ঈদ অণুগল্প- চোর
রাসেলকে থানাহাজত থেকে কোর্টে নিয়ে এসেছে। অবশ্য এটা ওর জন্য নতুন কিছু না। পুলিশ ওকে কাঠগড়ায় তুলে হাতকড়াটা একটা লোহার ডান্ডার সঙ্গে লাগিয়ে দিয়েছে। আদালত মধ্যাহ্ন বিরতিতে আছে, এজলাস শুরু হতে আরও কিছুক্ষণ দেরি। আমি রাসেলের দিকে এগিয়ে গেলাম, ‘কিরে, এই নিয়ে কয়বার কোর্টে আসলি?’
রাসেল মরিয়া হয়ে বলে, ‘দোস্ত, এইবারের মতো আমার জামিনটা করাইয়া দে। আমি চুরি-ডাকাতি সব ছাইড়া দিমু।’
আমি মৃদুস্বরে গর্জে উঠি, ‘চুপ, একদম চুপ। এটা কোর্ট। এখানে তুই একটা ছিঁচকে চোর আর আমি অ্যাডভোকেট। তুই আমাকে দোস্ত বলবি না, খবরদার।’
রাসেল হাসে, ‘ঠিক আছে, দোস্ত কমু না। তয় এইবারের মতো আমারে জামিন করাইয়া দে। আমি আর চুরি করমু না, তোরে কথা দিতাছি।’
আমি আবারও দাঁত চেপে গজগজ করি, ‘ইশ্, চোরের আবার মুখের কথা। ব্যাটা তুই একটা চোর। তোর কথা বিশ্বাস করে আমি তোর জামিন শুনানি করব, এটা তুই কীভাবে ভাবলি!’
আমার কথা শুনে রাসেল রাগ করে না। আমি জানি, যা-ই বলি না কেন ও কখনো রাগ করবে না। ও আমার ছোটবেলার বন্ধু। আমরা হাত ধরাধরি করে স্কুলে যেতাম প্রতিদিন। নিয়তির ফেরে পড়ে ও আজকে চোর হয়ে গেছে।
রাসেল আমার হাত ধরে মিনতি করে, ‘দোস্ত, এই শেষবারের মতো আমার জামিনটা করাইয়া দে। বিশ্বাস কর, এইবার সত্য সত্যই চুরি করা ছাইড়া দিমু।’
আমি ওর কথা পাত্তা দিই না, ‘চুরি ছাড়বি ক্যান! অবশ্যই চুরি করবি। সমাজে চোর-ডাকাতেরও দরকার আছে। শুধু ভালো মানুষ থাকলে তো সমাজের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে!’
রাসেল আমার অপমান গায়ে মাখে না। আরও বেশি কাতর হয়ে বলে, ‘তোরে কেমনে বিশ্বাস করাই, সত্য কইতাছি, এইবার বাইর হইতে পারলে আমি সারা জীবনের মতো চুরি করা ছাইড়া দিমু। ইমানে কইতাছি দোস্ত।’
আমি এবার সত্যি সত্যিই বিরক্ত হই, ‘তুই যে এখন কসম খাচ্ছিস, তোর চুরি ছাড়ানোর জন্য সবাই কত চেষ্টা করেছে। জীবনে তো কারও কথা শুনিস নাই!’
রাসেল একটু মন খারাপ করে। ‘তোরে কিন্তু আমি সত্যই কইতাছি, এইবার খালাস পাইলে চুরি করা জন্মের মতো ছাইড়া দিমু। ছাড়তে পারমু না দেইখা আগে কোনো দিন কাউরে কথা দেই নাই। এইবার কথা দিতাছি।’
অবাক হই। চুরি ছাড়ার কথা এই ব্যাটার মুখ থেকে কখনো বের করা যায়নি। এখন কী এমন হলো যে ব্যাটা চুরি ছেড়ে দিয়ে একদম সাধু হয়ে যাওয়ার চিন্তা করছে।
খানিকটা কৌতূহলী হলাম, ‘তুই চুরি ছেড়ে দিবি বলছিস কেন? চুরি করা ছাড়লে তো তুই বাঁচতেই পারবি না!’
রাসেল একটু আনমনা হয়ে যায়, ‘দোস্ত, সেই চেহারাটা ভুলতে পারতাছি না। এহনও ঘোরের মধ্যে আছি। এর জন্যই তো আমারে হাতেনাতে ধরতে পারছে। নইলে তুই-ই ক, আমারে কারও বাড়িতে চুরি করা অবস্থায় মালসহ ধরতে পারছে কুনোদিন! খালি চুরির মাল বেচতে গেলেই ধরা খাই!’
আমার বিস্ময় বাড়তে থাকে, ব্যাটা তো সত্যি কথাই বলছে। ওকে কখনো বমাল ধরা যায়নি। ঘটনা জানার জন্য আগ্রহী হই, ‘কী এমন ঘটল যে তুই হাতেনাতে ধরা পড়ে গেলি?’
রাসেল কেমন যেন আনমনা হয়ে যায়, ‘বাড়িটাতে ঢুইকা দামি দামি সব জিনিসপত্র খুঁজতাছি। হঠাৎ একটা রুমের মইধ্যে ঢুইকা থান্ডার মাইরা গেলাম! দেখি, বিছানার মইধ্যে একটা মাইয়া ঘুমাইয়া আছে। জানালা দিয়া চান্দের আলো আইসা মাইয়াটার মুখে পড়ছে। আমি তো হঠাৎ কেমুন কারেন্টের শক খাইলাম! এমুন চেহারা আমি জিন্দেগিতে কুনোদিন দেখি নাই দোস্ত। জোছনা এই মাইয়ার কাছে কিছুই না। এই মাইয়ার রূপ দিয়াই পুরা পৃথিবী ভাসাইয়া দেওন যাইব, জোছনার দরকার নাই। তারপর কেমনে যে ধরা খাইছি কিছুই জানি না। দেখি, আমি একটা গাছের সঙ্গে বান্ধা, পাবলিক আমারে সমানে পিটাইতেছে। হাতেনাতে ধরছে তো, এইবার বেশি মাইর দিছে দোস্ত!’
আমি ওর কথা পাত্তা দিই না, ‘এখন কি এই মেয়ের জন্য তুই চুরি ছেড়ে দিয়ে ভালো হয়ে যেতে চাচ্ছিস?’
রাসেল হাসে, ‘হ দোস্ত, সেই মাইয়া আমারে দেইখা ভয় পাইছে। এই কথা মনে হইতেই তো নিজের ওপর ঘেন্না ধইরা গেল।’
—‘তুই কি এখন এই মেয়েকে পাওয়ার চিন্তা করছিস নাকি! তুই ব্যাটা একটা জাতচোর। তোর মুখে এসব ভালো কথা মানায় না।’
রাসেল অতি আনন্দিত হয়ে জবাব দেয়, ‘দোস্ত, বড় বড় সুফি-আউলিয়ারাও তো ওপরওয়ালারে পায় না। কিন্তু তার পরও তো তারা দিওয়ানা হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুইরা বেড়ায়। আমিও নাহয় এই রকম মুসাফির হইয়া ঘুইরা বেড়ামু। চোর হইছি বইলা কি এই অধিকারটাও আমার থাকব না?’
আমি আর কোনো কথা খুঁজে পাই না। রাসেলের সামনে থেকে সরে আসি। একটা চোরের কথা শুনে মন খারাপ করার কোনো মানে হয় না।
জুয়েল দেব
চট্টগ্রাম
আমি মৃদুস্বরে গর্জে উঠি, ‘চুপ, একদম চুপ। এটা কোর্ট। এখানে তুই একটা ছিঁচকে চোর আর আমি অ্যাডভোকেট। তুই আমাকে দোস্ত বলবি না, খবরদার।’
রাসেল হাসে, ‘ঠিক আছে, দোস্ত কমু না। তয় এইবারের মতো আমারে জামিন করাইয়া দে। আমি আর চুরি করমু না, তোরে কথা দিতাছি।’
আমি আবারও দাঁত চেপে গজগজ করি, ‘ইশ্, চোরের আবার মুখের কথা। ব্যাটা তুই একটা চোর। তোর কথা বিশ্বাস করে আমি তোর জামিন শুনানি করব, এটা তুই কীভাবে ভাবলি!’
আমার কথা শুনে রাসেল রাগ করে না। আমি জানি, যা-ই বলি না কেন ও কখনো রাগ করবে না। ও আমার ছোটবেলার বন্ধু। আমরা হাত ধরাধরি করে স্কুলে যেতাম প্রতিদিন। নিয়তির ফেরে পড়ে ও আজকে চোর হয়ে গেছে।
রাসেল আমার হাত ধরে মিনতি করে, ‘দোস্ত, এই শেষবারের মতো আমার জামিনটা করাইয়া দে। বিশ্বাস কর, এইবার সত্য সত্যই চুরি করা ছাইড়া দিমু।’
আমি ওর কথা পাত্তা দিই না, ‘চুরি ছাড়বি ক্যান! অবশ্যই চুরি করবি। সমাজে চোর-ডাকাতেরও দরকার আছে। শুধু ভালো মানুষ থাকলে তো সমাজের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে!’
রাসেল আমার অপমান গায়ে মাখে না। আরও বেশি কাতর হয়ে বলে, ‘তোরে কেমনে বিশ্বাস করাই, সত্য কইতাছি, এইবার বাইর হইতে পারলে আমি সারা জীবনের মতো চুরি করা ছাইড়া দিমু। ইমানে কইতাছি দোস্ত।’
আমি এবার সত্যি সত্যিই বিরক্ত হই, ‘তুই যে এখন কসম খাচ্ছিস, তোর চুরি ছাড়ানোর জন্য সবাই কত চেষ্টা করেছে। জীবনে তো কারও কথা শুনিস নাই!’
রাসেল একটু মন খারাপ করে। ‘তোরে কিন্তু আমি সত্যই কইতাছি, এইবার খালাস পাইলে চুরি করা জন্মের মতো ছাইড়া দিমু। ছাড়তে পারমু না দেইখা আগে কোনো দিন কাউরে কথা দেই নাই। এইবার কথা দিতাছি।’
অবাক হই। চুরি ছাড়ার কথা এই ব্যাটার মুখ থেকে কখনো বের করা যায়নি। এখন কী এমন হলো যে ব্যাটা চুরি ছেড়ে দিয়ে একদম সাধু হয়ে যাওয়ার চিন্তা করছে।
খানিকটা কৌতূহলী হলাম, ‘তুই চুরি ছেড়ে দিবি বলছিস কেন? চুরি করা ছাড়লে তো তুই বাঁচতেই পারবি না!’
রাসেল একটু আনমনা হয়ে যায়, ‘দোস্ত, সেই চেহারাটা ভুলতে পারতাছি না। এহনও ঘোরের মধ্যে আছি। এর জন্যই তো আমারে হাতেনাতে ধরতে পারছে। নইলে তুই-ই ক, আমারে কারও বাড়িতে চুরি করা অবস্থায় মালসহ ধরতে পারছে কুনোদিন! খালি চুরির মাল বেচতে গেলেই ধরা খাই!’
আমার বিস্ময় বাড়তে থাকে, ব্যাটা তো সত্যি কথাই বলছে। ওকে কখনো বমাল ধরা যায়নি। ঘটনা জানার জন্য আগ্রহী হই, ‘কী এমন ঘটল যে তুই হাতেনাতে ধরা পড়ে গেলি?’
রাসেল কেমন যেন আনমনা হয়ে যায়, ‘বাড়িটাতে ঢুইকা দামি দামি সব জিনিসপত্র খুঁজতাছি। হঠাৎ একটা রুমের মইধ্যে ঢুইকা থান্ডার মাইরা গেলাম! দেখি, বিছানার মইধ্যে একটা মাইয়া ঘুমাইয়া আছে। জানালা দিয়া চান্দের আলো আইসা মাইয়াটার মুখে পড়ছে। আমি তো হঠাৎ কেমুন কারেন্টের শক খাইলাম! এমুন চেহারা আমি জিন্দেগিতে কুনোদিন দেখি নাই দোস্ত। জোছনা এই মাইয়ার কাছে কিছুই না। এই মাইয়ার রূপ দিয়াই পুরা পৃথিবী ভাসাইয়া দেওন যাইব, জোছনার দরকার নাই। তারপর কেমনে যে ধরা খাইছি কিছুই জানি না। দেখি, আমি একটা গাছের সঙ্গে বান্ধা, পাবলিক আমারে সমানে পিটাইতেছে। হাতেনাতে ধরছে তো, এইবার বেশি মাইর দিছে দোস্ত!’
আমি ওর কথা পাত্তা দিই না, ‘এখন কি এই মেয়ের জন্য তুই চুরি ছেড়ে দিয়ে ভালো হয়ে যেতে চাচ্ছিস?’
রাসেল হাসে, ‘হ দোস্ত, সেই মাইয়া আমারে দেইখা ভয় পাইছে। এই কথা মনে হইতেই তো নিজের ওপর ঘেন্না ধইরা গেল।’
—‘তুই কি এখন এই মেয়েকে পাওয়ার চিন্তা করছিস নাকি! তুই ব্যাটা একটা জাতচোর। তোর মুখে এসব ভালো কথা মানায় না।’
রাসেল অতি আনন্দিত হয়ে জবাব দেয়, ‘দোস্ত, বড় বড় সুফি-আউলিয়ারাও তো ওপরওয়ালারে পায় না। কিন্তু তার পরও তো তারা দিওয়ানা হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুইরা বেড়ায়। আমিও নাহয় এই রকম মুসাফির হইয়া ঘুইরা বেড়ামু। চোর হইছি বইলা কি এই অধিকারটাও আমার থাকব না?’
আমি আর কোনো কথা খুঁজে পাই না। রাসেলের সামনে থেকে সরে আসি। একটা চোরের কথা শুনে মন খারাপ করার কোনো মানে হয় না।
জুয়েল দেব
চট্টগ্রাম
No comments