স্মরণ- মায়াবী কবিতার কবি by দুলাল মাহমুদ
কিছু কিছু মানুষ আছেন, হই-হট্টগোলের মধ্যে বসবাস করলেও তা স্পর্শ করে না। প্রতিকূল পরিবেশেও নিজের আলাদা একটি জগৎ তৈরি করে নিতে পারেন। কোলাহলের মধ্যে থেকেও জীবনকে উপভোগ করেন ধ্যানীর মগ্নতায়, গভীর ভালোবাসায়। এমনই ব্যতিক্রমী স্বভাবের মানুষ ছিলেন কবি ও সাংবাদিক শান্তিময় বিশ্বাস।
১২ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে তিনি চলে যান অজানার দেশে।
শান্তিময় বিশ্বাসের জন্ম ১৯৪৬ সালে, নেত্রকোনার কলমাকান্দা থানার মনতলা গ্রামে। নেত্রকোনা দত্ত উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালেই কবি হিসেবে তাঁর হাতেখড়ি হয়। নেত্রকোনা কলেজ ও আনন্দ মোহন কলেজে পড়ার সময় কবিতার নন্দনকাননে হরেক রকম ফুল ফুটিয়ে সবার মনোযোগ কাড়েন। খালেকদাদ চৌধুরীর সম্পাদনায় নেত্রকোনা থেকে প্রকাশিত পাক্ষিক উত্তর আকাশ ও সৃজনী সাহিত্য পত্রিকায় রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, জীবন চৌধুরী, শান্তিময় বিশ্বাস, হেলাল হাফিজ প্রমুখ। যে কারণে জেলা শহরে বসবাস করেও কবি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে তাঁকে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। কিন্তু তাঁর পরিচিতির বলয়টা সেই অনুপাতে একদমই বাড়েনি। তিনি বরাবর প্রচারের ঢক্কা-নিনাদ এড়িয়ে চলতেন। কবিতা ও কবিতার বই প্রকাশের ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন মিতচারী ও শুদ্ধচারী। সারা জীবন কাব্যলক্ষ্মীর সাধনা করেও তাঁর গ্রন্থ মাত্র একটি হাঙরের মতো হিংস্র ইলিশের মতো মায়াবী। প্রকাশিত হয় ১৯৮৭ সালের একুশের বইমেলায়। মৌলিক লেখার পাশাপাশি তিনি অনেক ভাষার কবিতা অনুবাদ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত- অপ্রকাশিত লেখাগুলো নিয়ে আরও একাধিক বই হতে পারে।
সংসার চালানোর জন্য তাঁকে বেশ হিমশিম খেতে হয়েছে। সাংবাদিকতার যে অনিশ্চিত জীবন, তাই বেছে নিয়েছিলেন শান্তিময় বিশ্বাস। কখনো আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের দেখা পাননি। কোথাও থিতুও হতে পারেননি। অনেক সময় বেকারও থেকেছেন। সংসারের হাল স্কুলশিক্ষিকা সহধর্মিণীর ওপর ছেড়ে দিয়ে নির্ভাবনায় জীবন যাপন করেছেন। তবে তিনি মোটেই দায়িত্বহীন ও বাউণ্ডুলে ছিলেন না। কাজ করেছেন সংবাদ, আজাদ, বাংলার বাণী, খবর, দিনকাল, কিষাণ প্রভৃতি পত্রিকায়। সোভিয়েত বার্তা সংস্থা এপিএএন ও বার্তা সংস্থা ইউএনবিতেও ছিলেন। মৃত্যুর আগ অবধি কর্মরত ছিলেন বাংলাদেশ বেতারের বার্তা বিভাগে। সংগীতের প্রতি তাঁর ছিল অসম্ভব ভালোবাসা। তাঁর এই ভালোবাসা চারিয়ে দিতে পেরেছেন ছেলে প্রোটন বিশ্বাসের মধ্যে। রবীন্দ্রভারতী ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীতে পড়াশোনা শেষ করে ঢাকায় সংগীত সাধনায় রত আছেন প্রোটন।
দৈনিক বাংলার বাণীতে কর্মরত অবস্থায় শান্তিময় বিশ্বাসকে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়। প্রথম দিন থেকেই সবার মনোযোগ কেড়ে নেওয়ার অদ্ভুত এক স্বপ্রতিভ মন ছিল তাঁর। আন্তরিক ব্যবহারে সবাইকে কাছে টানতে পারতেন। পোশাক-আশাকের মধ্যে ছিল একটা পরিপাটিতা ও যত্নের ছাপ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় মাস্টার্স করলেও অনুবাদেও ছিলেন সিদ্ধহস্ত। হাতের লেখাও ছিল চমৎকার। তবে তাঁর জীবনযাপন ও জীবনদর্শন ছিল মুগ্ধ করার মতো। মহাত্মা গান্ধীর ভাষায় ‘সিম্পল লিভিং অ্যান্ড হাই থিঙ্কিং’ ছিল তাঁর জীবনের মূলমন্ত্র। নিপাট ভদ্রলোক বলতে যা বোঝায়, তিনি ছিলেন একেবারেই তা-ই। মুখে হাসি ছাড়া তাঁকে দেখা যেত না। তাঁর কথায় থাকত মেধার দীপ্তি ও কৌতুকের সংমিশ্রণ।
শান্তিদার বই কেনার প্রতি ছিল প্রচণ্ড নেশা। ধার করে ঘি না খেলেও কোনো বই পছন্দ হলে সেটা না কিনে ফিরতেন না। ‘বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না’—সৈয়দ মুজতবা আলীর এ কথার তিনি ছিলেন সার্থক উদাহরণ। তিনি সত্যি সত্যিই দেউলিয়া হয়েও বই কিনতেন। তাঁর সঞ্চয়ে অর্থ-কড়ি, সহায়-সম্পদ না থাকলেও ছিল অসংখ্য বই আর গানের বিশাল ভান্ডার। প্রায়ই পল্টনের পুরোনো বইয়ের দোকানে ঢুঁ মারতেন। অনেক সময় বই পছন্দ হলো অথচ পকেটে পর্যাপ্ত টাকা নেই। এ কারণে কোনো কোনো সময় একান্ত কাছের মানুষের কাছে ছুটে যেতে একটুও দ্বিধা করতেন না। প্রয়োজনীয় টাকাটা সংগ্রহ করে খুব বেশি দেরিও করতে চাইতেন না। কারণ, মনটা পড়ে থাকত পছন্দ করা বইয়ের পাতায় পাতায়। কাঙ্ক্ষিত বইটি নিজের করে না পাওয়া পর্যন্ত শান্তি পেতেন না। এই একটা ক্ষেত্রেই তাঁকে মনে হতো অস্থির ও চঞ্চল। তবে কারও কাছে তিনি ঋণী থাকতে মোটেও পছন্দ করতেন না। যত অল্প পরিমাণ অর্থই হোক না কেন, নির্ধারিত সময়ে টাকাটা ফেরত দিয়ে তবেই তিনি স্বস্তি পেতেন। তাঁর সঙ্গে দেখা হলে দুষ্টুমি করে বলতাম, এইমাত্র পৃথিবীতে ‘শান্তি’ নেমে এল। শুনে তিনি মিটিমিটি হাসতেন। আক্ষেপ, তাঁর মোহনীয় হাসিটা আমরা আর কখনোই দেখতে পাব না।
দুলাল মাহমুদ
dulalmahmud@yahoo.com
No comments