ঈদ অণুগল্প: ২য় সেরা- লিপস্টিক

এন্তাজ মিয়ার মনটা খুব ফুরফুরে আজ।নিমতলী বাজারে এন্তাজ মিয়ার একটা মাংসের দোকান আছে। দোকানের ওপর টিনের গায়ে বড় হরফে লেখা—‘এন্তাজ মিয়ার খাসির মাংসের দোকান। ভেজাল প্রমাণে ১০০১ টাকা পুরস্কার।’ নিমতলী বাজার থেকে চার কিলোমিটার দূরে বসুয়াহাট। এটা মূলত গরু-ছাগলের হাট।


সপ্তাহের সাত দিনই কেনাবেচা হয়। দূরদূরান্ত থেকে সাধারণ গৃহস্থ ব্যাপারীরা গরু, ছাগল, মহিষ নিয়ে আসে।
এন্তাজ মিয়া প্রতিদিন ফজরের আজানের ঘণ্টা খানেক আগে ঘুটঘুটে অন্ধকারে তাঁর সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। বসুয়াহাটের একটি বিশেষ জায়গায় এন্তাজ মিয়ার মতো আরও কয়েকজন এসে জমা হয়। হাটে আনার পর যেসব গরু-ছাগল মারা যায়, সেগুলো অতিগোপনীয়তার সঙ্গে কেনাবেচা হয়। এন্তাজ মিয়া ভোরের আলো ফোটার আগেই মরা খাসি তাঁর সাইকেলের পেছনে চাপিয়ে দোকানে চলে আসে। এক ঘণ্টার মধ্যেই কাটাকাটি করে বিক্রির জন্য প্রস্তুত করে ফেলে।
এন্তাজ মিয়া হিসাব করে দেখেছে, একটা খাসি বিক্রি করে ২০০ থেকে ৩০০ টাকার বেশি লাভ হয় না। মরা খাসি বিক্রির লাভ অনেক বেশি। গত রাতে ৫০০ টাকা দিয়ে যে খাসি কিনেছে, সেটা চোখ বন্ধ করে এক হাজার ৫০০ টাকা লাভ দেবে।
নিমতলীতে বাজার করতে এসেছেন ডা. ওবায়েদ করিম। শহরে তাঁর প্রাইভেট চেম্বার। ছোট্ট একটা ডায়াগনস্টিক সেন্টারও আছে তাঁর। যদিও তাঁর ডাক্তার পরিচয়টিতে সামান্য ঝামেলা আছে। ছিলেন গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তার। পরে....
সে যাই হোক। বাজার করার জন্য মাঝেমধেই তিনি এখানে চলে আসেন। বাসা থেকে মাত্র ঘণ্টা খানেকের পথ। তাঁর ধারণা, গ্রামের বাজারগুলোয় ভালো জিনিস পাওয়া যায়। বাড়িতে শ্বশুরবাড়ির লোকজন এসেছে। স্ত্রী খুব ভালোভাবে বলে দিয়েছে, পাঁচ কেজি খাসির মাংস নিয়ে আসতে। এন্তাজ মিয়ার দোকানের দিকে এগিয়ে যান ওবায়েদ। দরদাম করে কিনে ফেললেন। ভালো মাংস কেনার তৃপ্তি তাঁর চোখেমুখে। দামটাও বেশ কম পড়ল। পকেট থেকে টাকা বের করার সময় ৫০০ টাকার একটা নোটের দিকে চোখ আটকে গেল তাঁর। টাকার গায়ে গাঢ় লাল রঙের লিপস্টিকমাখা। কোন ফাজিল যে এসব করে রাখে!

২.
দুপুরের আগেই বিক্রি শেষ হয় এন্তাজ মিয়ার। টাকাগুলো নেড়েচেড়ে পকেটে রাখে। তখনই তার বাবার কথা মনে পড়ল। বাবা সব সময় বলতেন, ‘ব্যাটা, কখনো মানুষকে ঠকাবি না। মানুষ ঠকানো হারাম। ওই টাকায় কখনো বরকত হয় না।’ বাবার চিন্তা অনেকটা জোর করেই মাথা থেকে নামাল এন্তাজ মিয়া।
ঘুরেফিরে এন্তাজ দেখে, তার ছোট মেয়েটার শরীর আরও খারাপ করেছে। দুদিন থেকে তীব্র জ্বর। কিছু খেতে পারছে না। এন্তাজ সিদ্ধান্ত নেয়, এক্ষুনি শহরে গিয়ে চিকিৎসক দেখাতে হবে।
শহরে গিয়ে এন্তাজ হাজির হয় ওবায়েদ করিমের চেম্বারে। সকালে তাঁর কাছেই মরা খাসির মাংস বিক্রি করেছে এন্তাজ। এন্তাজ চিনতে পারে তাঁকে। যদিও ওবায়েদ তাকে চিনতে পারেন না।
গ্রামের রোগী দেখেই ওবায়েদের চোখ চকচক করে ওঠে। এ রকম একটা রোগী পেলে সারা দিন আর অন্য রোগীর দরকার নেই। এন্তাজ মিয়ার মেয়েকে ভালো করে দেখলেন তিনি। সামান্য ভাইরাস জ্বর। কিন্তু ওবায়েদ গম্ভীর মুখে বললেন, টেস্ট করা লাগবে। অসুখটা বেশ সিরিয়াস। তারপর তিনটি টেস্ট দিলেন আর একগাদা ওষুধ। এন্তাজ বিদায় নেওয়ার পর হিসাব করতে বসলেন তিনি। রোগী দেখার ফি, মেডিকেল টেস্টের কমিশন, ওষুধের কমিশন—শুধু টাকা আর টাকা। এন্তাজের দেওয়া ৫০০ টাকার নোটটা পকেট থেকে বের করলেন। হঠাৎ প্রচণ্ড অবাক দৃষ্টিতে তাকালেন। লিপস্টিকমাখা লাল ঠোঁটের চিহ্ন। এই নোটটা তো সকালেই মাংসের দোকানদারকে দিয়েছিলেন। এটা আবার তাঁর কাছেই ফিরে এসেছে। খুবই আশ্চর্যজনক!
ওবায়েদ অবাক চোখে ৫০০ টাকার নোটটার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
 উম্মে হাবিবা
বেগম রোকেয়া রোড, রাজশাহী।

No comments

Powered by Blogger.