ত্রয়োদশ সংশোধনীর পূর্ণাঙ্গ রায় বিশেষজ্ঞরা যা বলেন by বিকাশ দত্ত ও আরাফাত মুন্না

সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীকে অবৈধ ও অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করে আপীল বিভাগের ঐতিহাসিক পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর দেশের সিনিয়র আইনজীবীরা তাদের মতামত ব্যক্ত করেছেন। তাঁরা বলেছেন, বিচারিক রায়ের বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়েছে, এখন সম্পূর্ণ দায়িত্ব রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ওপর। এর সমাধান তাদেরই নিতে হবে।


সরকার ও বিরোধী দল এখন আলাপ-আলোচনা করে নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা ঠিক করবেন। যাতে করে কোনভাবেই রাস্তায় বা জনজীবনকে গড়িয়ে না পড়ে। অন্যান্য দলের প্রতিনিধি থাকলে এটাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার হতে পারে। সে ক্ষেত্রে দুই দল থেকে পাঁচ জন পাঁচ জন নির্বাচিত সদস্য নিয়ে এখনও তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা যায়। যদি ভোটার তালিকাসহ সব কিছু ঠিক থাকে তাহলে ওই সরকারের অধীনে দুই সপ্তাহের মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব।
ব্যারিস্টার এম আমির-উল-ইসলাম বলেছেন, তত্ত্বাবধায়কের সাংবিধানিক অবস্থান সম্পর্কে এই রায়ে দিকনির্দেশনা দিয়েছে। এখন প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেতাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এটা হচ্ছে পলিটিক্যাল সিদ্ধান্ত। টিএইচ খান বলেছেন, বিচারপতি খায়রুল হক এ রায় দিতে পারেন না। অন্যদিকে ব্যারিস্টার রফিকুল হক বলেছেন, প্রয়োজনে ফের সংবিধান সংশোধন করা যেতে পারে। সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের রায়ে একাদশ এবং দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে বলে বলা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে নতুনভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ভার সংসদের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এতে আরও বলা হয়, ‘সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে, জাতীয় সংসদের বিবেচনা (উরংপৎবঃরড়হ) অনুসারে যুক্তিসঙ্গত কাল (ৎবধংড়হধনষব ঢ়বৎরড়ফ) পূর্বে সংসদ ভেঙ্গে দেয়া বাঞ্ছনীয় হবে। তবে নির্বাচন-পরবর্তী নতুন মন্ত্রিসভা কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত পূর্ববর্তী মন্ত্রিসভা সংক্ষিপ্ত আকার গ্রহণকরত উক্ত সময়ের জন্য রাষ্ট্রের স্বাভাবিক ও সাধারণ কার্যক্রম পরিচালনা করবেন।
রবিবার সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীকে অবৈধ ও অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করে আপীল বিভাগের রায়ে ৭ বিচারপতির স্বাক্ষরের পর আইনজীবীরা এই কথা বলেছেন। উল্লেখ্য, এই রায় ঘোষণাকারী প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক যে ১৬টি পর্যবেক্ষণ দেন, তাতে সম্মত হয় বর্তমান প্রধান বিচারপতি মোঃ মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (এসকে সিনহা), বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। অন্যদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখার পক্ষে মত দেন বিচারপতি মোঃ আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, অন্যদিকে বিচারপতি মোঃ ইমান আলী বিষয়টি সংসদে পাঠিয়ে দেয়ার পক্ষে মত দেন। এ প্রসঙ্গে দেশের বিশিষ্ট আইনজীবী কে কি বলেন তা নিচে দেয়া হলো।

ব্যারিস্টার এম আমির-উল-ইসলাম
সংবিধান বিশেষজ্ঞ বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার এম আমির-উল-ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার সাংবিধানিক অবস্থান সম্পর্কে এই রায় দিকনির্দেশনা দিয়েছে। সেটাই মেনে নেয়া ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই। এখন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে যে কোন সরকারই একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারে রূপান্তরিত হতে পারে। এবং তখন থেকেই সরকারী দল এবং বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে তাদের উভয়ের যৌথ মতামত অনুযায়ী তারা নির্ধারণ করতে পারবে কোন কোন সংসদ সদস্যর দ্বারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করবেন। রায়ে বিগত দ্বিতীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ৯০ দিনের পরবর্তী শাসনকে অসাংবিধানিক বলা হলেও তা মার্জনা করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, এই দায়িত্ব এখন পলিটিক্যালভাবে নিষ্পত্তির রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর নির্ভর করছে। আমরা সকলের কাছে একটি বিনীত আহ্বান জানাই যে, বিচারিক রায়ের বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়েছে সম্পূর্ণ দায়িত্ব এখন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ওপর। এর সমাধান তাদেরই নিতে হবে। আমাদের সকলের প্রত্যাশা যে, এ দায়িত্ব তাঁরা নিজেরা পালন করবেন এবং তাদের বিতর্ক সংসদে মীমাংসা করবেন। এটা যাতে কোনভাবেই রাস্তায় বা জনজীবনকে গড়িয়ে না পড়ে। রায় ঘোষণাকারী তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক তাঁর রায়ে ১৬টি সারমর্ম দেন। তাতে অন্য তিন বিচারপতি একমত হন। ঐ মতামতে রয়েছে, (১) জনগণ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মালিক, জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস, জনগণই একমাত্র সার্বভৌম; (২) বাংলাদেশের সরকার মানুষের সরকার নহে, আইনের সরকার (এড়াবৎহসবহঃ ড়ভ ষধংি ধহফ হড়ঃ মড়াবৎহসবহঃ ড়ভ সবহ); (৩) সংবিধান বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন, ইহা বাংলাদেশের সকল প্রতিষ্ঠান ও পদ সৃষ্টি করিয়াছে এবং প্রয়োজনীয় ক্ষমতা ও দায়িত্ব অর্পণ করিয়াছে; (৪) জনগণের সার্বভৌমত্ব, প্রজাতন্ত্র, গণতন্ত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি এবং সংবিধানের ইধংরপ ংঃৎঁপঃঁৎব; (৫) গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কোন ধরনের ছেদ (রহঃবৎৎঁঢ়ঃরড়হ) বাংলাদেশের সংবিধান অনুমোদন করে না; (৬) সুপ্রীমকোর্ট ইহার ঔঁফরপরধষ ক্ষমতাবলে যে কোন অসাংবিধানিক আইনকে অবৈধ ঘোষণা করিতে পারে বা বাতিল (ঝঃৎরশব ড়ভভ) করিতে পারে; (৭) কোন মোকদ্দমার শুনানিকালে কোন আইনের সাংবিধানিকতার প্রশ্ন উত্থাপিত হইলে সুপ্রীমকোর্ট সে সম্পর্কে নির্লিপ্ত থাকিতে পারে না, আইনের প্রশ্নটি নিরসন করাই সুপ্রীমকোর্টের দায়িত্ব; (৮) সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদের অধীনে জাতীয় সংসদ সংবিধানের যে কোন সংশোধন করিতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কিন্তু রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি ও সংবিধানের ইধংরপ ংঃৎঁপঃঁৎব ক্ষুণœ বা খর্ব বা সংশোধন করিতে পারে না; (৯) সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধন) আইন, ১৯৯৬, বাংলাদেশ সংবিধান সংশোধন (ধসবহফসবহঃ) করিয়াছে; (১০) সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধন) আইন, ১৯৯৬, রাষ্ট্রের ভিত্তি এবং সংবিধানের ইধংরপ ংঃৎঁপঃঁৎব কে খর্ব করিয়াছে বিধায় উক্ত তর্কিত আইন অসাংবিধানিক ও অবৈধ, সুতরাং বাতিল হইবে; (১১) বিশেষ প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ও কারণাধীনে কোন আইন ভাবীসাপেক্ষ ভাবে (চৎড়ংঢ়বপঃরাবষু) অবৈধ ঘোষণা বা বাতিল করা যাইতে পারে; (১২) সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবার ক্ষেত্রে, জাতীয় সংসদের বিবেচনা (উরংপৎবঃরড়হ) অনুসারে, যুক্তিসঙ্গত কাল (ৎবধংড়হধনষব ঢ়বৎরড়ফ) পূর্বে যথা, ৪২ (বিয়াল্লিশ) দিন পূর্বে, সংসদ ভাঙ্গিয়া দেয়া বাঞ্ছনীয় হইবে, তবে, নির্বাচন-পরবর্তী নতুন মন্ত্রিসভা কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত পূর্ববর্তী মন্ত্রিসভা সংক্ষিপ্ত আকার গ্রহণকরতঃ ওই সময়ের জন্য রাষ্ট্রের স্বাভাবিক ও সাধারণ কার্যক্রম পরিচালনা করিবেন; (১৩) সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধন) আইন, ১৯৯৬, অসাংবিধানিক ও অবৈধ হইলেও জাতীয় সংসদ ইহার বিবেচনা (উরংপৎবঃরড়হ) ও সিদ্ধান্ত অনুসারে ওপরে বর্ণিত নির্দেশাবলী সাপেক্ষে দশম ও একাদশ সাধারণ নির্বাচনকালে প্রয়োজনমতো নতুনভাবে ও আঙ্গিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে পারিবে; (১৪) সাধারণ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার তারিখ হইতে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার তারিখ পর্যন্ত নির্বাচনের সহিত প্রত্যক্ষভাবে জড়িত এবং নির্বাচন কমিশনের বিবেচনা (উরংপৎবঃরড়হ) অনুসারে এমনকি পরোক্ষভাবে জড়িত, রাষ্ট্রের সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীসহ সংশ্লিষ্ট সকল ব্যক্তি নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে থাকিবে; (১৫) বিদ্যমান সংবিধানের ৫৬(২) অনুচ্ছেদের শর্ত (চৎড়ারংড়) এর পরিবর্তে ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের ৫৬(৪) অনুচ্ছেদ গণতন্ত্রের স্বার্থে আনায়ন করা প্রয়োজন; (১৬) ২০০৭ সালে দ্বিতীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ৯০ দিন মেয়াদ-পরবর্তী অতিরিক্ত প্রায় দুই বৎসর সময়কাল প্রশ্নবিদ্ধ বিধায় ঐ অতিরিক্ত সময়কালের কার্যাবলী মার্জনা (পড়হফড়হব) করা হইল।
ড. এম জহির
সিনিয়র আইনজীবী ড. এম জহির বলেন, পূর্ণাঙ্গ রায়টা এত দেরিতে এলো, আমার একটা ভয় হচ্ছে এটা অকার্যকর হয়ে গেছে কি না। বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার অলরেডি গত বছরের ৩০ জুন সংবিধানের সংশোধনী করে ফেলেছেন। তারা একটা স্ট্যান্ড নিয়েছেন। ১৩তম সংশোধনী এমনিতে চলে গেছে। আর বিএনপি স্ট্যান্ড নিয়েছ তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া তারা নির্বাচন করবে না। এতদিন পরে এ বিষয়ে রায় এসেছে। এখন এ রায় কতটা কার্যকর হবে।
তিনি বলেন, রায় হয়েছে ৪:২:১-এ। বিচারপতি ইমান আলী সংসদের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন এখন দেখছি তাই হচ্ছে। পার্লামেন্ট যা করার করে দিয়েছে। এখন এ রায় নিয়ে কি সংসদ আবার বসবে? এখন আমার সে ভয় হচ্ছে রায়ের কার্যকারিতা আছে কি না? এখন দেখা যাক এটার কার্যকর কতটা হবে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কী ভাবে নেয় দেখা যাক। এম জহির বলেন, আগামী নির্বাচন কেয়ারটেকারের অধীনে করার জন্য সংবিধান সংশোধন করতে হবে। কারণ কে হবে নির্দলীয়। সেটা তো ঠিক করতে হবে।
ড. এম জহির আরও বলেন, রায়ে বলা হয়েছে বিচারপতি ছাড়া কেয়ারটেকার গবর্নমেন্ট করতে হবে। আরও বলা হয়েছে, নির্বাচিত প্রতিনিধি ছাড়া কেউ সরকারের প্রধান হতে পারবে না। তিনি বলেন, দুই দল থেকে পাঁচ জন পাঁচ জন নির্বাচিত সদস্য নিয়ে এখনও তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা যায়। যদি ভোটার তালিকাসহ সব কিছু ঠিক থাকে, তাহলে ওই সরকারের অধীনে দুই সপ্তাহের মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব।

শ.ম রেজাউল করিম
সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক শ.ম রেজাউল করিম জনকণ্ঠকে বলেছেন, এটি একটি ঐতিহাসিক রায়। এই রায়ের দ্বারা প্রমাণিত হলো আবার জাতীয় সংসদে সকলে মিলেও যদি কোন আইন প্রণয়ন করে, তা সাংবিধানিক বিধি বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, তা বাতিল হয়ে যাবে। সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদের বাস্তব প্রতিফলন ঘটেছে এই রায়ে। আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক সরকার পদ্ধতিতে সংবিধানে মূল নীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। গণতান্ত্রিক রীতিনীতির অর্থই হলো সরকার পরিচালনা করবে, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি দ্বারা। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার মাধ্যমে অনির্বাচিত ব্যক্তিদের দ্বারা সরকার পরিচালনার যে বিধান সংযোজন করা হয়েছিল, তা কোনভাবেই সংবিধানের মূল নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না।
আরও প্রতিফলন ঘটেছে, সংসদে আইন প্রণয়নের বিষয়টি সংবিধানের বিধি বিধানের আওতায় হচ্ছে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার এখতিয়ার সুপ্রীমকোর্টেরই। সংবিধানের অভিভাবক হিসেবে সর্বোচ্চ আদালত এই ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। জনগণই সার্বভৌম। তাদের ক্ষমতার অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তি ঘটেছে সংবিধানে মধ্য দিয়ে। কেউই আইনের উর্ধে নয়। কোন আইনই সংবিধানের মূল বিধানের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হলে তা বাতিল হতে বাধ্য। এই রায় ভবিষ্যতে আইন প্রণেতাদের জন্য একটি বড় ধরনের বার্তা। যা সংবিধানের ৫ম সংশোধনী, ৭ম সংশোধনী ও ৮ম সংশোধনীর প্রদত্তে সুপ্রীমকোর্টের রায়ের পূর্বেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ফলে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে আইন প্রণেতাদের অবশ্যই সংবিধানের বিধিনিষেধ মনে রাখতে হবে।
টিএইচ খান
সাবেক বিচারপতি টিএইচ খান বলেছেন, আমি অনেক আগেই বলেছি সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক এ রায় দেয়ার অধিকার হারিয়ে ফেলেছিলেন। এ কথাটার তোয়াক্কা করেছেন বলে মনে হয় না। এটা অন্য কোন আইন নয়। এটা কনস্টিটিউশনের ভায়োলেশন। এই যে শপথ, শপথটা সাংবিধানের প্রভিশন। যেমন মন্ত্রী বা বিচারপতিদের নাম আগেই বের হয়ে পড়ে। কিন্তু তা কার্যকর হয় শপথ নেয়ার দিন থেকে। এর গুরুত্বটা কি আরও বেশি করে বলতে হবে? এটা সংবিধানের বাধ্যবাধকতা। তিনি বলেন, কিন্তু বিচারপতি খায়রুল হক সাহেব ১০ মে ২০১১ সংক্ষিপ্ত কয়েকটি বাক্যে রায় দিয়েছিল। তারপরে ১৭ মে অবসর নিয়েছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে অবসর নেয়ার পরে কলম ধরতে পারেন কিনা। এটা সো সিম্পল! ১৮ মে উনি কলম ধরতে পারেন না। ১৬ মাস পর উনি পূর্ণাঙ্গ রায় দিয়েছেন তা বাংলায় নাকি লিখেছেন। ১৭ মে এর পরে তাঁর কোন অধিকার নেই রায় দেয়ার। লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে এটা করা হয়েছে। এটা কেমনে হয়। তিনি আরও বলেন, সুপ্রীমকোর্টের উভয় বিভাগে শতাধিক বিচারপতি রয়েছেন। তাঁরা এটা লক্ষ্য করেননি। ইতোমধ্যে একটা কানাঘুঁষা হয়েছে, তিনি একবার বলেছিলেন, ২৯ মার্চ, ২০১২ রায় জমা দিয়েছেন। পরে অন্য বিচারপতিরা তাঁর সঙ্গে কিছু কিছু দ্বিমত পোষণ করেছেন, পরে তিনি এটা ফেরত নিয়ে গেছেন। এবং গত বৃহস্পতিবার রিরাইট করেন। এগুলো কি? তিনি কি তখন বিচারপতি ছিলেন? তিনি বিচারপতি ছিলেন ১৭ মে পর্যন্ত। এর বিরুদ্ধে আইনগত কোন ব্যবস্থা নেবেন কিনাÑ এ প্রশ্নের জবাবে টিএইচ খান বলেন, আমরা চেষ্টা করব। অরণ্যে রোদন করব। ইন্ডিয়ান সুপ্রীমকোর্ট হলে করা যেত। কারণ এত বড় একটা জঘন্য উদাহরণ। এত বড় জখম বা ঘা নিয়ে জনগণ বেঁচে থাকবে যে, চাকরি শেষ হওয়ার ১৬ মাস পরে রায় দেয়া যায়। তিনি বলেন, এখন কেউ যদি রসিকতা করে বলেন, কবরে গিয়েও রায় লিখে পাঠিয়ে দেয়া যাবে বাংলাদেশে, তাহলে হাসাহাসি করতে পারবে না কেউ। গায়ের জোরে এটা করা হয়েছে। এর জন্য লজ্জা পাওয়া উচিত। টিএইচ খান আরও বলেন, যা হবার তা তো হয়ে গেছে। এ রায়টি ছিল একটি শোপিস। ১৬ কোটি মানুষকে বোঝানোর জন্য এ রায় দেয়া হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ রায় আসার আগে সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে। ১৫তম সংশোধনীতে ৫১টি জায়গা ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে। এমন একটা জখম ও ঘৃণ্য জিনিস থাকে কিভাবে? খায়রুল ছাড়া বাকি ছয় বিচারপতি রায়টা দিলেও সমস্যা ছিল নাÑ বলেও মন্তব্য করেন এই জ্যেষ্ঠ আইনজীবী।
ব্যারিস্টার রফিক-উল হক
ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে একটি প্রস্তাব দিয়েছেন। কিন্তু বিরোধী দলের পক্ষ থেকে এখনও কোন রূপরেখা দেয়া হয়নি। প্রস্তাব আসুক। তারপর এটা নিয়ে কথা হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে সরকারের হেড কে হবে? আর ওই ব্যক্তি যদি নির্বাচিত না হয়। তাহলে কি হবে। এর সমাধান হিসেবে তিনি বলেন, যাকে হেড হিসেবে সিলেকশন করা হবে তাকে কোন একটি আসন থেকে নির্বাচিত করে নিলেই হয়। দুই দল রাজি থাকলে সব কিছু সম্ভব। প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধন করে।
অবসর নিয়ে রায় লেখার ব্যাপারে রফিক-উল হক বলেন, এতে সমস্যার কিছু নেই। একজন বিচারপতি রায় ঘোষণার পর পূর্ণাঙ্গ রায় লিখতে সময় নিতে পারেন। সেটা তিনি অবসরে যাওয়ার পরেও প্রকাশ করতে পারেন। তবে অবশ্যই তাঁর অবসরে যাওয়ার আগের তারিখ ব্যবহার করবেন। এ রায়তেও তাই করা হয়েছে। একজন বিচারপতি অবসরে যাওয়ার পর রায় লিখতে পারেন না বলে টিএইচ খানের বক্তব্য সম্পর্কে তিনি বলেন, এটা তাঁর ব্যক্তিগত অভিমত, আমি মনে করি এতে কোন সমস্যা নেই।
এই রায়ের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দেন বিচারপতি মোঃ আবদুল ওয়াহহাব মিঞা। তাঁর সঙ্গে একমত পোষণ করেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা। তবে বিচারপতি মোঃ ইমান আলী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে বা বিপক্ষে মত না দিয়ে বিষয়টি জাতীয় সংসদের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি এক শ’ ৫০ পৃষ্ঠার অভিমত লিখেছেন। আপীল বিভাগের রায়ের পর সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর উদ্যোগ নেয়া হয়, যা গত বছর পাস হয়।
দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির সাংবিধানিক স্বীকৃতি ১৯৯৬ সালে এলেও ১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানে এরশাদ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন একটি সরকারের অধীনে হয় সাধারণ নির্বাচন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের চাপে অনীহা সত্ত্বেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান এনে সংবিধান সংশোধন করে বিএনপি।
২০০৬ সালে রাজনৈতিক সঙ্কটের প্রেক্ষাপটে জরুরী অবস্থা জারির পর গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছর ক্ষমতায় থাকার পর এ পদ্ধতির দুর্বলতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। ত্রয়োদশ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে এ্যাডভোকেট এম সলিমউল্লাহসহ কয়েকজনের রিট আবেদনে ২০০৪ সালে হাইকোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বৈধ বলে ঘোষণা করে। ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপীল বিভাগে যায় রিট আবেদনকারী পক্ষ। তাদের আবেদনের ওপর শুনানি শেষ করেই আলোচিত এই রায়টি দেয়া হয়।
২০০৪ সালে হাইকোর্টের তিন বিচারপতির বিশেষ বেঞ্চে রিটের চূড়ান্ত শুনানি হয়। বিচারপতি মোঃ জয়নুল আবেদীন, বিচারপতি মোঃ আওলাদ আলী এবং বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চে ওই শুনানি হয়। ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বৈধ ঘোষণা করা হয়। বিচারপতি মোঃ জয়নুল আবেদীন মূল রায় লেখেন। অন্য দুই বিচারপতিও তাঁর সঙ্গে একমত পোষণ করে রায় লেখেন।
রায়ে হাইকোর্ট বলেছিলেন, ১৯৯৬ সালের ত্রয়োদশ সংশোধনী বৈধ ও সংবিধানসম্মত। এ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের প্রস্তাবনা ৪৮ এবং ৫৬ অনুচ্ছেদে কোন সংশোধন আনা হয়নি। এ কারণে কোন গণভোটের প্রয়োজন ছিল না। এই সংশোধনী সংবিধানের কোন মৌলিক কাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস করেনি বিশেষ করে গণতন্ত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে। তবে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপীলের অনুমতি দেন হাইকোর্ট।
এম আই ফারুকী
আপীল আবেদনকারী আইনজীবী এমআই ফারুকী বলেছেন, এ রায়ের কার্যকারিতা শেষ হয়ে গেছে। এটা জুডিশিয়াল হিস্ট্রি হয়ে থাকবে। আমরা এটাকে রেফারেন্স হিসেবে কাজে লাগাব।

No comments

Powered by Blogger.