ধর্ম- রোজাদার হাউজে কাওছারের পানি পান করবে by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

সমাজে ধনী-গরিব বিভিন্ন ধরনের মানুষ বসবাস করেন। রমজান মাসে রোজাদার ব্যক্তি সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার পরিহার করার ফলে গরিব-দুঃখীদের অপরিমেয় দুঃখ-কষ্ট উপলব্ধি করতে শেখেন। মাসব্যাপী রোজাদার ধনী লোকেরা হতদরিদ্রদের ক্ষুধা-তৃষ্ণার যন্ত্রণা এবং অনাহারের জ্বালা মর্মে মর্মে অনুভব করে স্বভাবতই


সমাজের অসহায় ও দুস্থদের প্রতি সদয় আচরণ করেন। এভাবে মাহে রমজানে ধনী লোকেরা অসহায় গরিব-দুঃখী, এতিম-মিসকিন ও নিরন্ন মানুষের জন্য সেহির ও ইফতারের ব্যবস্থা করেন এবং তাদের দান-খয়রাত, জাকাত-সদকা প্রদানসহ বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতা ও সহমর্মিতা প্রকাশ করেন। তাই নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘এই মাস (রমজান) সহানুভূতি প্রদর্শনের মাস।’ (মিশকাত)
কোনো রোজাদারকে সেহির ও ইফতার করালে অশেষ সওয়াব অর্জন করা যায়। সারা দিন সিয়াম শেষে একজন রোজাদারের ইফতার করা ও করানোর মধ্যে রয়েছে অশেষ নিয়ামত ও বরকত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, তা তার জন্য গুনাহ মাফ ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির কারণ হবে এবং সে রোজাদারের সমান সওয়াবের অংশীদার হবে। অথচ রোজাদারের সওয়াবের মধ্যে কোনো কমতি করা হবে না। সাহাবায়ে কিরাম আরজ করলেন, হে রাসুলুল্লাহ! আমাদের প্রত্যেকেই এমন সামর্থ্য রাখে না যে, রোজাদারকে ইফতার করাতে পারে। নবী করিম (সা.) বললেন—এই সওয়াব তো আল্লাহ তাআলা একটি খেজুর খাওয়ালে অথবা এক ঢোক পানি পান করালে অথবা এক চুমুক দুধ পান করালেও দান করবেন। যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে পানি পান করাবে আল্লাহ তাআলা তাকে হাউজে কাওছার থেকে এমন পানি পান করাবেন, যার পর জান্নাতে প্রবেশ করা পর্যন্ত আর পিপাসা লাগবে না।’ (বায়হাকী, ইবনে খুজাইমা)
পবিত্র কোরআন ও হাদিস শরিফ থেকে জানা যায় যে, কিয়ামতের ময়দানে বেহেশত থেকে প্রবাহিত দুটো পানির ধারা এনে একটা বিশাল হাউজে জমা করা হবে। এ হাউজটার নাম হলো ‘হাউজে কাওছার’। ওই হাউজের নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা মহান আল্লাহ তাআলা তাঁর সর্বাধিক প্রিয় বন্ধু বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর হাতে দান করবেন। যাঁরা পৃথিবীতে ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম মাহে রমজানের রোজা পালন করবেন রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁদেরকে ওই হাউজ থেকে পানি পান করাবেন। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আমি অবশ্যই আপনাকে {হে মুহাম্মদ (সা.)} কাওছার দান করেছি।’ (সূরা আল-কাওছার, আয়াত-১)
দয়াময় আল্লাহর অপূর্ব করুণাধারা হাউজে কাওছার। বুখারি শরিফের হাদিসে পাওয়া যায় নবী করিম (সা.) সেদিন হাউজে কাওছারের পাশে অবস্থান করবেন। হাশরের ময়দানে প্রচণ্ড উত্তাপে তৃষ্ণার্ত মানুষ শুধু পানি পানি বলে আর্তচিৎকার করবে। তখন নবী করিম (সা.) তাঁর অনুসারীদের পানি পান করাবেন। হাউজে কাওছার সম্পর্কে বুখারি, মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ, তিরমিজি, ইবনে মাজা, আবু দাউদ প্রভৃতি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। হাউজে কাওছারসংক্রান্ত ব্যাপারে ৫০ জনের অধিক সাহাবি হাদিস বর্ণনা করেছেন।
মাহে রমজানে সহমর্মিতার শিক্ষা গ্রহণ করে সমাজে শান্তি ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠা করতে রোজাদারদের আন্তরিকভাবে সচেষ্ট হতে হবে। এ সম্পর্কে হাদিসে কুদসিতে বর্ণিত আছে, ‘আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন বলবেন: হে আদম সন্তান! আমি অসুস্থ ছিলাম, তুমি আমার সেবা করোনি। সে বলবে: হে প্রভু, আপনি তো জগৎসমূহের প্রতিপালক! কীভাবে আপনার সেবা করব? আল্লাহ বলবেন: আমার অমুক বান্দা অসুস্থ ছিল, তুমি তার সেবা করোনি। তুমি কি জানতে না তার সেবা করলে তুমি আমাকে তার কাছে পেতে? হে আদম সন্তান! আমি তোমার কাছে খাবার চেয়েছি, তুমি খাবার দাওনি। সে বলবে: হে প্রভু, আপনি তো জগৎসমূহের প্রতিপালক! কীভাবে আপনাকে খাবার দেব? আল্লাহ বলবেন: আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে খাবার চেয়েছে, তুমি তাকে খাবার দাওনি। তুমি কি জানতে না যে, তাকে খাবার দিলে তুমি তার প্রতিদান আমার কাছে পেতে? হে আদম সন্তান! আমি তোমার কাছে পান করতে চেয়েছি অথচ তুমি আমাকে পান করাওনি। সে বলবে: হে প্রভু, আপনি তো জগৎসমূহের প্রতিপালক! কীভাবে আপনাকে পান করাব? আল্লাহ বলবেন: আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে পান করতে চেয়েছে অথচ তুমি তাকে পান করাওনি। তুমি তাকে পান করালে তার প্রতিদান আমার কাছে পেতে।’ (মুসলিম)
রোজা রেখে আর্তমানবতার প্রতি সাহায্য-সহানুভূতি ও দয়া-মায়া প্রদর্শন করলে আল্লাহ তাআলা অত্যন্ত খুশি হন এবং রোজাদারের ইহকালীন ও পরকালীন জীবনে সফলতা আসে। এ সম্পর্কে নবী করিম (সা.) পুরস্কারের কথা ঘোষণা করেছেন, ‘এক মুসলমান অন্য মুসলমানকে কাপড় দান করলে আল্লাহ তাকে জান্নাতের পোশাক দান করবেন। ক্ষুধার্ত অবস্থায় খাদ্য দান করলে আল্লাহ তাকে জান্নাতের সুস্বাদু ফল দান করবেন। কোনো মুসলমানকে তৃষ্ণার্ত অবস্থায় পানি পান করালে আল্লাহ তাকে জান্নাতের সিলমোহরকৃত পাত্র থেকে পবিত্র পানি পান করাবেন।’ (আবু দাউদ)
অসংখ্য পানপাত্র থাকবে, সেই পানপাত্রে আল্লাহর প্রকৃত মুমিন বান্দারা পানি পান করবে, যে ব্যক্তি ওই পানি পানের সৌভাগ্য লাভ করবে, সে আর পিপাসা অনুভব করবে না। হাউজে কাওছারের পানি কেমন হবে, এটা নিয়ে প্রশ্ন না তুলে একটা বিষয় অনুধাবন করতে হবে, তা হলো আল্লাহ তাআলা অনুগ্রহ করে পরকালে তাঁর বান্দাদের জন্য যে আয়োজন করে রেখেছেন, তা পৃথিবীর মানুষ কল্পনাও করতে পারে না। পবিত্র কোরআন বলছে, এসব নিয়ামত কোনো দিন কোনো চোখ দেখেনি। কোনো দিন কোনো মানুষ কল্পনাও করতে পারেনি। যেমন—পৃথিবীতে মানুষ যে ফলমূল খায়, বেহেশতেও যদি সেই একই ফলমূল দেওয়া হয়, তাহলে পৃথিবী আর বেহেশতের ফলমূলের স্বাদ, গন্ধ, আকার-আকৃতি কি একই রকম হবে? নিশ্চয়ই না। কিন্তু কেমন তার স্বাদ-গন্ধ হবে, তার সঙ্গে তুলনা দেওয়ার মতো কোনো স্বাদ-গন্ধ পৃথিবীতে নেই। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন রোজাদার সবাইকে কিয়ামতের ময়দানে মুসিবতের দিনে তাঁর রহমতের ছায়ায় আশ্রয় দান করে জান্নাতে হাউজে কাওছারের পানি পান করার তাওফিক দিন!
 ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.