পরিবেশ- শব্দদূষণ থেকে আমরা কীভাবে রক্ষা পেতে পারি? by মো. আসাদ উল্লাহ খান
সম্প্রতি পরিবেশ অধিদপ্তর ঢাকা শহরের রাস্তায় শব্দদূষণ প্রতিরোধের লক্ষ্যে মোবাইল কোর্ট বসিয়ে ঢাকা শহরের প্রধান সড়কগুলোর ওপর চলাচলকারী যানবাহনের গাড়ির হর্ন, বিশেষত হাইড্রোলিক হর্নের অত্যাচার বন্ধ করার পদক্ষেপ নিয়েছে। ঢাকা শহরের বিভিন্ন বাণিজ্যিক বিতান ও রেস্টুরেন্টে স্থাপিত বৈদ্যুতিক জেনারেটর থেকে উত্থিত
উচ্চমার্গের শব্দ নিয়ন্ত্রণে পরিবেশ অধিদপ্তর যথেষ্ট উদ্যোগী হয়েছে। বিলম্বিত হলেও এটি একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ।
দেশের সর্বত্র তথা শহরের আবাসন নির্মাণ স্থল, কলকারখানা এবং উৎপাদন ক্ষেত্রে শব্দদূষণের মাত্রা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। শিশু ও রোগীরা এই দূষণের সবচেয়ে বড় শিকার। অধিকাংশ হাসপাতাল, ক্লিনিক কিংবা বাসাবাড়ি রাস্তার পাশেই অবস্থিত। বিকট হাইড্রোলিক হর্ন বাজিয়ে যেভাবে বাস এবং ট্রাক হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকের পাশ দিয়ে ধেয়ে যাচ্ছে তাতে মনে হয়, দূষণ নিয়ন্ত্রণ কিংবা পরিবেশ সংরক্ষণ বিষয়টি একটা ভুয়া বুলি ছাড়া আর কিছু নয়। বাস, অটোরিকশা কিংবা টেম্পোর গগনবিদারী শব্দে রাস্তার পাশে অবস্থিত বাড়ির শিশুরা আর্তচিৎকারে কেঁদে উঠছে। ছাত্রছাত্রীরা তাদের পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারছে না। সব দেশেই হয়তো এই অত্যাচার কমবেশি আছে, কিন্তু বাংলাদেশে এই অত্যাচার যেন অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের এক জরিপের সূত্রে জানা গেছে যে বিগত এপ্রিল-মে মাসে ঢাকা শহরের বিভিন্ন ব্যস্ত কেন্দ্র যথা মিরপুর, ফার্মগেট, বিজয় সরণি, মহাখালী, কুড়িল বিশ্বরোড ইত্যাদি এলাকায় পরিমাপ চালিয়ে শাব্দিক অত্যাচার অনুমোদিত মাত্রার দ্বিগুণের চেয়ে বেশি পাওয়া গেছে। পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ বিধি অনুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, আদালত এবং অফিসের ১০০ মিটার চৌহদ্দির মধ্যে এই মাত্রা দিনে ৫০ ডেসিবেল এবং রাতে ৪০ ডেসিবেলের ঊর্ধ্বে হবে না। বাণিজ্যিক এলাকায় এই মাত্রা দিনে ৭০ ডেসিবেল এবং রাতে ৬০ ডেসিবেল, আবাসিক এলাকায় এই মাত্রা দিনে সর্বোচ্চ ৫৫ ডেসিবেল এবং রাতে ৪৫ ডেসিবেল এবং শিল্পাঞ্চল এলাকায় এই মাত্রা দিনে সর্বোচ্চ ৭৫ ডেসিবেল এবং রাতে সর্বোচ্চ ৭০ ডেসিবেলের মধ্যে সীমিত থাকতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, সড়ক, আবাসিক এলাকা, হাসপাতাল, ক্লিনিক, বাজার—কোনো এলাকায় এই বিধি মানার কোনো প্রয়াস নেই এবং মানতে বাধ্য করার জন্য সরকারি কোনো উদ্যোগও নেই।
সমপ্রতি পরিবেশ অধিদপ্তরের মনিটরিং ও এনফোর্সমেন্ট শাখার তৎপরতায় বাণিজ্যিক মল ও রেস্টুরেন্টে জেনারেটরের শাব্দিক অত্যাচার কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রয়াস লক্ষ করা গেছে। আমেরিকার এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশন এজেন্সির মতে, এ ধরনের উচ্চমাত্রার শব্দদূষণ কয়েক ধরনের মারাত্মক অসুখের কারণ হতে পারে। এ ধরনের উচ্চমাত্রার শব্দ, যাকে আমেরিকায় ‘শব্দ-সন্ত্রাস’ বলা হয়, শ্রবণেন্দ্রিয়ের স্থায়ী ক্ষতি করে মানুষকে বধির করে তুলতে পারে। আরও আতঙ্কজনক ব্যাপার হলো এ ধরনের শব্দ-সন্ত্রাসের শিকার হয়ে যেকোনো ব্যক্তি উচ্চরক্তচাপজনিত রোগ এবং কঠিন স্নায়বিক রোগে আক্রান্ত হতে পারে, যার কোনো চিকিৎসা নেই।
অন্যান্য দূষণের ক্ষেত্রে দূষণমাত্রা পরিমাপ করা যায়, কতটা দূষণীয় বস্তু পরিবেশে মিশে গেলে আমাদের জন্য ক্ষতিকর হয় তা নির্ধারণ করা সম্ভব। শব্দ উৎস থেকে নিঃসৃত প্রতিটা শাব্দিক অত্যাচার ব্যক্তিবিশেষের জন্য কতটা অসহনীয় বা বিপজ্জনক, তা পরিমাপ করা প্রায় অসম্ভব। এমনকি একটা বিস্তৃত জনগোষ্ঠীর জন্য এই পরিমাপ সম্ভব নয়। কারণ, প্রতিটা ব্যক্তির শারীরিক বৈশিষ্ট্য, স্বাস্থ্যগত দিক কিংবা সহনক্ষমতা ভিন্নতর। এমনও হতে পারে, কোনো ব্যক্তির কাছে একটি জেট বিমানের গর্জন, কিংবা উচ্চ স্বরে বাজানো ব্যান্ড মিউজিক হয়তো তৃপ্তিকর, শ্রুতি সুখকর এমনকি আনন্দদায়কও হতে পারে, কিংবা এ ধরনের শব্দ বা মিউজিক তার চিত্তে প্রফুল্লতাও আনতে পারে, কিন্তু অন্য আরেক ব্যক্তির কাছে এটা অত্যন্ত বিরক্তিকর হতে পারে এবং অসুস্থতা ডেকে আনতে পারে।
কিন্তু সাধারণভাবে বলা যায়, উপভোগ্য নয়, এমন ধরনের শব্দ তা জেট বিমানের গর্জন কিংবা পাশের বাড়ির কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ হোক, অবশ্যই দূষণের পর্যায়ে পড়ে। মোদ্দা কথা উচ্চমার্গে প্রচারিত শব্দ তখনই দূষণীয় বলে ধরা হবে, যদি এ ধরনের শব্দ স্বাস্থ্যের প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। দুমদাম শব্দ, ইটভাঙা মেশিনের একটানা উচ্চশব্দ, বহুতলবিশিষ্ট বাড়িঘরের ভিত পাইলিংয়ের বিকট শব্দ, ঘরের মেঝে বা দেয়ালে বসানোর টাইলস কাটার শব্দ আজ শহরে বাস করা মানুষের জীবনে বিরক্তি ও আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শব্দের এই তীব্রতা লগারিদমিক স্কেলে প্রতি ৩ ডেসিবেলে দ্বিগুণ মাত্রায় বেড়ে যায়। অর্থাৎ কোনো কারখানার শ্রমিক যদি প্রতিদিন আট ঘণ্টা সময়ে প্রতিনিয়ত ৭৫ ডেসিবেল কিংবা চার ঘণ্টা সময়ে ৭৮ ডেসিবেল মাত্রার শব্দের পীড়ন দ্বারা প্রভাবিত হয়, তবে তাকে অবশ্যই শ্রবণেন্দ্রি সংরক্ষণের জন্য ‘ইয়ার প্লাগ’ ব্যবহার করতে হবে। মনে রাখা দরকার, এই মাত্রা বাড়তে বাড়তে যদি মাত্র চার মিনিটের জন্য ১১০ ডেসিবেল মাত্রার শব্দপীড়ন কারও শ্রবণেন্দ্রিয়কে আঘাত করে, তবে তাৎক্ষণিক স্থায়ীভাবে ওই ব্যক্তির শ্রবণক্ষমতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
ঢাকা শহরের ব্যস্ত রাস্তায় বাস, টেম্পো এবং সব ধরনের যন্ত্রচালিত যানবাহনের গগনবিদারী গর্জন এবং হাইড্রোলিক হর্নের বজ্রনিনাদ পথচারীদের অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে তোলা শব্দ পথচারীদের স্নায়ুতন্ত্রে প্রতিনিয়ত আঘাত করছে। ঢাকা শহরের রাস্তায় চলাচলকারী ৫০ লাখ শহরবাসী এই কোলাহলপূর্ণ এই শাব্দিক অত্যাচারের শিকার হচ্ছে। বিমানবন্দরের কাছাকাছি যারা বসবাস করে, তাদের অবস্থা তো আরও কাহিল।
শহরের বাসিন্দারা বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, এবং খাদ্যে ভেজাল, এমনকি শিশুখাদ্যে ভেজাল ইত্যাদি সব অত্যাচারই মুখ বুজে সহ্য করছেন। ক্ষতির এতটা আশঙ্কা আছে জানা সত্ত্বেও কোনো প্রতিবাদ বা নিরোধের দাবিতে তাঁরা কখনোই সোচ্চার হননি। কিছুটা অস্বাভাবিক হলেও সত্যি, সভ্যভব্য যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ২ দশমিক ৮ কোটি জনগোষ্ঠী অর্থাৎ শতকরা ১১ ভাগ লোকের শ্রবণশক্তি নষ্ট হয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞরা লক্ষ করেছেন যে এই শাব্দিক অত্যাচারের প্রথম শিকার হচ্ছে বিভিন্ন দেশের তরুণ সমপ্রদায়। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় মূক ও বধির চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের যুগ্ম পরিচালক ড. জেমস স্নোর উদ্ধৃতি এখানে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। ড. জেমস বলেন, ‘মানুষ যেভাবে তার দৃষ্টিশক্তি রক্ষার জন্য সব সময়ই সচেতন, একই ভাবে তাকে শ্রবণেন্দ্রিয় রক্ষার জন্য সচেতন হতে হবে।’
আজ ঢাকা কিংবা দেশের কোনো বড় শহরের রাস্তাঘাট, বাস টার্মিনালে গাড়ির হাইড্রোলিক হর্ন বাজানোর প্রতিযোগিতা ছাড়াও বাজার, ফেরিঘাট এবং রেলস্টেশনে হাতুড়ে ওষুধের ক্যানভাসাররা তাদের ওষুধের মাহাত্ম্য মাইকে প্রচারে যে বিপুল মহড়া চালাচ্ছে কিংবা রাস্তাঘাট বা অলিগলিতে ক্যাসেটের দোকানদার কিংবা উঠতি বয়সের তরুণেরা স্টেরিও কিংবা ব্যান্ড মিউজিক বাজিয়ে পথচারী এবং রাস্তার পাশের বাসিন্দাদের যে কর্ণপ্রদাহ সৃষ্টি করছে, তা দেশের জাগ্রত প্রশাসন (!) কিংবা সচেতন নাগরিকদের বিবেককে নাড়া দিচ্ছে না।
ইতিমধ্যে আমরা শ্রবণেন্দ্রিয় শুধু নয়, দর্শনেন্দ্রিয়ও হারিয়ে ফেলেছি। দেশের রাজনীতিবিদ, রাষ্ট্রযন্ত্র এবং সামাজিক সংগঠনগুলো দেশের এই ক্রমাবনতিশীল অবস্থা সম্পর্কে এখনই সচেতন না হলে সামাজিক অধোগতি ঠেকানো যাবে না।
মো. আসাদ উল্লাহ খান: পরিবেশকর্মী ও লেখক এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক।
aukhandk@gmail.com
দেশের সর্বত্র তথা শহরের আবাসন নির্মাণ স্থল, কলকারখানা এবং উৎপাদন ক্ষেত্রে শব্দদূষণের মাত্রা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। শিশু ও রোগীরা এই দূষণের সবচেয়ে বড় শিকার। অধিকাংশ হাসপাতাল, ক্লিনিক কিংবা বাসাবাড়ি রাস্তার পাশেই অবস্থিত। বিকট হাইড্রোলিক হর্ন বাজিয়ে যেভাবে বাস এবং ট্রাক হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকের পাশ দিয়ে ধেয়ে যাচ্ছে তাতে মনে হয়, দূষণ নিয়ন্ত্রণ কিংবা পরিবেশ সংরক্ষণ বিষয়টি একটা ভুয়া বুলি ছাড়া আর কিছু নয়। বাস, অটোরিকশা কিংবা টেম্পোর গগনবিদারী শব্দে রাস্তার পাশে অবস্থিত বাড়ির শিশুরা আর্তচিৎকারে কেঁদে উঠছে। ছাত্রছাত্রীরা তাদের পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারছে না। সব দেশেই হয়তো এই অত্যাচার কমবেশি আছে, কিন্তু বাংলাদেশে এই অত্যাচার যেন অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের এক জরিপের সূত্রে জানা গেছে যে বিগত এপ্রিল-মে মাসে ঢাকা শহরের বিভিন্ন ব্যস্ত কেন্দ্র যথা মিরপুর, ফার্মগেট, বিজয় সরণি, মহাখালী, কুড়িল বিশ্বরোড ইত্যাদি এলাকায় পরিমাপ চালিয়ে শাব্দিক অত্যাচার অনুমোদিত মাত্রার দ্বিগুণের চেয়ে বেশি পাওয়া গেছে। পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ বিধি অনুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, আদালত এবং অফিসের ১০০ মিটার চৌহদ্দির মধ্যে এই মাত্রা দিনে ৫০ ডেসিবেল এবং রাতে ৪০ ডেসিবেলের ঊর্ধ্বে হবে না। বাণিজ্যিক এলাকায় এই মাত্রা দিনে ৭০ ডেসিবেল এবং রাতে ৬০ ডেসিবেল, আবাসিক এলাকায় এই মাত্রা দিনে সর্বোচ্চ ৫৫ ডেসিবেল এবং রাতে ৪৫ ডেসিবেল এবং শিল্পাঞ্চল এলাকায় এই মাত্রা দিনে সর্বোচ্চ ৭৫ ডেসিবেল এবং রাতে সর্বোচ্চ ৭০ ডেসিবেলের মধ্যে সীমিত থাকতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, সড়ক, আবাসিক এলাকা, হাসপাতাল, ক্লিনিক, বাজার—কোনো এলাকায় এই বিধি মানার কোনো প্রয়াস নেই এবং মানতে বাধ্য করার জন্য সরকারি কোনো উদ্যোগও নেই।
সমপ্রতি পরিবেশ অধিদপ্তরের মনিটরিং ও এনফোর্সমেন্ট শাখার তৎপরতায় বাণিজ্যিক মল ও রেস্টুরেন্টে জেনারেটরের শাব্দিক অত্যাচার কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রয়াস লক্ষ করা গেছে। আমেরিকার এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশন এজেন্সির মতে, এ ধরনের উচ্চমাত্রার শব্দদূষণ কয়েক ধরনের মারাত্মক অসুখের কারণ হতে পারে। এ ধরনের উচ্চমাত্রার শব্দ, যাকে আমেরিকায় ‘শব্দ-সন্ত্রাস’ বলা হয়, শ্রবণেন্দ্রিয়ের স্থায়ী ক্ষতি করে মানুষকে বধির করে তুলতে পারে। আরও আতঙ্কজনক ব্যাপার হলো এ ধরনের শব্দ-সন্ত্রাসের শিকার হয়ে যেকোনো ব্যক্তি উচ্চরক্তচাপজনিত রোগ এবং কঠিন স্নায়বিক রোগে আক্রান্ত হতে পারে, যার কোনো চিকিৎসা নেই।
অন্যান্য দূষণের ক্ষেত্রে দূষণমাত্রা পরিমাপ করা যায়, কতটা দূষণীয় বস্তু পরিবেশে মিশে গেলে আমাদের জন্য ক্ষতিকর হয় তা নির্ধারণ করা সম্ভব। শব্দ উৎস থেকে নিঃসৃত প্রতিটা শাব্দিক অত্যাচার ব্যক্তিবিশেষের জন্য কতটা অসহনীয় বা বিপজ্জনক, তা পরিমাপ করা প্রায় অসম্ভব। এমনকি একটা বিস্তৃত জনগোষ্ঠীর জন্য এই পরিমাপ সম্ভব নয়। কারণ, প্রতিটা ব্যক্তির শারীরিক বৈশিষ্ট্য, স্বাস্থ্যগত দিক কিংবা সহনক্ষমতা ভিন্নতর। এমনও হতে পারে, কোনো ব্যক্তির কাছে একটি জেট বিমানের গর্জন, কিংবা উচ্চ স্বরে বাজানো ব্যান্ড মিউজিক হয়তো তৃপ্তিকর, শ্রুতি সুখকর এমনকি আনন্দদায়কও হতে পারে, কিংবা এ ধরনের শব্দ বা মিউজিক তার চিত্তে প্রফুল্লতাও আনতে পারে, কিন্তু অন্য আরেক ব্যক্তির কাছে এটা অত্যন্ত বিরক্তিকর হতে পারে এবং অসুস্থতা ডেকে আনতে পারে।
কিন্তু সাধারণভাবে বলা যায়, উপভোগ্য নয়, এমন ধরনের শব্দ তা জেট বিমানের গর্জন কিংবা পাশের বাড়ির কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ হোক, অবশ্যই দূষণের পর্যায়ে পড়ে। মোদ্দা কথা উচ্চমার্গে প্রচারিত শব্দ তখনই দূষণীয় বলে ধরা হবে, যদি এ ধরনের শব্দ স্বাস্থ্যের প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। দুমদাম শব্দ, ইটভাঙা মেশিনের একটানা উচ্চশব্দ, বহুতলবিশিষ্ট বাড়িঘরের ভিত পাইলিংয়ের বিকট শব্দ, ঘরের মেঝে বা দেয়ালে বসানোর টাইলস কাটার শব্দ আজ শহরে বাস করা মানুষের জীবনে বিরক্তি ও আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শব্দের এই তীব্রতা লগারিদমিক স্কেলে প্রতি ৩ ডেসিবেলে দ্বিগুণ মাত্রায় বেড়ে যায়। অর্থাৎ কোনো কারখানার শ্রমিক যদি প্রতিদিন আট ঘণ্টা সময়ে প্রতিনিয়ত ৭৫ ডেসিবেল কিংবা চার ঘণ্টা সময়ে ৭৮ ডেসিবেল মাত্রার শব্দের পীড়ন দ্বারা প্রভাবিত হয়, তবে তাকে অবশ্যই শ্রবণেন্দ্রি সংরক্ষণের জন্য ‘ইয়ার প্লাগ’ ব্যবহার করতে হবে। মনে রাখা দরকার, এই মাত্রা বাড়তে বাড়তে যদি মাত্র চার মিনিটের জন্য ১১০ ডেসিবেল মাত্রার শব্দপীড়ন কারও শ্রবণেন্দ্রিয়কে আঘাত করে, তবে তাৎক্ষণিক স্থায়ীভাবে ওই ব্যক্তির শ্রবণক্ষমতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
ঢাকা শহরের ব্যস্ত রাস্তায় বাস, টেম্পো এবং সব ধরনের যন্ত্রচালিত যানবাহনের গগনবিদারী গর্জন এবং হাইড্রোলিক হর্নের বজ্রনিনাদ পথচারীদের অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে তোলা শব্দ পথচারীদের স্নায়ুতন্ত্রে প্রতিনিয়ত আঘাত করছে। ঢাকা শহরের রাস্তায় চলাচলকারী ৫০ লাখ শহরবাসী এই কোলাহলপূর্ণ এই শাব্দিক অত্যাচারের শিকার হচ্ছে। বিমানবন্দরের কাছাকাছি যারা বসবাস করে, তাদের অবস্থা তো আরও কাহিল।
শহরের বাসিন্দারা বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, এবং খাদ্যে ভেজাল, এমনকি শিশুখাদ্যে ভেজাল ইত্যাদি সব অত্যাচারই মুখ বুজে সহ্য করছেন। ক্ষতির এতটা আশঙ্কা আছে জানা সত্ত্বেও কোনো প্রতিবাদ বা নিরোধের দাবিতে তাঁরা কখনোই সোচ্চার হননি। কিছুটা অস্বাভাবিক হলেও সত্যি, সভ্যভব্য যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ২ দশমিক ৮ কোটি জনগোষ্ঠী অর্থাৎ শতকরা ১১ ভাগ লোকের শ্রবণশক্তি নষ্ট হয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞরা লক্ষ করেছেন যে এই শাব্দিক অত্যাচারের প্রথম শিকার হচ্ছে বিভিন্ন দেশের তরুণ সমপ্রদায়। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় মূক ও বধির চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের যুগ্ম পরিচালক ড. জেমস স্নোর উদ্ধৃতি এখানে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। ড. জেমস বলেন, ‘মানুষ যেভাবে তার দৃষ্টিশক্তি রক্ষার জন্য সব সময়ই সচেতন, একই ভাবে তাকে শ্রবণেন্দ্রিয় রক্ষার জন্য সচেতন হতে হবে।’
আজ ঢাকা কিংবা দেশের কোনো বড় শহরের রাস্তাঘাট, বাস টার্মিনালে গাড়ির হাইড্রোলিক হর্ন বাজানোর প্রতিযোগিতা ছাড়াও বাজার, ফেরিঘাট এবং রেলস্টেশনে হাতুড়ে ওষুধের ক্যানভাসাররা তাদের ওষুধের মাহাত্ম্য মাইকে প্রচারে যে বিপুল মহড়া চালাচ্ছে কিংবা রাস্তাঘাট বা অলিগলিতে ক্যাসেটের দোকানদার কিংবা উঠতি বয়সের তরুণেরা স্টেরিও কিংবা ব্যান্ড মিউজিক বাজিয়ে পথচারী এবং রাস্তার পাশের বাসিন্দাদের যে কর্ণপ্রদাহ সৃষ্টি করছে, তা দেশের জাগ্রত প্রশাসন (!) কিংবা সচেতন নাগরিকদের বিবেককে নাড়া দিচ্ছে না।
ইতিমধ্যে আমরা শ্রবণেন্দ্রিয় শুধু নয়, দর্শনেন্দ্রিয়ও হারিয়ে ফেলেছি। দেশের রাজনীতিবিদ, রাষ্ট্রযন্ত্র এবং সামাজিক সংগঠনগুলো দেশের এই ক্রমাবনতিশীল অবস্থা সম্পর্কে এখনই সচেতন না হলে সামাজিক অধোগতি ঠেকানো যাবে না।
মো. আসাদ উল্লাহ খান: পরিবেশকর্মী ও লেখক এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক।
aukhandk@gmail.com
No comments