সাক্ষাৎকার- হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইমদাদুল হক মিলন

কালের কণ্ঠের ঈদ আনন্দ সংখ্যা ২০১০ এর জন্য কালের কণ্ঠের পক্ষ থেকে হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন ইমদাদুল হক মিলন।

ইমদাদুল হক মিলন : হুমায়ূন আহমেদ, আপনি কেমন আছেন?

হুমায়ূন আহমেদ : বেঁচে আছি।

ইমদাদুল হক মিলন : বেশির ভাগ মানুষকে যদি এ প্রশ্নটা করা হয়, তাঁরা বলেন, ভালো আছি। অথবা 'এই আছি আর কি'। কেউ কেউ কোনো কোনো সমস্যার কথা বলেন। আর আপনি শুধু বলেন, বেঁচে আছি। এ রকম বলার কারণ কী?

হুমায়ূন আহমেদ : বাংলাদেশে আমি অনেক মৃত মানুষকে জীবিত ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়াতে দেখি। এঁদের আত্মা মরে গেছে। তাঁরা তা জানেন না। তাঁদের যদি প্রশ্ন করা হয় কেমন আছেন, তাঁরা হাসি মুখে বলেন, ভালো আছি।

ইমদাদুল হক মিলন : আপনি এত বড় লেখক, বড় লেখকদের বাড়িভর্তি বই থাকবে, এমনই আমরা আশা করি। আপনার ফ্ল্যাটে তেমন বই দেখছি না কেন? আপনার এই ফ্ল্যাটের শেলফে বইয়ের সংখ্যা কত?

হুমায়ূন আহমেদ : এই মুহূর্তে আমার ফ্ল্যাটে বই আছে বারো শ তেত্রিশ। এটা আমার লেখালেখির বারান্দা। যেসব বই লেখালেখিতে প্রয়োজন সেই বই-ই শুধু এখানে আছে। আমার নিজের লেখা বই একটিও নেই। তবে ঢাকার বাইরে নুহাশ পল্লীর লাইব্রেরিতে অনেক বই আছে। দশ হাজারের বেশি বই আছে আমার গ্রামের শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ স্কুলে। একটা কথা, লেখক হতে হলেই বিশাল লাইব্রেরি থাকতে হবে, তা না। প্রকাণ্ড লাইব্রেরির মালিকরা কেউই লেখক না।

ইমদাদুল হক মিলন : কয়েক বছর ধরে আপনি ছবি আঁকছেন। অনেক ছবিই এর মধ্যে এঁকেছেন। ছবি আঁকার ব্যাপারটি আপনার মধ্যে কিভাবে এল?

হুমায়ূন আহমেদ : আমার সব ভাই-বোনই শখের পেইন্টার। এটা বোধহয় 'জিনে'র কোনো ব্যাপার। তবে আমার বাবা-মা কাউকেই কখনো ছবি আঁকতে দেখিনি।

ইমদাদুল হক মিলন : ছেলেবেলায় বা বড় হয়ে ওঠার পর লেখালেখি শুরু করলেন। কিন্তু ছবি আঁকতে শুরু করলেন অনেকটা বয়সে...।

হুমায়ূন আহমেদ : ঊাবহ ধহ ড়ষফ ফড়ম পধহ ষবধৎহ ভব িহব িঃৎরপশং.

ইমদাদুল হক মিলন : যাঁরা ছবি আঁকেন, তাঁদের প্রধান উদ্দেশ্য ছবির প্রদর্শনী করা। কখনো কখনো পত্রপত্রিকায় নিজের আঁকা ছবি ছাপাবার ব্যবস্থা করা। অর্থাৎ প্রচারের একটা লক্ষ্য থাকে। আপনার সে রকম কখনো কিছুই আমাদের চোখে পড়েনি। কেন?

হুমায়ূন আহমেদ : আমি খুবই নিম্নমানের পেইন্টার। আমার আঁকা ছবি বন্ধু-বান্ধবকে দেখানো যায়। এর বাইরে না। নিজের সীমাবদ্ধতা আমি জানি।

ইমদাদুল হক মিলন : ম্যাজিকে আপনার গভীর উৎসাহ। ম্যাজিকের বই পড়া, ম্যাজিক প্র্যাকটিস করা_এ ব্যাপারটি নিয়ে মেতে থাকতে আপনি খুব পছন্দ করেন। ম্যাজিকের প্রতি আপনার এই আকর্ষণ কিভাবে জন্মাল?

হুমায়ূন আহমেদ : ম্যাজিক মুন্সি লেখায় আমার ম্যাজিকের প্রতি আগ্রহের কারণ ব্যাখ্যা করেছি। আর কিছু বলতে ইচ্ছা করছে না। একই কথা বারবার বলা ক্লান্তিকর ব্যাপার।

ইমদাদুল হক মিলন : এ পর্যন্ত শ খানেক গান আপনি লিখেছেন। আপনার লেখা কোনো কোনো গান আকাশচুম্বী জনপ্রিয়। যেমন_'এক যে ছিল সোনার কন্যা', 'ও আমার উড়াল পঙ্খী রে'। আপনি সেভাবে কখনো কবিতা চর্চা করেননি। অর্থাৎ দু-একটি কবিতা লেখেননি। গান লেখার ব্যাপারটিতে কেমন করে জড়ালেন?

হুমায়ূন আহমেদ : বেশির ভাগ গানই প্রয়োজনের তাগিদে লেখা। যেমন ছবির জন্য গান দরকার, অন্য কারো কাছে না গিয়ে নিজেই লিখলাম। গানে আমার ভূমিকার চেয়ে সুরকার এবং গায়ক-গায়িকার ভূমিকা প্রধান। পত্রিকার সাব-এডিটরিয়ালেও সুন্দর সুর বসালে এবং ভালো কাউকে দিয়ে গাওয়ালে সুন্দর গান হবে।

ইমদাদুল হক মিলন : আপনি কয়েকটি দুর্দান্ত বিজ্ঞাপন চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। বিজ্ঞাপন চিত্রের স্ক্রিপ্ট করেছিলেন। এ কাজগুলো এখন আর করছেন না কেন?

হুমায়ূন আহমেদ : বিজ্ঞাপন তো নিজের আগ্রহে কেউ করে না। অন্যের আগ্রহে করা হয়। কেউ আমাকে এখন আর বিজ্ঞাপন বানাতে ডাকে না।

ইমদাদুল হক মিলন : গত বছর ঈদে দেশ টিভির জন্য আপনি একটি অনুষ্ঠানে উপস্থাপনা করেছেন। অনুষ্ঠানটির পরিচালকও ছিলেন আপনি। পরিচালক হুমায়ূন আহমেদ নন, আমরা কথা বলতে চাইছি উপস্থাপক হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে। এ বিষয়ে তিনি কী বলেন?

হুমায়ূন আহমেদ : নুহাশ পল্লীর নিতান্ত ঘরোয়া অনুষ্ঠানে উপস্থাপনটা গৌণ। নিজের ঘরে কথা বলার মতো। তবে জীবনের প্রথম উপস্থাপনাটা কিন্তু জাপানে। বাংলাদেশ থেকে বিশাল একদল নিয়ে গিয়েছি। উপস্থাপক নিয়ে যাইনি, কাজেই বাধ্য হয়ে উপস্থাপনা।

ইমদাদুল হক মিলন : ভবিষ্যতে আপনি কি উপস্থাপনা করবেন? সব কিছুই তো করলেন, এটা বাদ থাকবে কেন?

হুমায়ূন আহমেদ : আমার চেহারা খারাপ, কণ্ঠস্বর খারাপ, ভাষা আঞ্চলিকতা দোষে দুষ্ট। এই সব ত্রুটি নিয়ে লেখক হওয়া যায়, উপস্থাপক হওয়া যায় না।

ইমদাদুল হক মিলন : আপনি কিছু অবিস্মরণীয় ভূতের গল্প লিখেছেন। আমরা মনে করি, সেই সব গল্প বাংলা সাহিত্যের স্থায়ী সম্পদ হিসেবে পরিগণিত হবে। ভূত নিয়ে আপনার নিজের ভাবনাটা কী রকম? আপনি ভূতে বিশ্বাস করেন?

হুমায়ূন আহমেদ : ভূত বিশ্বাস করি না, কিন্তু ভয় নামক অনুভূতিটি তো বিশ্বাস করি। আমার কাজ ভয় নিয়ে, ভূত একটা উপলক্ষ মাত্র।

ইমদাদুল হক মিলন : আপনার লাইব্রেরি ভর্তি বিজ্ঞানের বই। বিজ্ঞান বিষয়ে কিছু বলুন।

হুমায়ূন আহমেদ : বিজ্ঞান আমাকে প্রবলভাবে আলোড়িত করত। মনের ভেতর সব সময় অতৃপ্তির হাহাকার, কবে মানুষ সব জানতে পারবে?

ইমদাদুল হক মিলন : ধর্ম নিয়ে আপনার ব্যাপক পড়াশোনা। নানা রকমের ধর্মীয় বই আপনি পড়ছেন। আপনার ধর্মভাবনা কী রকম?

হুমায়ূন আহমেদ : আমি অত্যন্ত গোঁড়া মুসলিম পরিবার থেকে এসেছি। উৎসাহের শুরুটা সেখানে। আমি প্রচণ্ড আস্তিক, তবে...পরের উত্তর দেব না।

ইমদাদুল হক মিলন : আপনি একজন বৃক্ষপ্রেমী মানুষ। বৃক্ষের প্রতি আপনার আকর্ষণ এবং মমত্ববোধের কথা আমরা জানি। 'বৃক্ষ কথা' নামে আপনি একটি বইও লিখেছেন। বৃক্ষের প্রতি আপনার এই আকর্ষণ কিভাবে জন্মাল?

হুমায়ূন আহমেদ : 'লোকমান হেকিম' গাছের সঙ্গে কথা বলতে পারতেন। আমি কথা বলতে পারি না, তবে গাছের অনুভূতি সামান্য হলেও ধরতে পারি। হয়তোবা এ কারণেই।

ইমদাদুল হক মিলন : আপনি খান খুব কম। কিন্তু আপনি একজন রসনাবিলাসী মানুষ। আপনার বইয়ের কোনো কোনো তাকভর্তি শুধুই রান্নার বই। রান্না বিষয়ে আপনার এত আগ্রহ কেন?

হুমায়ূন আহমেদ : কম খেলেও ভালো খেতে পছন্দ করি। রান্না যেকোনো জাতির সংস্কৃতির একটা বড় অংশ। বিভিন্ন দেশের রান্নার বই পড়ি ওই দেশ সম্পর্কে ভালোমতো জানার জন্য।

ইমদাদুল হক মিলন : আপনি একসময় বন্ধু-বান্ধব নিয়ে বাংলাদেশ প্রায় চষে বেড়িয়েছেন। বেড়াবার নেশাই ছিল আপনার। বিদেশেও অনেক বেড়িয়েছেন। এখনো কি সেভাবে বেড়ান?

হুমায়ূন আহমেদ : গর্তজীবী হয়ে গেছি। নিজেকে সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করার মধ্যেও কিন্তু আনন্দ আছে। জনতার মধ্যে যেমন আছে 'নির্জনতা', আবার নির্জনতার মধ্যেও আছে 'জনতা'।

ইমদাদুল হক মিলন : লেখকরা সাধারণত একা থাকতে পছন্দ করেন। একাকী ঘুরে বেড়ানো বা নিজের জন্য ভাবনার সময় বের করা। কিন্তু আপনি সেভাবে একা কখনো থাকেন না। চারপাশে আড্ডা, বন্ধু-বান্ধব, হৈচৈ পছন্দ করেন। তাহলে আপনার ভাবনার সময়টা কখন?

হুমায়ূন আহমেদ : যেকোনো মানুষ একগাদা বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে গল্প করতে, নিজের একান্ত ভাবনা ভাবতে পারে। আমি তা-ই করি।

ইমদাদুল হক মিলন : একজন মানুষ এত কাজ একা কী করে করে?

হুমায়ূন আহমেদ : আমি তো অনেক দিন থেকেই বেকার। বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছি। বেকারের হাতে থাকে অফুরন্ত সময়।

ইমদাদুল হক মিলন : আগামী দিনের জন্য আপনার কাজের পরিকল্পনা কী?

হুমায়ূন আহমেদ : আমি বাস করি বর্তমানে। ভবিষ্যতে না। কাজেই কোনো পরিকল্পনা নেই।

ইমদাদুল হক মিলন : 'আনন্দ'_এ ব্যাপারটিকে আপনি কিভাবে দেখেন?

হুমায়ূন আহমেদ : ১৯৭১ সালে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে আসার পর বেঁচে থাকার প্রতিটি মুহূর্তই আমার জন্য আনন্দের। শাওনের সঙ্গে যখন ঝগড়া করি তখনো আনন্দ পাই। মনে হয় বেঁচে আছি বলেই তো ঝগড়া করতে পারছি। আমি যে আপনি কেমন আছেন প্রশ্নের উত্তরে 'বেঁচে আছি' বলি, এটাও একটা কারণ।

'জীবন' পরম করুণাময়ের অতি পবিত্র এক উপহার। এই উপহার নিয়ে নিরানন্দে থাকার কোনো উপায় নেই।

===================================
ইতিহাস- পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ডাইনোসরের ফসিল 'স্যু' এর কাহিনী  খাদ্য আলোচনা- 'অপুষ্টির প্রধান কারণ দারিদ্র্য ও অজ্ঞতা by শেখ সাবিহা আলম  গল্পালোচনা- 'ডান রাস্তার বামপন্থী' by কাওসার আহমেদ  খবর- 'মারা যাবে না একটি শিশুও' -বিলগেটসপত্নী, মেলিন্ডা গেটস  আলোচনা- 'সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের অঙ্গীকারঃ  নিবন্ধ- সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড-একটি দেশ একটি কবিতার জন্ম by আলীম আজিজ  আলোচনা- 'আরও একটি সর্বনাশা দেশ চুক্তির বোঝা' by আনু মাহমুদ  গল্পালোচনা- হতাশার বিষচক্র থেকে জাতিকে মুক্ত করতে হবে  আলোচনা- 'বেঁচে থাকার জীবন্ত পোট্র্রেট' by বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গির  খবর- চলন্ত ট্রেনের নিচে মেয়েকে নিয়ে মা'য়ের আত্মহত্যা  গল্প- 'সেদিন অফিসে যায়নি আন্দালিব' by হাবিব আনিসুর রহমান  বিজ্ঞান আলোচনা- মানবযকৃৎ উদ্ভাবনে বিজ্ঞানীরা সফল  খবর- দিলমা রুসেফ । নারী গেরিলা থেকে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট  আলোচনা- 'সকল গৃহ হারালো যার' by তসলিমা নাসরিন  রাজনৈতিক আলোচনা- 'বিষয় কাশ্মীর-ইনসাফ ও স্বাধীনতা by অরুন্ধতী রায়


কালের কণ্ঠ এর সৌজন্যে

এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...