স্মরণ- কিংবদন্তি অধ্যাপক আবদুল ওহাব by গাজীউল হক

জীবনানন্দ দাশ ছিলেন তাঁর প্রিয় কবি। কবির রূপসী বাংলাকে ভালোবেসে পত্রিকার নামও দিয়েছেন রূপসী বাংলা। ওই পত্রিকা এখন শহর কুমিল্লার অন্যতম প্রধান ও প্রাচীন দৈনিক। সেই পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও প্রকাশক অধ্যাপক আবদুল ওহাব। ৪ আগস্ট ছিল তাঁর নবম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০০৩ সালের ৪ আগস্ট প্রথম প্রহরে তিনি গত হন।


অধ্যাপক আবদুল ওহাব কেবল পত্রিকার সম্পাদকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যের একজন জনপ্রিয় শিক্ষক, লেখক, সাহিত্যিক, নাট্যকার, সমাজসেবক ও জনদরদি। একজন বহুমাত্রিক গুণী মানুষ হিসেবেও তাঁর পরিচিতি ছিল কুমিল্লা ছাড়িয়ে দেশময়। আমেরিকান বায়োগ্রাফিক্যাল রিসার্স ইনস্টিটিউট ফাইভ হান্ড্রেড লিডারস অব ইনফ্লুয়েন্স ওয়ার্ল্ডওয়াইড নামক গ্রন্থে বিশ্বের ৫০০ জন গুণী ব্যক্তির সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে অধ্যাপক আবদুল ওহাবের জীবনীও সংকলিত করা হয়। একই সঙ্গে সম্পাদক হিসেবে অধ্যাপক আবদুল ওহাবের নাম দ্য ইউরোপা ইয়ার বুকে ছাপা হয়। শিক্ষকতাকে তিনি বেশ উপভোগ করতেন। গল্প বলে বলে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করাতেন। তিনি সদা সরব ছিলেন। প্রাণবন্ত ও হাস্যোজ্জ্বলভাবেই জীবন কাটিয়েছেন। মৃত্যুর কয়েক মিনিট আগেও তিনি হই-হুল্লোড় করেছেন। মানুষকে নিয়ে মেতেছিলেন। তাঁর কথা বলার বাচনভঙ্গি ও শব্দচয়ন ছিল চমৎকার। শুদ্ধভাবে খাঁটি বাংলা ভাষায় কথা বলতেন। আনন্দঘন পরিবেশেই জীবনের ৬৩ বছর পার করেছিলেন। নিজের উপস্থাপনায় চারপাশকে আলোকিত করতেন। এমন মানুষের উপস্থিতি নেই, কিন্তু তাঁর দর্শন ও আদর্শকে লালন করে এগিয়ে চলছেন এ প্রজন্মের গণমাধ্যমকর্মীরা।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ১৯৪১ সালের ১৫ অক্টোবর আবদুল ওহাব কুমিল্লা শহরের পশ্চিম বাগিচাগাঁও এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা আবদুর রশিদ ছিলেন কুমিল্লা পৌরসভার দীর্ঘদিনের কাউন্সিলর। মা রাহেলা খাতুন ছিলেন সুগৃহিণী। পরিবারের নয় সন্তানের মধ্যে তিনি প্রথম। ১৯৫৭ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুল থেকে মাধ্যমিক, ১৯৬০ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক এবং ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নকালে তিনি সেগুনবাগিচা হাইস্কুলে শিক্ষকতার চাকরি নেন। ১৯৬৫ সালের ৫ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সদর উপজেলার কান্দিপাড়ার সন্তান হাসিনা বেগমকে বিয়ে করেন। ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামের নাজিরহাট কলেজে বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেন। ১৯৬৭-৬৮ সালে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমির (বার্ড) প্রতিষ্ঠাতা ড. আখতার হামিদ খানের সঙ্গে কাজ করেন। ওই সময় তিনি বার্ডের মুখপত্র সমযাত্রা প্রকাশনার সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। ১৯৬৮ সালের মাঝামাঝি তিনি কুমিল্লা সরকারি কলেজ প্রতিষ্ঠার মিছিলে অংশ নেন। একই সঙ্গে ওই কলেজের বাংলা বিভাগে যোগ দেন। ১৯৯৮ সালে কুমিল্লা সরকারি কলেজ থেকে তিনি অবসর নেন। ওই কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্বও পালন করেন একাধিকবার।
ছোটবেলা থেকেই সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ ছিল আবদুল ওহাবের। ওই সময় তিনি পাকিস্তানি খবর, সওগাত ও ইত্তেফাক-এ লেখালেখি করতেন। মাত্র ১০ বছর বয়সে তিনি ইত্তেফাক-এর কচি-কাঁচার আসরে লিখতেন। মিঠু চৌধুরী নামে তিনি কবিতা ও গল্প লিখতেন। ১৯৭৮ সালে আবদুল ওহাবের নির্দেশনায় কুমিল্লা টাউন হলে মঞ্চস্থ হয় আমায় একটি মানুষ দাও নাটক। ওই সময় তিনি শ্রেষ্ঠ নাট্যকারের পুরস্কার পান।
১৯৭২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লা থেকে সাপ্তাহিক রূপসী বাংলা পত্রিকা প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটি বৃহত্তর কুমিল্লা, নোয়াখালী ও সিলেট অঞ্চলের জনপ্রিয় পত্রিকা হয়ে ওঠে। ১৯৭৪ সালে এক বছরের জন্য ওই পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ থাকে। ১৯৭৯ সালের ১০ ডিসেম্বর রূপসী বাংলা দৈনিক পত্রিকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। রূপসী বাংলা প্রতিষ্ঠার পর আবদুল ওহাব আট হাজার ৫০০ সম্পাদকীয় লেখেন। খবরের সত্যতা যাচাই করে খবর পরিবেশন করতেন। প্রতিপক্ষের বক্তব্য নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করতেন। তাঁর ওই ধারা এখনো অব্যাহত আছে। তবে সময়ের চাহিদার সঙ্গে লক্ষ রেখে রূপসী বাংলা এখন রঙিন বের হচ্ছে। ১৯৮০ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ সম্রাট প্রকাশিত হয়। ২০০৩ সালে মৃত্যুর সময় বের হয় কাব্যগ্রন্থ বুচি আমার বুচি। এসব কাব্যগ্রন্থে তাঁর ক্ষুরধার লেখনী ও ক্ষীপ্রতার বিষয়টি নান্দনিকভাবে ফুটিয়ে তোলেন তিনি। রাজনীতি কিংবা সামাজিক লোভ-লালসা কোনো কিছুই তাঁর সাংবাদিকতাকে রুদ্ধ করতে পারেনি। নিজে যা বিশ্বাস করতেন, তাই গণমানুষের কাছে পৌঁছে দিতেন। অবসরে ক্রিকেট খেলা দেখতেন। মাছ ধরতেন। পছন্দের লোকদের নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। সাংবাদিকতা ও সাহিত্যে অনন্য অবদানের জন্য জাতীয় নজরুল সমাজ পদক ২০০৩-এ ভূষিত হন। র‌্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কারের জন্যও তাঁর নাম মনোনয়নের জন্য পাঠানো হয়।
আবদুল ওহাব কুমিল্লা প্রেসক্লাবের তিনবারের নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন। সভাপতি থাকাকালেই মৃত্যুকে বরণ করে নেন। খদ্দরের পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে জীবনের সিংহভাগ সময় কাটিয়েছেন। কুমিল্লার গণমাধ্যমকর্মীরা তাঁকে কিংবদন্তি বলে মনে করেন। ১৯৯১ সালে তিনি বাংলাদেশ সংবাদপত্র সম্পাদক পরিষদের জাতীয় নির্বাহী কমিটির সহসভাপতি ছিলেন। ৩১ বছর সাংবাদিকতা এবং ৩৪ বছর শিক্ষকতা করেছেন। তাঁর তিন ছেলে ও তিন মেয়ে রয়েছেন। স্ত্রী হাসিনা ওহাব এখন পত্রিকার সম্পাদক। তিনিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্রী ছিলেন। বড় ছেলে আশিক অমিতাভ পত্রিকার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক। অন্য দুই ছেলের মধ্যে আরিফ অরুণাভ সহসম্পাদক এবং আসিফ তরুণাভ বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর দ্বিতলবিশিষ্ট রূপসী বাংলা ভবন এখন আটতলা হয়েছে। ওই পত্রিকা সম্পাদনা ও ছাপার কাজ সেখান থেকেই চলে।
পত্রিকার বর্তমান সম্পাদক হাসিনা ওহাব তাঁর সহযোদ্ধার কথা স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘শত প্রতিকূলতার মধ্যেও আনন্দ-উল্লাস করে তিনি জীবনকে উপভোগ করেছেন। তাঁর স্মৃতি নিয়েই আমরা এগিয়ে চলছি।’
গাজীউল হক
সাংবাদিক
gajiulhoqsohag@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.