কালান্তরের কড়চা-মসিউর রহমান বিদায় নিলেই কি বিশ্বব্যাংক টাকা দেবে? by আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী

সৈয়দ আবুল হোসেন কিছুকাল আগেই মন্ত্রিসভা থেকে বিদায় নিয়েছেন। তিনি যোগাযোগমন্ত্রী ছিলেন। বিশ্বব্যাংক তাঁর ওপর বিরূপ জেনে তাঁকে অন্য মন্ত্রণালয়ে সরানো হয়। তাতেও এক শ্রেণীর মিডিয়ায়, বিশেষ করে নিরপেক্ষতার মুখোশে ঢাকা একটি ইংরেজি ও বাংলা দৈনিকের চিৎকার বন্ধ হয়নি।


তারা এমন প্রচারণা শুরু করে যে আবুল হোসেন মন্ত্রিসভা থেকে চলে গেলেই যেন বিশ্বব্যাংক ছুটে এসে পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থ ঢেলে দেবে! সৈয়দ আবুল হোসেন যখন পদত্যাগ করলেন, তখন এই দুটি পত্রিকার কি সহর্ষ নিনাদ! এমনকি আমাদের অর্থমন্ত্রী পর্যন্ত বলে ফেললেন, আবুল ইজ ডাউন। পরে তিনি নিজের বক্তব্য সংশোধন করে বলেছেন, তিনি আবুল ইজ ডাউন বলেননি, বলেছেন আবুল ইজ ইন টাউন।
আবুল শেষ পর্যন্ত গেছেন। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের টাকা আসেনি। এখন নাকি বিশ্বব্যাংক গর্দান চাইছে শেখ হাসিনার উপদেষ্টা পরিষদের ড. মসিউর রহমানের। কারণ কী? তাঁর বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ? মসিউর রহমান দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এবং চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেছেন, বিশ্বব্যাংক তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ দিক। সেই সঙ্গে তিনি পদত্যাগের ইচ্ছাও ব্যক্ত করেছেন। বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী চাইলে তিনি দশবার পদত্যাগ করতে প্রস্তুত। প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, 'আগে ওরা (বিশ্বব্যাংক) টাকা দিক। তারপর মসিউর রহমানকে উপদেষ্টা পরিষদ থেকে সরানোর কথা ভাবব।' প্রধানমন্ত্রী সংগত কথাই বলেছেন। পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থ যদি আসে, তাহলে একজন উপদেষ্টা নির্দোষ হয়েও পদত্যাগ করলে সেটাকে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে তাঁর আত্মত্যাগ বলে গণ্য করা যাবে।
কিন্তু বিশ্বব্যাংকের অর্থ এখনো আসেনি এবং আসার কোনো সম্ভাবনাও এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। তাহলে সৈয়দ আবুল হোসেনকে বলি দেওয়ার পর ড. মসিউর রহমানকে কেন বলি দেওয়া হবে? সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীর বিরুদ্ধে না হয় এক শ্রেণীর মিডিয়া নানা দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ধরেছিল। কিন্তু মসিউর রহমানের বিরুদ্ধে তো সে রকম কোনো অভিযোগও এখন পর্যন্ত তারা তুলে ধরতে পারেনি, এমনকি তাঁকে দুর্নীতিবাজও বলতে পারছে না। তাহলে দোষী প্রমাণিত হওয়ার আগেই বিশ্বব্যাংকের হুকুম মেনে তাঁকে চলে যেতে হবে কেন? বিশ্বব্যাংকের যেকোনো দাবি বা হুকুম বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নেওয়া কি একটি স্বাধীন দেশের সার্বভৌমত্ব ও আত্মমর্যাদার গুরুতর হানি ঘটায় না?
তবু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের বৃহত্তর স্বার্থে সৈয়দ আবুল হোসেনকে মন্ত্রিসভা থেকে বিদায় দিয়েছেন এবং ড. মসিউর রহমানকেও বিদায় দিতে প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন। অর্থাৎ বিশ্বব্যাংকের দাবি পূরণে প্রধানমন্ত্রী অর্ধপথ এগিয়েছেন। বিশ্বব্যাংককেও এখানে এ ব্যাপারে তাদের আন্তরিকতা ও শুভেচ্ছার নিদর্শনস্বরূপ অর্ধপথ এগিয়ে আসতে হবে। পদ্মা সেতু প্রকল্পে তাদের অর্থ প্রদানের বিষয়টি পুনর্বিবেচনার ঘোষণা দিতে হবে। তারপর না হয় দেশের স্বার্থে মসিউর রহমান নিজ থেকেই উপদেষ্টা পদ থেকে পদত্যাগ করলেন। কিন্তু এর পরও বিশ্বব্যাংকের অর্থ না এলে তাতে কি হাসিনা সরকারের পক্ষে নাক কেটে নরুন পাওয়া হবে না?
মসিউর রহমান ভালো কি মন্দ লোক, সে প্রশ্নে আমি যাচ্ছি না। আমার কথা, তিনি উপদেষ্টা পদ থেকে সরে গেলেই বিশ্বব্যাংক টাকা দেবে, তার নিশ্চয়তা কী? এই নিশ্চয়তা বিশ্বব্যাংক দেয়নি। তথাপি ঢাকার এক শ্রেণীর মিডিয়া (প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক), বিশেষ করে 'প্রথম আলো' ও 'ডেইলি স্টার' এমন প্রচার শুরু করেছে, যেন মসিউর রহমান সরে গেলেই পদ্মা সেতুর জন্য বিশ্বব্যাংকের টাকা আসার সব বাধা দূর হয়ে যাবে। বিশ্বব্যাংক এই দুটি পত্রিকার কানে কানে এ কথা বলে দিয়েছে কি না আমি জানি না।
আমার এই কলামের পাঠকদের স্মরণ আছে কি না জানি না, সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ তুললেও তা নিয়ে বড় ঝড় তুলেছিল এই দুটি ইংরেজি ও বাংলা দৈনিক। 'বামুনের কাঁধের পাঁঠার বাচ্চাকে কুকুরছানা' প্রমাণ করার মতো সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে যতটা দুর্নীতির অভিযোগ, তাকে তাল করে তুলে এবং নিত্য প্রোপাগান্ডা চালিয়ে জনমনে এই ধারণা বদ্ধমূল করে তোলা হয়েছিল যে আবুল হোসেনের চেয়ে বড় দুর্নীতিবাজ দেশে নেই এবং মন্ত্রিসভা থেকে তিনি চলে গেলেই বিশ্বব্যাংকের টাকা পেতে আর দেরি হবে না। বিশ্বব্যাংক দুই হাতে পদ্মা সেতুর জন্য টাকা ঢালতে শুরু করবে।
আবুল হোসেনের গর্দান গেছে, কিন্তু বিশ্বব্যাংকের টাকা আসেনি। এখন বিশ্বব্যাংক এবং এই দুটি পত্রিকার নতুন টার্গেট মসিউর রহমান। আবুল হোসেন-বধের পর এখন মসিউর-বধের জন্য এক শ্রেণীর মিডিয়া, বিশেষ করে এই দুটি পত্রিকা উঠে-পড়ে লেগেছে। আবার জনমনে এই বিশ্বাস বদ্ধমূল করার চেষ্টা চলছে যে মসিউর রহমান গেলেই বিশ্বব্যাংকের টাকা এসে যাবে।
পত্রিকা দুটির আবুল-বধ ও মসিউর-বধ অভিযানের মধ্যে পার্থক্য একটাই। আবুল-বধ অভিযানের সময় সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীকে স্পষ্টভাবেই দুর্নীতিবাজ বলা হয়েছে। মসিউর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযানের বেলায় তাঁকে দুর্নীতিবাজ বলা হচ্ছে না। বরং তাঁকে ভালো মানুষ আখ্যা দিয়ে দেশের স্বার্থে পদত্যাগ করতে বলা হয়েছে। দোষ না করেও তাঁকে বিশ্বব্যাংকের হুকুম তামিল করতে হবে। অর্থাৎ নাক ডলাটা খেতে হবে হাসিনা সরকারকে। পত্রিকা দুটিরও আসল টার্গেট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নাক ডলাটা তারা দিতে চায় প্রধানমন্ত্রীকে। প্রধানমন্ত্রীই তাদের আসল টার্গেট। আজ নয়, বহুদিন থেকে।
গতকাল (সোমবার) ডেইলি স্টারে সম্পাদক মাহফুজ আনামের একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন বেরিয়েছে। শিরোনাম-'Moshiur's dilemma, should he or should not he resign' (মসিউরের সমস্যা : তাঁর পদত্যাগ করা অথবা না করা উচিত)? আগের দিন প্রথম আলোতে একই ধরনের প্রতিবেদন বেরিয়েছে। মসিউর রহমান যে একজন 'অনেস্ট' লোক, দক্ষ ও অভিজ্ঞ সাবেক ব্যুরোক্রাট_এসব কথা নানাভাবে ইনিয়ে-বিনিয়ে বলার পর তাঁর যে পদত্যাগ করাই উচিত সন্তর্পণে এ উপদেশটি দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, এটা হবে দেশের স্বার্থে বিরাট আত্মত্যাগ।
হিপোক্রেসিকে যে সাংবাদিকতার মুখোশ পরিয়ে বাজারে বিক্রি করা যায়, তার প্রমাণ এই পত্রিকা দুটি বহুবার দিয়েছে। বিশ্বব্যাংক যখন তুচ্ছ ছুতানাতায় একটা দেশের সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় মর্যাদার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, তখন সেই দেশের মিডিয়া হয়ে পত্রিকা দুটি বিশ্বব্যাংকের কোনো সমালোচনা না করে, সেই ব্যাংকের হুকুম বিনা বাক্যব্যয়ে তামিল করার জন্য দেশটিকে পরামর্শ দিচ্ছে এবং জোর প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে। অন্য কোনো স্বাধীন দেশ হলে দুটি মিডিয়ার এই ভূমিকাকে কি রাষ্ট্রের স্বার্থের পরিপন্থী ও দেশবিরোধী বলে গণ্য করা হতো না?
মাহফুজ আনাম হাসিনা সরকারের যে উপদেষ্টাকে বলছেন অনেস্ট এবং এফিশিয়েন্ট এক মানুষ ও সাবেক ব্যুরোক্র্যাট, একটি বাইরের দাতা সংস্থার হুকুমে তাঁকে 'দেশের স্বার্থে' পদত্যাগ করতে উপদেশ দেওয়া কি হিপোক্রেসি ও উদ্দেশ্যমূলক নয়? এই দুটি তথাকথিত নিরপেক্ষ মিডিয়া কি বিশ্বব্যাংক অথবা অন্য কোনো সূত্র থেকে আশ্বাস পেয়েছে যে ড. মসিউর রহমান উপদেষ্টা পদ ছেড়ে দিলেই পদ্মা সেতুর জন্য টাকা আসবে? সৈয়দ আবুল হোসেন চলে যাওয়ার পরও টাকা আসেনি। তখন বলা হয়েছিল, আবুল হোসেনই পদ্মা সেতুর টাকা না আসার পথে প্রধান বাধা। এখন মসিউর রহমান চলে গেলেই টাকা আসবে_এই নিশ্চয়তা কে দেবে? বিশ্বব্যাংকের হয়ে মতি-মাহফুজ দিতে পারবেন কি? নাকি মসিউর রহমান চলে যাওয়ার পর বিশ্বব্যাংক বলবে, শেখ হাসিনারই প্রধানমন্ত্রীর পদে ইস্তফা দেওয়া উচিত! তিনি চলে গেলেই পদ্মা সেতুর টাকা আসবে। ক্ষমতা থেকে শেখ হাসিনার বিদায়_এটাই তো মতিউর রহমান ও মাহফুজ আনামের একান্ত বাসনা।
বাংলা সাহিত্যে 'ঠাকুরদার ঝুলি' নামে একটি রূপকথার বই আছে। তার একটি গল্পের সারমর্ম হচ্ছে, এক রাজার দুই অমাত্য ছিল। তারা ছিল যুদ্ধে দক্ষ। রাজার শত্রুরা কিছুতেই তাঁর ক্ষতি করতে না পেরে রোজই রাজার হিতাকাঙ্ক্ষী সেজে তাঁকে বলত, রাজার ডান পাশের সহচর হচ্ছে অত্যন্ত খারাপ লোক। তাকে তারা নিধন করতে চায়। তাহলে রাজা দুর্নামমুক্ত হবেন। ডান পাশের অমাত্যতে নিধন করা হলো। তখন বাম পাশের অমাত্যের বিরুদ্ধে একই কথা বলা হতে লাগল। ফলে তাকেও সরানো হলো। সব শেষে রাজার শত্রুরা তাঁকে ঘিরে ফেলল। বলল, রাজা, তুমিই সব দোষে দোষী। আমরা তোমাকেই নিধন করতে এসেছি।
আমার একটি ধারণা (সঠিক না হলেই খুশি হব), মসিউর রহমান যদি চলে যান, তার পরও পদ্মা সেতুর টাকা আসবে না। মসিউর রহমানের পর অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেবকেও যেতে হবে (যদিও তিনি বিশ্বব্যাংকের মন রক্ষার অনেক চেষ্টা করেছেন, কিন্তু পারেননি)। শেষ পর্যন্ত ইউনূস সাহেবকে গ্রামীণ ব্যাংক ফিরিয়ে দেওয়া এবং টিকফা চুক্তিতে সই করা ছাড়া পদ্মা প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের টাকা আসবে না। আর এই টাকা না এলে, পদ্মা প্রকল্পের কাজ শুরু করা না গেলে যদি আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হতে না পারে, তাতে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এলেও সবচেয়ে খুশি হবেন ড. ইউনূস; সেই সঙ্গে তাঁর দুই নন্দীভৃঙ্গি প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার সম্পাদকও। তখন হয়তো দেখা যাবে, পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে দেনদরবার করছেন ড. ইউনূস এবং তা সরকারকে এনে দিচ্ছেনও। তখন হয়তো বিশ্বব্যাংক এই দাবিও তুলবে না যে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় গেলে পুরনো দুর্নীতিবাজদের মন্ত্রিসভায় স্থান দেওয়া যাবে না। অথবা হাওয়া ভবনের অধীশ্বরদের নতুন সরকারে কোনো ভূমিকা থাকা চলবে না। আমার এ অনুমান সঠিক না হলেই যে খুশি হব, তা আগেই বলেছি। তবে সঠিক হলে হবে দেশ ও জাতির জন্য চরম দুর্ভাগ্য।
মাহফুজ আনাম তাঁর প্রতিবেদনের শিরোনাম দিয়েছেন, 'মসিউরস ডায়লেমা'। এটা আসলে মসিউর রহমানের ডায়লেমা নয়, ডায়লেমা হাসিনা সরকারের। সাহস দেখিয়ে মাহফুজ আনাম সে কথাটা লেখেননি। হাসিনা সরকারের সামনে এখন দুটো পথ। বিশ্বব্যাংকের সব হুকুম তামিল করে নতজানু হওয়া এবং নাকডলা খাওয়া। তাতে বিশ্বব্যাংকের টাকা প্রাপ্তি নিশ্চিত হলেও সময়মতো আসবে কি না সন্দেহ। আর তা না হলে জাতীয় মর্যাদা অক্ষুণ্ন রেখে বিশ্বব্যাংকের কাছে নতজানু না হয়ে বিকল্প অর্থায়নে পদ্মা প্রকল্প শুরু করার দুরূহ কাজ, যাকে এখন অসাধ্য কাজ বলা হচ্ছে, সে কাজে হাত দেওয়া। প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের পরামর্শে কান দিলে শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকার পত্রিকা দুটির পাতা ফাঁদেই পা দেবেন।
লন্ডন, সোমবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১২

No comments

Powered by Blogger.