ঈদে বিলম্বে চলবে ট্রেন by শেখ সাবিহা আলম

ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া সুবর্ণ এক্সপ্রেস ৪ আগস্ট চট্টগ্রামে পৌঁছায় নির্ধারিত সময়ের পাঁচ ঘণ্টা ১০ মিনিট পর। এর এক দিন পর কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে সিলেটগামী কালনী এক্সপ্রেসকে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে এক ঘণ্টার বেশি সময়। ঢাকা-লালমনিরহাট-রংপুর-দিনাজপুর পথে চারটি আন্তনগর ট্রেনের তিনটিই নির্ধারিত সময় মেনে চলছে না।


রেলওয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, ঈদের ছুটিতে যারা বাড়ি যাবে, তাদের এই দেরিটুকু সয়ে নিতে হবে। আরও বিলম্বেরও ইঙ্গিত দিয়েছেন তাঁরা। বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) মো. শাহজাহান বলেন, ঈদের সময় ট্রেনের দরজা-জানালা-ছাদ কানায় কানায় পূর্ণ থাকে। এ সময় ট্রেন যদি স্বাভাবিক গতিতে চলে, তাহলে প্রাণহানি ঘটার আশঙ্কা থাকে। এ সময় তাঁরা সময়ানুবর্তিতার চেয়ে নিরাপত্তাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।
কিন্তু রেলের নিয়ন্ত্রণকক্ষের তথ্য হচ্ছে, ট্রেনের পূর্বাঞ্চলে ৩০ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সময়ানুবর্তিতার হার ছিল ৭০ থেকে ৯২ শতাংশ। আর পশ্চিমাঞ্চলে সময়ানুবর্তিতার হার ছিল ৮২ থেকে ৯০ শতাংশ। কর্মকর্তাদের দাবি, বিশেষ করে ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া আন্তনগর ট্রেনগুলো সময় মেনে চলার ক্ষেত্রে উন্নতি করেছে। ৩ থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ট্রেনের সময়ানুবর্তিতার হার ছিল যথাক্রমে ৮৫, ৮৮ ও ৯২ শতাংশ। লোকাল ট্রেনগুলোরও সময়ানুবর্তিতার হার ছিল গড়ে ৮৫ শতাংশের ওপর। পিছিয়ে আছে শুধু মেইল ট্রেনগুলো। এগুলোর সময়ানুবর্তিতার হার গড়ে ৫২ থেকে ৫৩ শতাংশ।
তবে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাওয়ার জন্য অপেক্ষমাণ যাত্রীরা রেলের এসব পরিসংখ্যানের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। ৫ আগস্ট জামালপুরের সরিষাবাড়ীর বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব আবদুস সালাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢাকা থেকে যমুনার ছেড়ে যাওয়ার কথা বিকেল চারটা ২০ মিনিটে। এখন বাজে সাড়ে চারটার বেশি। ট্রেন প্ল্যাটফর্মেই আসেনি। কখন ছাড়বে, কখন পৌঁছাইব—আল্লাহ জানে। কিসের উন্নতি, ডিউ টাইমে গেলেই না উন্নতি।’
একই দিনে উপবনের যাত্রী (ঢাকা-নোয়াখালী) ফাহমিদা লোপা বলেন, উপবন প্রায় সব সময় আধঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা দেরি করে। কালনী এক্সপ্রেস কেন প্ল্যাটফর্মে ঘণ্টার ওপর দাঁড়িয়ে আছে জানতে চাইলে এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ট্রেনটির শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষটি নষ্ট হয়ে গেছে। বাংলাদেশ রেলওয়ের অবস্থা খুবই নাজুক। একটি কম্পার্টমেন্ট নষ্ট হয়ে গেলে তার পরিবর্তে আরেকটি দেওয়া যায় না।
চট্টগ্রাম, লালমনিরহাট, ঈশ্বরদীতেও মোটামুটি একই রকম তথ্য পাওয়া গেছে।
চট্টগ্রাম ও সিলেট পথের ট্রেন যাত্রীদের দুর্ভোগ কমছে না: সিলেটের পথে আন্তনগর পাহাড়িকা ও উদয়ন সকাল ও রাতে চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে যাত্রা করে। আবার সিলেট থেকে সকাল ও রাতে চট্টগ্রামের উদ্দেশে যাত্রী নিয়ে আসে। গত এক সপ্তাহের মধ্যে দুই দিন কেবল এই দুটি ট্রেন নির্ধারিত সূচিতে চট্টগ্রাম স্টেশন ত্যাগ করেছে। বাকি পাঁচ দিনই এক থেকে দুই ঘণ্টা দেরিতে ট্রেনগুলো ছেড়ে যায়।
রেল সূত্র জানায়, যাত্রীদের দুর্ভোগ এড়াতে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রাম ও সিলেটের পথে দুই জোড়া আন্তনগর ট্রেন চালাতে তিনটি র‌্যাক (ইঞ্জিন ও বগিসহ ট্রেন) প্রস্তুত রেখে আসছিল। দুটি র‌্যাক দিয়ে সার্বক্ষণিক যাত্রী পরিবহন করা হতো। কোনো কারণে একটি ট্রেন গন্তব্যে পৌঁছাতে দেরি করলে বসিয়ে রাখা র‌্যাক দিয়ে যাত্রী পরিবহন করা হতো। গত বছর নরসিংদীর পৌর চেয়ারম্যান সন্ত্রাসীর হাতে খুন হলে ক্ষুব্ধ জনতা এগার সিন্দুর নামের একটি ট্রেন পুড়িয়ে দেয়। পরে পাহাড়িকা বা উদয়নের জন্য বসিয়ে রাখা র‌্যাকটি এগার সিন্দুর নামে চলাচল করছে। এ কারণে পাহাড়িকা ও উদয়নের যাত্রীদের দুর্ভোগ কমছে না।
ঢাকা-লালমনিরহাট-রংপুর-দিনাজপুরগামী চারটি আন্তনগর ট্রেনের তিনটিতেই অস্বাভাবিক বিলম্ব: রংপুর অভিমুখে রংপুর এক্সপ্রেস ছাড়া রাজধানী ঢাকা থেকে লালমনিরহাট অভিমুখে লালমনি এক্সপ্রেস, দিনাজপুর অভিমুখে দ্রুতযান এক্সপ্রেস ও একতা এক্সপ্রেস কোনোটিই নির্ধারিত সময়ে যাতায়াত করছে না। এগুলো কখন ছাড়বে, কখন গন্তব্যে পৌঁছাবে তার কোনো নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না।
লালমনিরহাট রেল বিভাগীয় ট্রেন কন্ট্রোল অফিস সূত্রে জানা যায়, ১ আগস্ট লালমনি এক্সপ্রেস লালমনিরহাট রেলস্টেশন থেকে ঢাকার উদ্দেশে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে তিন ঘণ্টা ১০ মিনিট দেরিতে ছাড়ে। আবার দুই ঘণ্টা ৪০ মিনিট দেরিতে ঢাকা থেকে লালমনিরহাটের উদ্দেশে যাত্রা করে রাত ১২টা ৫০ মিনিটে। ঢাকা-দিনাজপুরের মধ্যে যাতায়াতকারী আন্তনগর দ্রুতযান এক্সপ্রেস দেড় থেকে দুই ঘণ্টা দেরিতে গন্তব্যে পৌঁছে। ঢাকা-দিনাজপুর একতা এক্সপ্রেস ৬ আগস্ট ঢাকা থেকে ঠিক সময়ে ছাড়লেও ৫০ মিনিট দেরিতে রাত আটটা ১০ মিনিটে দিনাজপুর পৌঁছায়।
এ ব্যাপারে লালমনিরহাট রেল বিভাগীয় চিফ কন্ট্রোলার শহিদুল ইসলাম ও পাওয়ার কন্ট্রোলার মো. মনিরুজ্জামান বলেন, আন্তনগর এক্সপ্রেস ট্রেনগুলোর র‌্যাক (গাড়ির কোচ/বগি) সংকট ও পর্যাপ্ত ইঞ্জিন না থাকায় দেরিতে ছাড়ছে। ঈদ সামনে রেখে যাত্রীসাধারণের ভিড় বৃদ্ধি পেয়েছে এবং প্রতিটি স্টেশনে দুই মিনিটের পরিবর্তে তিন মিনিট বিরতি দেওয়ায় যাত্রার সময় বেড়ে যাচ্ছে।
সন্তোষজনক চিত্র পাকশী ও রাজশাহীতে: পাকশী বিভাগীয় পরিবহন কার্যালয় থেকে জানা গেছে, এই বিভাগের ২৬টি ট্রেনের মধ্যে মাত্র দুটি দেরিতে চলাচল করছে। খুলনা-ঢাকার পথে চলাচলকারী চিত্রা এক্সপ্রেস ও খুলনা-সৈয়দপুর পথে চলাচলকারী সীমান্ত এক্সপ্রেস এক থেকে দুই ঘণ্টা দেরিতে চলাচল করছে। গত ছয় দিনে এই বিভাগের ১৪৮টি ট্রেনের মধ্যে ১২টি দেরিতে চলাচল করেছে।
রাজশাহী থেকে খুলনাগামী সাগরদাঁড়ি এক্সপ্রেস, রাজবাড়ীর উদ্দেশে মধুমতী এক্সপ্রেস, ঢাকার উদ্দেশে সিল্কসিটি এক্সপ্রেস, খুলনার উদ্দেশে কপোতাক্ষ এক্সপ্রেস, সৈয়দপুরের উদ্দেশে বরেন্দ্র এক্সপ্রেস, তিতুমীর এক্সপ্রেস চিলাহাটির উদ্দেশে সময়মতো ছেড়ে গেছে। লোকাল ট্রেন মহানন্দা এক্সপ্রেস ও উত্তরা এক্সপ্রেসও সময়মতো ছেড়ে গেছে।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন চট্টগ্রাম ও রাজশাহী অফিসের দুজন নিজস্ব প্রতিবেদক এবং লালমনিরহাট ও ঈশ্বরদী প্রতিনিধি]

No comments

Powered by Blogger.