নারীর মন খারাপ বিষণ্ণতা নয়তো?

রহিমা বেগম বয়স ৪৫। নিজেই চেম্বারে আসলেন এবং বললেন এবার শেষ চিকিৎসা, বহু ডাক্তার দেখিয়েছি। তাঁর সমস্যা মাথা জ্বলে, শরীর জ্বালাপোড়া করে, ঘুম হয় না, সব সময় বিরক্ত ভাবে থাকে, কোন কিছুতেই শান্তি লাগে না। রহিমা বেগম এক বিষন্ন নারী।


বাংলাদেশে ৫-৯% মহিলা কোন না কোনভাবে বিষন্নতা নামক রোগে ভুগছেন। এই পরিসংখ্যান পৃথিবীর প্রায় সব দেশে একই রকম। এই বিরাট অংশের রোগী এই ডাক্তার, সেই ডাক্তার, এই পরীক্ষা, ঐ পরীক্ষা করে শেষে কোন রোগ ধরতে না পেরে নিজেরা তো বিষন্নতায় ভোগেই এবং সবাইকে (আত্মীয়স্বজনকে) অসুস্থ করে ফেলে।

নারীদের বিষণœতার কারণ কি?
১। জন্মগতভাবে আমাদের দেশে নারীরা নিষ্পেষিত। এটা তারা ছোটবেলা থেকেই ঘরে এবং পারিপার্শ্বিক জগৎ থেকে দেখতে দেখতে তার মধ্যে হীনম্মন্যতা তৈরি হয়।
২। হরমোন জনিত কারণ।
৩। সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক কারণ।
৪। রিপ্রোডাক্টিভ লাইফের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সময় যেমন বাচ্চা জন্মের পর, মেনোপোজ ইত্যাদি কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে।
৫। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, যে সব মায়ের তিনটি বাচ্চার বয়স ১৪ বছরের নিচে, কেবল ঘরের কাজে নিয়োজিত থাকে এবং স্বামীর সঙ্গে ভাল সম্পর্ক না থাকে তার মধ্যে বিষন্নতার প্রবণতা বেড়ে যেতে পারে।
৬। বাচ্চা ডেলিভারির পর বিষন্নতা হওয়ার নির্দিষ্ট কিছু কারণ আছে:
-এ সময় হঠাৎ করে শরীরে বিভিন্ন হরমোনের পরিবর্তন হতে পারে। যেমন ইস্টোজেন, প্রজেস্টেরন ও থাইরয়েড হরমোন।
-বাচ্চার যতœ নিতে অতিরিক্ত শারীরিক ও মানসিক চাপ।
-সম্পূর্ণ নতুন এক অভিজ্ঞতা।
-স্বামী ও আত্মীয়স্বজনরা বাচ্চার মাকে সঠিক সময়ে যদি সাপোর্ট না দেয় ও সাহায্য-সহযোগিতা না করে; এটাও মায়ের জন্য আলাদা একটা মানসিক চাপ।
৭। সাধারণ কারণের মধ্যে হতে পারে কোন বিয়োগান্তক ঘটনা। যেমন প্রিয়জনের মৃত্যু, স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে যাওয়া, স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে করা, বড় ধরনের কোন মানসিক আঘাত পাওয়া।
৮। দীর্ঘদিন কোন শারীরিক রোগে ভুগলে ডায়াবেটিস, প্রেসার, হাঁপানি, ক্যান্সার, আর্থ্রাইটিস ও স্ট্রোকের মতো দীর্ঘ মেয়াদী রোগ।
৯। এছাড়াও বিষন্নতার কারণ হতে পারে সামাজিক, পারিবারিক, অর্থনৈতিক চাপ ও বিভিন্ন দুঃখজনক ঘটনা।
১০। বায়োলজিক্যাল কারণের মধ্যে শরীরের বিভিন্ন নিউরোট্রান্সমিটারের পরিবর্তন। যেমন সেরোটনিন, নরএপিনেফ্রিন ও ডোপামিন।

কি কি লক্ষণ দেখে বুঝবেন আপনার পাশের
মহিলাটি বিষণ্ণতায় ভুগছেন

১। শারীরিক লক্ষণ : মাথা জ্বালাপোড়া করা, শরীরের অঙ্গে জ্বলে। কখনও কখনও পুরো শরীর জ্বালাপোড়া করে।
২। মাথা দিয়ে, নাক দিয়ে, কান দিয়ে গরম ভাব উঠে, কেউ কেউ বলে ভাত সিদ্ধ করলে যে রকম ভাব উঠে ঠিক সেই রকম কান দিয়ে, নাক দিয়ে বের হয় এবং বার বার তেলপানি দেয়া লাগে মাথা ঠাণ্ডা করার জন্য।
৩। কেউ কেউ মাথার চুল মাঝখানে ফেলে দিয়ে বিভিন্ন গাছের পাতা পিষে মাথায় দিয়ে রাখে মাথা ঠাণ্ডা রাখার জন্য।
৪। বেশিরভাগ রোগীর ঘুমের সমস্যা হয়, কারো কারো একদম ঘুম হয় না আজানের অনেক আগেই ঘুম ভেঙ্গে যায় এবং সকালবেলাটা তুলনামূলক বেশি খারাপ লাগে।
৫। কখনও কোন বয়স্ক মহিলা দুঃখের কথা বলতে গেলেই প্রায় কেঁদে ফেলে তখন কিন্তু বিষন্নতাই প্রথম সন্দেহ হতে পারে।
৬। মুখের কথা শুনে আপনি কিছুটা আন্দাজ করতে পারবেন। যেমন : এসব রোগী খুব কম কথা বলে এবং খুব আস্তে আস্তে কথা বলে। একটা প্রশ্ন করলে অনেক সময় পর উত্তর দেয়, মাঝে মাঝে কোন কথাই বলতে চায় না। কেউ জিজ্ঞাসা না করলে কথা বলতে চায় না। তারপর ধীরে ধীরে এমন একটা অবস্থায় চলে যায় যে, একদম কথা বলে না; যাকে আমরা মিউট বলি।
৭। মন খারাপ থাকা, এটাই আসল লক্ষণ : এই মন খারাপের প্রকাশ বিভিন্ন মানুষের বিভিন্নভাবে হতে পারে। বেশিরভাগ রোগী নিজের মনের দুঃখভাব সরাসরি বলতে চায় না। তারা সাধারণত বেশিরভাগ সময় বিরক্তভাবে থাকে, অন্যের কথা সহ্য করতে পারে না, কথা বললে রেগে যায়, বেশিরভাগ সময় মনমরা হয়ে থাকে, কারো সঙ্গে মিশতে চায় না, কাছে ছোট ছোট বাচ্চারা চেঁচামেচি করলে বিরক্ত হয়ে টেলিভিশন দেখতে চায় না অথচ আগে নিয়মিত টেলিভিশন দেখত এবং সবার সঙ্গে মিশত, এখন কিছুই ভাল লাগে না, ছোটখাট ব্যাপার নিয়েই কেঁদে ফেলে এবং অতীতের দুঃখের ঘটনাগুলো বার বার বলতে চায়। এসবই কিন্তু মন খারাপের লক্ষণ।
৮। বাচ্চা ডেলিভারির পর বিষন্নতা নামক রোগটির ঝুঁকি বেরে যায়। এ সময় বেশিরভাগ মায়ের অভিযোগ থাকে শরীর বেশি দুর্বল লাগে, মন বিরক্ত থাকে, ঘুম হয় না, আত্মীয়স্বজনরা বলে ও যেন ইদানীং বেশি খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে এবং ভয় ও দুশ্চিন্তা লাগে। গ্রামাঞ্চলে এই সমস্যাগুলো সুত্রিকা বলে কবিরাজরা চিকিৎসা করে। অথচ এই নারী কিন্তু বিষন্নতা নামক রোগে ভুগছে।
৯। এই সমস্ত রোগীর আনন্দ-ফুর্তি, সাজগোজ, হাসিঠাট্টা, গল্প করা, ধীরে ধীরে সকল আনন্দদায়ক ও স্বাভাবিক কাজকর্ম লোপ পেতে থাকে।
১০। খাওয়ার প্রতি অনিহা থাকে বলে খেয়ে কি লাভ হবে, বেঁচে থেকে কি লাভ হবে?
১১। কেউ কেউ গালে হাত দিয়ে, মাথা নিচু করে জড়বস্তুর মতো করে বসে থাকে।
১২। এমনও দেখা গেছে বলে যে, ডাক্তার আমার নাড়িভূঁড়ি পচে গেছে। আমি হয়ত বড় ধরনের পাপ করেছি। আল্লাহ আমাকে পাপের শাস্তি দিচ্ছে।
১৩। অনেক বিষন্ন রোগীকে দেখা যায়, কথা বলার মাঝখানে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, এটাও একটা লক্ষণ।
১৪। শরীরের ওজন কমতে থাকে আবার কোন কোন ক্ষেত্রে বাড়তেও পারে।
১৫। কেউ কেউ হাজির হন মাথাব্যথা ও শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে ব্যথা নিয়ে।
কেন চিকিৎসা দরকার : কারণ
১। ১০-১৭% রোগী আত্মহত্যা করতে পারে।
২। ৫০% রোগী কোন না কোনভাবে আত্মহত্যার চেষ্টা করে।
৩। বিষন্নতা দূর করার জন্য অনেক রোগী নেশায় আসক্ত হতে পারে।
৪। এরা কর্মক্ষেত্রে আগ্রহ, উৎসাহ ও উদ্দীপনা হারিয়ে ফেলে।
৫। এদের সেক্সুয়াল জীবনে অশান্তি বিরাজ করে।
৬। এসব রোগী পরিবারের, সমাজের ও জাতির বোঝা হয়ে যেতে পারে যদি সময়মতো সঠিক চিকিৎসা না করা হয়।

চিকিৎসা
১। সামাজিক কুসংস্কার যেমন আলগা দোষ, জিন-ভূতের ব্যাপার, পানিপড়া, তেলপড়া থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
২। ঝুঁকিপূর্ণ মায়েদের চিহ্নিত করে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া।
৩। সাইকিয়াট্রিস্টের পরামর্শক্রমে চিকিৎসা করা ও নিয়মিত ফলোআপে আসা।
ডা. মোঃ দেলোয়ার হোসেন
সহকারী অধ্যাপক
মাথাব্যথা, টেনশন, ব্রেন ও মাদকাসক্তি বিশেষজ্ঞ
ফোন-০১৮১৭০২৮২৭৭

No comments

Powered by Blogger.