বুড়িগঙ্গার তীরে ৫১ তলা ভবন
একবিংশ শতকে নগরে জমির বড়ই দুর্মূল্য। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অবস্থা খুবই শোচনীয়; দেড় কোটি মানুষের এই ঘনবসতিপূর্ণ নগরে বর্তমানে তিল ধারণের জায়গা নেই বললেই চলে। তবু জীবিকার খোঁজে দেশের নানা জায়গা থেকে প্রতিদিনই মানুষ আসছে ঢাকায়।
প্রত্যন্ত এলাকায় নদীভাঙ্গন, প্রাকৃতিক বিপর্যয় কিংবা অন্য যে কোন কারণে সর্বস্বান্ত হওয়া মানুষের শেষ আশ্রয় ঢাকা। তাই এই নগরীতে মানুষ বাড়ছে দ্রুত গতিতে। অপরদিকে নগরীর সম্প্রসারণেরও একটি সীমা রয়েছে। কারণ জনসংখ্যার তুলনায় বাংলাদেশ খুবই ছোট আয়তনের একটি দেশ; দেশের মানুষের স্বার্থে প্রয়োজনীয় কৃষিজমি ও বনভূমি সংরক্ষণ অপরিহার্য। এ কারণেই সময়ের প্রয়োজনে ও সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রাজধানীতে অবশ্যই বহুতল ভবন নির্মাণ প্রয়োজন। জানা গেছে, একটি আবাসন কোম্পানি বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে ৬টি ৫১ তলা আবাসিক ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শনিবার ঢাকা মহানগরে ‘বহুতল ভবনের সুযোগসুবিধা’ শীর্ষক এক সেমিনারে সংশ্লিষ্ট আবাসন কোম্পানির পক্ষ থেকে এ কথা ঘোষণা করা হয়। সারাবিশ্বেই এখন পরিবর্তিত জীবনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বহুতল বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভবন নির্মিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে থাকবে কেন? বরং বাংলাদেশের মতো পৃথিবীর একটি অন্যতম জনবসতিপূর্ণ দেশে অনেক আগেই ৫০/৬০ তলা ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত ছিল। ইতোমধ্যে কুয়ালালামপুর, সিঙ্গাপুর, হংকং, সাংহাইসহ এশিয়ার আরও কিছু নগর এ বিষয়ে অনেক এগিয়ে গেছে।
ঢাকায় বহুতল আবাসিক ভবনের পরিকল্পনা অবশ্যই প্রশংসনীয় ও ইতিবাচক; কিন্তু সমস্যা হলো, তা বুড়িগঙ্গা নদীর তীর ঘেঁষে নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হলো কেন? গত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ঢাকার ‘প্রাণপ্রবাহ’ নামে পরিচিত বুড়িগঙ্গা নদী মারাত্মক দূষণের শিকার। নানা ধরনের পোড়া তেল, ক্ষতিকর রাসায়নিক ও বর্জ্যরে কারণে এ নদী ইতোমধ্যে বিষাক্ত নদী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। একই সঙ্গে শুরু হয়েছে এই মৃতপ্রায় নদী দখলের ষড়যন্ত্র। ভূমিদস্যুরা নানা ধরনের সাইনবোর্ডের আড়ালে এই নদীকে দখল করতে চায়; অনেক জায়গায় তারা বালু ফেলে নদীর তীর দখলের ষড়যন্ত্রে ব্যস্ত। কেউবা দখল স্থায়ী করার জন্য নদীর তীর ঘেঁষে অবৈধ স্থায়ী কাঠামো নির্মাণ করেছে। গত দু’তিন দশক ধরে লক্ষ্য করা গেছে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় নদীর একটি অংশ মুক্ত করেছে, তখন অবৈধ দখলদাররা নদীর অন্য একটি অংশ পুনর্দখল করে নিয়েছে। এভাবে দীর্ঘকাল ধরে ঢাকার প্রাণপ্রবাহ বুড়িগঙ্গাকে ঘিরে কতিপয় দুর্বৃত্ত ‘দখল-দখল’ খেলায় মেতেছে।
এখন প্রশ্ন হলো, সংশ্লিষ্ট আবাসন কোম্পানি বুড়িগঙ্গা নদীর তীর ঘেঁষে ‘৫১ তলা আবাসন ভবন’ নির্মাণের অনুমতি পেল কোথা থেকে? কারণ নদীর তীর রাষ্ট্রের সম্পত্তি; পরিবেশ রক্ষার প্রয়োজনে বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে সবুজ বেষ্টনী নির্মাণের কথা রয়েছে। এছাড়া নদীতীরবর্তী নরম বালুমাটিতে বহুতল ভবন নির্মাণ কতখানি নিরাপদ ও যুক্তিসঙ্গত? কারণ ঢাকা মহানগরীতে বহুতল ভবন দেবে যাওয়ার ঘটনা বহুবার ঘটেছে। সুতরাং সম্ভাব্য দুর্ঘটনার কথাও ভাবতে হবে। জানা গেছে, বুড়িগঙ্গার তীরে ৫১ তলা ভবন নির্মাণের আগে ইতোমধ্যে ‘সয়েল টেস্ট ও অন্যান্য পরীক্ষার’ কথা উঠেছে। এছাড়া এসব ভবন নির্মাণের আগে বুড়িগঙ্গা নদীকে অবশ্যই পরিপূর্ণভাবে দূষণমুক্ত করা দরকার। অপরিকল্পিতভাবে আবাসিক এলাকা ও কলকারখানা নির্মাণের জন্য বুড়িগঙ্গা নদী মৃতপ্রায়। এ অবস্থায় নিরপেক্ষভাবে গোটা বিষয়টি যাচাই করা প্রয়োজন। আমরা অবশ্যই বহুতল আবাসিক ভবন চাই। কিন্তু নদী ও পরিবেশকে ধ্বংস করে নয়। মনে রাখতে হবে, বুড়িগঙ্গা যদি বাঁচে, তবে ঢাকা শহর বাঁচবে।
No comments