আল বিদা মাহে রমজান by অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম রফিক

পবিত্র মাহে রমজানের সমাপনী দশক শুরু হলো। এ মাস দানÑসাদকার মাস। যাকাত ফিতরা দানের মাস। গরিবদের প্রতি অকাতরে সাহায্য সহযোগিতার মাস। কিন্তু কোন কোন ধনী ও কৃপণ ব্যক্তি তার ধনসম্পদের যাকাত যথাযথভাবে হিসেব করে দেয় না। এ আর্থিক ইবাদত সম্পাদনের ক্ষেত্রেও নানা ছলছুতা ও ফাঁকিঝুঁকির আশ্রয় নিয়ে থাকে।


যা কখনও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির জন্য সৌভাগ্য ও কল্যাণ নিয়ে আসে না। টাকা-পয়সা, সোনাদানা, সহায়-সম্পদের প্রতি মানুষের আকর্ষণ চিরন্তন ও অপ্রতিরোধ্য। বস্তুত ধনের মায়া প্রাণের মায়ার চাইতেও বেশি। এ কথা হয়ত অনেকেই স্বীকার করবে না। কেননা সবাই জানে যে, প্রাণের চাইতে মানুষ অন্যকিছুকেই বড় মনে করে না। এ কথা স্বীকার করলেও বলতে হয় যে, প্রত্যক্ষ বিপ্লব ও রক্তারক্তি সংঘটিত হবার মূল কারণ এই ধন। ধনের লোভে মানুষ অন্ধ হয়ে যায়। প্রাণের মায়া থাকে না। তাই চুরি-ডাকাতি করতে গিয়ে প্রাণ হারায়। যুদ্ধ করতে গিয়ে নৃশংসভাবে জীবন-লীলা সংবরণ করে। ছেলে বাবাকে হত্যা করে, স্ত্রী স্বামীকে চুপি চুপি বিষ পান কারায়। প্রতিবেশী এই ধরনের লোভেই একে অন্যের গলায় ছুরি দেয়।
প্রেম-ভালবাসা, মোহ-মায়া সব এ ধনের কাছেই পরাজিত। ধনের লোভ পরিত্যাগ করতে না পারলে হৃদয়ে সহানুভূতি আসে না। ভালবাসার প্রবৃত্তি জন্মে না, আত্মা প্রসারিত হয় না, বুদ্ধি পরিপক্ক হয় না। তীক্ষè দূরদৃষ্টি আসে না, পরের তরে জীবন উৎসর্গ করার কামনা জাগে না। তাই সমাজ হয়ে পড়ে দুর্বল, পরিবেশ হয় ঘোলাটে, আবহাওয়া হয় অস্বাস্থ্যকর।
সূরা তাকাসুরে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন:‘আধিক্যের আকাঙ্খাই তোমাদেরকে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে যে পর্যন্ত না তোমরা কবরে নিপতিত হও।’ বয়ঃবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মধ্যে একটা প্রবৃত্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং মৃত্যু পর্যন্ত তা চলে। এই প্রবৃত্তি হলো লোভ এবং লালসা। ধনের লোভ, সম্পত্তির লোভ, বিলাসিতার লোভ, পূণ্যের লোভ, ভোগের লোভ ইত্যাদি। হযরত রাসূলে কারীম ও (স) এক বাণীতে এ কথা বলেছেন: ‘দুটি দ্রব্য বৃদ্ধের হৃদয়কে যৌবনত্ব দান করে। একটি পার্থিব দ্রব্যের প্রতি ভালবাসা, অপরটি সুদূরপ্রসারী আশা।’ (সহীহ আল্ বুখারী)।
লোভের বসে মানুষ অন্ধ হয়ে যায়। বিবেক বিবেচনা হারিয়ে ফেলে। আপনজনকে দূরে ঠেলে। অন্যায়,অত্যাচার ও অবিচার সমাজে বিভীষিকার ঢেউ তোলে। দয়ামায়া থাকে না, হিতাহিত জ্ঞান থাকে না, পরের তরে চক্ষু থেকে অশ্রু ঝরে না। সমাজকে করে পঙ্গু, জাতিকে করে ধ্বংস এবং নিজের আত্মাকে করে কলুষিত।
হযরত নবী করীম (স.)-এ ভয়াবহ চরিত্রের কথা জানতেন বলেই বলেছেন: ধন ও সম্মানের প্রতি লোভ মানুষের ধর্মীয় ব্যাপারে যে রূপ বিবাদের সৃষ্টি করে, দুটি ক্ষুধার্ত ব্যাঘ্রকে একটি ছাগলের পালের মধ্যে ছেড়ে দিলেও তদ্রƒপ বিবাদের সৃষ্টি করে না।” (তিরমিজী)।
ধন-দৌলতের লোভ তিনি কিভাবে পরিহার করেছেন তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত তুলে ধরে সমগ্র মানবজাতিকে শিক্ষা দিলেন তাঁর নিজ জীবনের পরিচয় দিয়ে, এই বলে: আল্লাহ তায়ালা আমার জন্য মক্কার প্রস্তরগুলোকে স্বর্ণে পরিণত করতে চেয়েছিলেন কিন্তু আমি বললাম, না প্রভু বরং আমি একদিন তৃপ্তি সহকারে আহার করব, অন্যদিন ক্ষুধার্ত থাকব, যখন ক্ষুধার্ত থাকব তখন তোমার নিকট প্রার্থনা করব এবং তোমার আরাধনা করব আর যখন আহার করব তখন তোমার প্রশংসা ও শোকর করব।’- (তিরমিজী)।
আল্লাহ যেন এ পবিত্র মৌসুমে আমাদের ধনীদের মনে নবীজীর (স) এসব হাদিসের বাস্তব প্রতিফলন ঘটান। ধনের লোভ হতে পরিত্রাণ পাবার যে সব পন্থা তিনি নির্দেশ করলেন তার মধ্য হতে সামান্য কয়েকটি বাণী এখানে উল্লেখ করা হলো। মহানবী (স) সুন্দর বলেছেন: ধন-সম্পত্তির প্রাচুর্যই মানুষকে ধনী করে না বরং হৃদয়ের প্রফুল্লতাই মানুষকে প্রকৃত ধনী করে তোলে।’ (তিরমিজী)।

No comments

Powered by Blogger.