশুরা। প্রায় প্রতিটি ঘরের সামনে বসানো কাঠের তৈরি ফ্রেম। মেয়েরা নিপুণ হাতে সুঁই-সুতা দিয়ে চুমকি, পুঁতি ও জরির কাজ করছেন। তৈরি করছেন নানা নকশার জরির শাড়ি, ওড়না, থ্রি-পিস ও ব্লাউজ। প্রায় ৬ বছর ধরে এখানকার ১ হাজার পরিবার এ কাজ করে জীবনধারণ করছেন। অভাবকে জয় করেছেন তারা। শুধুমাত্র হাতের কাজ করেই সচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেছেন সংসারে। শিক্ষাবঞ্চিত শিশুরা সুযোগ পেয়েছে লেখাপড়ারও। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কর্মযজ্ঞে ব্যস্ত সময় পার করছেন এখানকার ৩ হাজার নারী, পুরুষ ও শিশু। আবাসনের বেবী আক্তার, কাজলী, পারভীন, শাহিদা জানান, তাদের শাড়িসহ চুমকি, পুঁতি ও জরি সরবরাহ করা হয়। কাজ শেষে মজুরি বাবদ তারা শাড়ি প্রতি ৬শ থেকে ৭শ টাকা করে পেয়ে থাকে। ঈদকে সামনে রেখে চাহিদা আর ব্যস্ততায় একটি শাড়িতে হাতের কাজ শেষ করতে কমপক্ষে ৫ দিন সময় লেগে যায়। তাদের কাজ করা শাড়ির চাহিদা যেমন বেড়েছে, তেমনি দিন দিন বাড়ছে এ কর্মে নিয়োজিত নারীদের সংখ্যাও। আর এ কাজ করে অনেক নারীই এখন স্বাবলম্বী।
এদিকে নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলা গ্রামেও কাপড়ে কাঠের তৈরি চারকোনাচি পাটাতনে বিভিন্ন রংয়ে আটকে বাহারি রং-বেরংয়ের পাথর দিয়ে নকশা তৈরির কাজ চলছে। বালাগ্রাম মাইজালি গ্রামের তহিদুল ইসলামের মেয়ে রিমা আক্তার গ্রামে তার মতো সুমনা, তাপসী, লতাসহ অনেককে সাথে নিয়ে এ কাজ করে আসছে। ঈদের কারণে কাজের চাপ বেড়েছে। বাহারি ডিজাইনের শাড়ি, থ্রিপিস, পাঞ্জাবি, ফতুয়াসহ বিশেষ করে মেয়েদের বিভিন্ন নকশার কাজ। যেসব উপকরণ দিয়ে নকশা তৈরি করা হয় সেগুলোর মধ্যে লেদার, জর্জেট, সাদা গোমপতি, গোমপতি, ওয়েব লেইস, হাফপাইস, কাঠি, সাদা পাথর, সাদালতি, চুমকি, বিস্কিট, টায়ার পুঁতি, বল, ফুল ইত্যাদি। এ কাজে নিয়োজিত নারী শ্রমিকরা বলেন, দারিদ্র্য দূরীকরণে কারুশিল্পের মাধ্যমে হাতের কাজ করে নিজের ভাগ্য বদলানো সম্ভব। তারা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে এবং নিজেরা উপার্জন করছে। প্রতি বছরের ঈদে তাদের অর্ডার বেড়ে যায় এবং তারা সময় মতো সরবরাহ করে থাকে। এখন তারা মহাব্যস্ত। এদের এই ব্যস্ততা দেখে বলতে হয় গ্রামীণ অর্থনীতিতে বুটিক শিল্প একটি পরীক্ষিত মাইলফলক হয়ে থাকবে সারা জীবন।
-তহমিন হক ববি, নীলফামারী