নো ইজি ডে- ছেলের জামা ভিজে গেল বাবার রক্তে by মশিউল আলম
অভিযানে অংশগ্রহণকারী মার্কিন কমান্ডো, অফিসার ও সিআইএ অপারেটিভরা ‘ট্রুপ নেটের’ বেতারযন্ত্রে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করছিলেন সাংকেতিক ভাষায়। ম্যাট বিসোনেটের (মার্ক ওয়েন) নো ইজি ডে বইয়ের বিবরণে লক্ষ করি, তাঁরা কখনো লাদেন বা ওসামা নামটি উচ্চারণ করেননি।
কখনো বলেছেন ‘আওয়ার বয়’, কখনো ‘আওয়ার গাই’, কখনো ‘ইউবিএল’। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে লাদেনের সাংকেতিক একটি নাম নির্ধারণ করা হয়েছিল, সেটি ‘জেরোনিমো’।
ম্যাটের সহযোগী উইল, যিনি আরবি বলতে পারেন, এক শিশু ও এক নারীর সাক্ষ্যে যখন নিশ্চিত হলেন যে তিনতলার শোবার ঘরের মেঝেতে যে লাশটি পড়ে আছে, সেটা ওসামা বিন লাদেনের, তখন তিনি তাঁর হেলমেটের সঙ্গে লাগানো ট্রুপ নেটের বেতারযন্ত্রের স্পিকারে বললেন, দুই দফায় নিশ্চিত হওয়া গেল। ছোট্ট মেয়েটি ও বয়স্ক নারী—দুজনেই বলছে একই কথা। এ কথা বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন উইল। তারপর টমকে সঙ্গে নিয়ে ঢুকলেন অভিযানের নেতা জে। সিআইএর দেওয়া লাদেনের ছবি নিহত লাদেনের মুখের পাশে রেখে শনাক্ত করলেন তাঁকে এবং ছবি তুললেন। তারপর দ্রুত বেরিয়ে গিয়ে স্যাটেলাইট বেতারে যোগাযোগ করলেন আফগানিস্তানের জালালাবাদে অ্যাডমিরাল ম্যাকর্যাভেনের সঙ্গে। আফগান যুদ্ধে মার্কিন জয়েন্ট স্পেশাল অপারেশন্স কমান্ডের কমান্ডার ম্যাকর্যাভেন জালালাবাদ থেকে প্রতি মুহূর্তের শেষ খবর পৌঁছে দিচ্ছেন ওয়াশিংটনে হোয়াইট হাউসের সিচুয়েশন রুমে ভিডিও পর্দায় অভিযান পর্যবেক্ষণরত প্রেসিডেন্ট ওবামা ও তাঁর পারিষদকে। জে তাঁকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘ঈশ্বর ও স্বদেশের নামে, আমি জেরোনিমো সম্পর্কে সর্বশেষ সংবাদ জানাচ্ছি: জেরোনিমো ই.কে.আই.এ. (এনিমি কিল্ড ইন অ্যাকশন)।’
তার কয়েক ঘণ্টা পর আমেরিকার জনগণ ও বিশ্ববাসী টেলিভিশনের পর্দায় দেখতে পায়, হোয়াইট হাউসের লালগালিচা বিছানো করিডর ধরে গট গট করে হেঁটে এসে মাইকের সামনে দাঁড়ালেন প্রেসিডেন্ট ওবামা, দৃঢ় কণ্ঠে বললেন: ‘যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ ও বিশ্ববাসীকে আজ আমি জানাতে পারি, যুক্তরাষ্ট্র একটি অভিযান চালিয়ে আল-কায়েদার নেতা ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করেছে।...আল-কায়েদার সন্ত্রাসের কাছে যাঁরা প্রিয়জনদের হারিয়েছেন, আমরা তাঁদের বলতে পারি, ন্যায়বিচার সম্পন্ন করা হয়েছে..।’ জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন বললেন, ‘ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যু সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিন্ন বৈশ্বিক লড়াইয়ে একটি মোড় ফেরানো মুহূর্ত। ব্যক্তিগতভাবে আমি অত্যন্ত স্বস্তি বোধ করছি যে ন্যায়বিচার সম্পন্ন হয়েছে।’ কিন্তু অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এই ঘটনার আইনি বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। ইউরোপের কয়েকজন বিশিষ্ট মানবাধিকার আইনজ্ঞ এই ঘটনাকে ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড’ বলে অভিহিত করেন। পাকিস্তানের সরকার ও সামরিক বাহিনী ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে তাদেরকে না জানিয়ে তাদের সীমান্ত অতিক্রম করে ওই হামলা চালানো হয়েছে বলে।
কিন্তু লাদেন হত্যা অভিযান পুরোপুরি শেষ হতে আরও কিছু সময় বাকি। ম্যাট বিসোনেট ট্রুপ নেটের বেতারযন্ত্রে শুনতে পাচ্ছেন, অন্য কমান্ডোরা বাড়িটির বিভিন্ন ঘর থেকে লাদেনের ব্যবহূত বিভিন্ন সরঞ্জাম, নথিপত্র, গোয়েন্দা তথ্য ইত্যাদি সংগ্রহের কাজে আরও সহযোগিতা চাইছেন। নিচে, বাইরের উঠানে অচল হেলিকপ্টারটি বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ধ্বংস করার প্রস্তুতি চলছে। সিল টিমের (মার্কিন নৌবাহিনীর সি, এয়ার অ্যান্ড ল্যান্ড টিম—সিইএএল) একজনকে সে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তাঁর সঙ্গে আছেন একজন ইওডি টেক (এক্সপ্লোসিভ অর্ডন্যান্স ডিসপোজাল টেকনিশিয়ান, বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ)। ম্যাট শুনতে পাচ্ছেন, সিল সদস্যটি বলছে, ‘আমরা এখন বিস্ফোরণ ঘটাতে যাচ্ছি।’ সামরিক সাংকেতিক ভাষায় ‘বুঝেছি’ বলে বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ টেকনিশিয়ানটি বাড়ির মূল ভবনের মেঝেতে বিস্ফোরক বসাতে শুরু করে দিল।
‘কী করছ?’ সিল সদস্যটি চিৎকার করে বলল ইওডিকে।
‘তুমি আমাকে বললে উড়িয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নিতে, ঠিক আছে?’
‘বাড়ি উড়িয়ে দিতে বলিনি, হেলিকপ্টারটা।’
‘কোন হেলিকপ্টার?’
বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ তখনো জানেন না যে একটি হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়েছে, ধ্বংস করতে বলা হচ্ছে সেটিকে। হেলিকপ্টারটির চালকদল সেটির ভেতরের ক্ল্যাসিফাইড যন্ত্রপাতিগুলো ইতিমধ্যে ধ্বংস করে ফেলছেন। বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ ও সিল সদস্যটি গিয়ে হেলিকপ্টারটির ফিউলিলেজের চারপাশে বিস্ফোরক স্থাপন করতে লাগলেন। অক্ষত একমাত্র ‘ব্ল্যাক হক’ হেলিকপ্টার ও আর বিমানবাহিনীর কুইক রিঅ্যাকশন ফোর্সের (কিউআরএফ) সদস্যদের বহনকারী সিএইচ-৪৭ হেলিকপ্টারটি কাছাকাছি বেশ নিচু দিয়ে ধীরে ধীরে চক্কর খাচ্ছে। ওগুলোর জ্বালানি ফুরিয়ে আসছে।
এই সময় বেতারযন্ত্রে ম্যাট শুনতে পেলেন সহযোদ্ধা মাইকের কণ্ঠ: আর মাত্র ১০ মিনিট। এর মধ্যেই সব কাজ শেষ করে হেলিকপ্টারে উঠে পড়তে হবে। ফিরে যেতে হবে আফগানিস্তানের জালালাবাদে। কিন্তু ভেতরে আরও অনেক কাজ বাকি। দোতলার কয়েকটি ঘরে লাদেনের মিডিয়া বিভাগ, ওখানে একটা অফিস বানিয়েছিলেন তিনি। তাঁর কম্পিউটারগুলো রাখা ছিল সেখানে, সেখানে বসেই তিনি বক্তৃতাগুলো রেকর্ড করে বাইরে পাঠিয়ে দিতেন। ম্যাট লিখছেন, ‘ঘরগুলো বেশ সাজানো-গোছানো। প্রতিটি জিনিস সুনির্দিষ্ট জায়গায় ঠিকমতো রাখা। সিডি, ডিভিডি, মেমোরি কার্ড—সবকিছু বেশ গুছিয়ে রাখা। সিল সদস্যরা বিশেষ যত্নের সঙ্গে সংগ্রহ করছিল ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি: কম্পিউটার, রেকর্ডার, মেমোরি কার্ড, থাম ড্রাইভ। প্রশিক্ষণের সময় সিআইএ আমাদের বলেছিল, লাদেন কী ধরনের ডিজিটাল ভয়েস রেকর্ডার ব্যবহার করেন, এমনকি নমুনাও দেখিয়েছিল। সিল সদস্যরা দোতলায় হুবহু একই রকমের রেকর্ডার পেয়েছে..।
‘ছবি তোলা ও ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ শেষ হলে ওয়াল্ট ও আরেকজন সিল সদস্য লাদেনের পা দুটি ধরে টেনে ঘরের বাইরে নিয়ে গেল...ওরা সিঁড়ি বেয়ে লাশটি নিচে নামিয়ে নিয়ে গেল। আমি ওই ঘরেই রয়ে গেলাম, গুরুত্বপূর্ণ যা কিছু চোখে পড়ল, সংগ্রহ করতে লাগলাম। তেমন কিছু নেই। কিছু কাগজপত্র, সম্ভবত ধর্মীয় লেখা, আর কয়েকটি অডিও ক্যাসেট ঢুকিয়ে নিলাম ব্যাগের মধ্যে। লাদেনের ব্যবহূত এসব জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা হালকা, মুড়িয়ে পকেটে রাখা যায়—এমন ব্যাগ সঙ্গে নিয়ে এসেছি।...তারপর দ্রুত সার্চ করে নিলাম সবুজ টাইল বসানো বাথরুমটি। সেখানেও তেমন কিছু নেই। চুলের কলপের একটা বাক্স দেখতে পেলাম, শুধু পুরুষের জন্য...বাথরুম আর অফিসের মাঝখানের দেয়ালে একটি কাঠের আলমারি, সেটির দুই কপাট প্রায় ছয় ফুট উঁচু, ভেতরে কয়েক সেট পোশাক: জোব্বা, ঢোলা পাজামা, কুর্তা...সবকিছু এত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন যে আমি অভিভূত হয়ে গেলাম...তাঁর সবগুলো গেঞ্জি চৌকোণ করে ভাঁজ করে একটার ওপর আরেকটা পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখা। হ্যাঙ্গারে ঝোলানো পোশাকগুলো একদম নিভাঁজ।...কয়েকটি জোব্বা ও কুর্তা আমার ব্যাগে গুঁজে নিলাম...বেরিয়ে আসার আগে লক্ষ করলাম, দরজার ওপরে একটা শেলফ...আমি হাত ঢুকিয়ে দিলাম, হাতে ঠেকল দুটি অস্ত্রের স্পর্শ: একটি একে-৪৭ রাইফেল, আর হোলস্টারের মধ্যে একটি মাকারভ পিস্তল। দুটোই নামিয়ে এনে ম্যাগাজিন খুলে চেম্বারগুলো দেখলাম। দুটো চেম্বারই শূন্য।’
প্রেসিডেন্ট ওবামা তাঁর জনগণ ও বিশ্ববাসীকে জানিয়েছেন, ওসামা বিন লাদেন ‘গানফাইটে’ মারা গেছেন। অভিযানের কমান্ডার প্রেসিডেন্টকে জানিয়েছেন, ‘এনিমি কিল্ড ইন অ্যাকশন।’ কিন্তু লাদেনের শোবার ঘরে তাঁর বহুদিনের ব্যবহূত দুটি অস্ত্রের (কথিত আছে, একে-৪৭ রাইফেলটি লাদেন ছিনিয়ে নিয়েছিলেন এক সোভিয়েত জেনারেলের কাছ থেকে, যখন তিনি আফগানিস্তানকে সোভিয়েতদের আগ্রাসন থেকে মুক্ত করার জন্য মুজাহিদদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন, আর আমেরিকা ও পাকিস্তান তাঁকে অস্ত্র, গোলাবারুদ, টাকা-পয়সা ও বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেছিল) শূন্য চেম্বার দেখে সিল টিম সিক্সের দুর্ধর্ষ যোদ্ধা ম্যাট বিসোনেটের মনে হচ্ছে, লাদেন ‘এমনকি আত্মরক্ষার প্রস্তুতিটুকুও নেননি। লড়াই করার কোনো ইচ্ছাই তাঁর ছিল না। দুই দশক ধরে তিনি তাঁর অনুসারীদের উদ্বুদ্ধ করেছেন বুকে আত্মঘাতী বোমা বেঁধে নিতে, বা বিমানসুদ্ধ বিল্ডিংয়ের ভেতরে ঢুকে পড়তে। কিন্তু তিনি নিজে হাত বাড়িয়ে অস্ত্রটি তুলেও নেননি। আমরা সব সময়ই এই বিষয়টা লক্ষ করেছি: নেতা যত ওপরের দিকের, ততই তাঁর ভয় বেশি। সরাসরি লড়াইয়ের ব্যাপারে নেতাদের আগ্রহ কম। বুকে বিস্ফোরক বেঁধে নিজেদের উড়িয়ে দেয় সব সময়ই তরুণেরা, যাদের মন কচি, সহজেই প্রভাবিত হয়।...
‘আমার বরং বেশি শ্রদ্ধাবোধ হচ্ছে অতিথিশালার আল-কুয়েতির প্রতি, তিনি অন্তত চেষ্টা করেছিলেন নিজেকে ও নিজের পরিবারকে রক্ষা করতে। আত্মরক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য অন্য সবার চেয়ে বেশি সময় পেয়েছিলেন লাদেন, কিন্তু তিনি কিছুই করেননি। নিজের আদর্শের প্রতি তাঁর নিজেরই বিশ্বাস ছিল তো? যে যুদ্ধের ডাক তিনি দিয়েছিলেন, সেই যুদ্ধে লড়ার আগ্রহ কি তাঁর ছিল? আমার তা মনে হয় না। যদি তাঁর সে আগ্রহ থাকত, তা হলে নিজের বিশ্বাসের জন্য অন্তত অস্ত্র হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াতেন। যে আদর্শের জন্য নিজে লড়বেন না, তার জন্য অন্যদের প্রাণ উৎসর্গ করতে পাঠানোর মধ্যে কোনো সম্মান নেই...।’
ইতিমধ্যে এলাকায় বিদ্যুৎ চলে এসেছে। আশপাশের লোকজন টের পেয়ে গেছে ‘ওয়াজিরিস্তান হাভেলি’ নামের রহস্যময় বাড়িটিতে কিছু ঘটছে। কৌতূহলী কিছু মানুষ জড়ো হয়েছে বাড়িটির সামনের রাস্তায়। তাদের সামাল দিচ্ছেন আলী নামের এক দোভাষী, তিনি আফগান না পাকিস্তানি, কীভাবে, কখন তিনি কমান্ডোদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন, নাকি হেলিকপ্টারে করে তাঁদের সঙ্গেই এসেছেন—ম্যাট বিসোনেট এসব কিছুই লেখেননি। শুধু লিখেছেন, বাড়ির সামনে সিল টিমের চার কমান্ডোর সঙ্গে আলী আছেন অভিযানের একদম শুরু থেকে। রাত দেড়টার দিকে অভিযানের প্রায় শেষ পর্যায়ে বাড়িটির সামনের রাস্তায় কিছু কৌতূহলী লোক জড়ো হলে আলী তাঁদের বলেন, ‘নিরাপত্তা অভিযান চলছে। আপনারা নিজ নিজ ঘরে চলে যান।’ লোকজন চলে গেছে।
সময় ফুরিয়ে আসছে দ্রুত, হাতে আর মাত্র পাঁচ মিনিট। ম্যাট তিনতলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগলেন। ওয়াল্ট ও আরেক কমান্ডো একটু আগেই নামিয়ে নিয়ে গেছে লাদেনের লাশ। সিঁড়ি রক্তে পিচ্ছিল। সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে ম্যাট দেখতে পেলেন, নিচে ‘ওরা খালিদের লাশের ওপর টেনে তুললেন লাদেনের লাশ। ছেলের সাদা জামা ভিজে গেল বাবার রক্তে...’
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
ম্যাটের সহযোগী উইল, যিনি আরবি বলতে পারেন, এক শিশু ও এক নারীর সাক্ষ্যে যখন নিশ্চিত হলেন যে তিনতলার শোবার ঘরের মেঝেতে যে লাশটি পড়ে আছে, সেটা ওসামা বিন লাদেনের, তখন তিনি তাঁর হেলমেটের সঙ্গে লাগানো ট্রুপ নেটের বেতারযন্ত্রের স্পিকারে বললেন, দুই দফায় নিশ্চিত হওয়া গেল। ছোট্ট মেয়েটি ও বয়স্ক নারী—দুজনেই বলছে একই কথা। এ কথা বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন উইল। তারপর টমকে সঙ্গে নিয়ে ঢুকলেন অভিযানের নেতা জে। সিআইএর দেওয়া লাদেনের ছবি নিহত লাদেনের মুখের পাশে রেখে শনাক্ত করলেন তাঁকে এবং ছবি তুললেন। তারপর দ্রুত বেরিয়ে গিয়ে স্যাটেলাইট বেতারে যোগাযোগ করলেন আফগানিস্তানের জালালাবাদে অ্যাডমিরাল ম্যাকর্যাভেনের সঙ্গে। আফগান যুদ্ধে মার্কিন জয়েন্ট স্পেশাল অপারেশন্স কমান্ডের কমান্ডার ম্যাকর্যাভেন জালালাবাদ থেকে প্রতি মুহূর্তের শেষ খবর পৌঁছে দিচ্ছেন ওয়াশিংটনে হোয়াইট হাউসের সিচুয়েশন রুমে ভিডিও পর্দায় অভিযান পর্যবেক্ষণরত প্রেসিডেন্ট ওবামা ও তাঁর পারিষদকে। জে তাঁকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘ঈশ্বর ও স্বদেশের নামে, আমি জেরোনিমো সম্পর্কে সর্বশেষ সংবাদ জানাচ্ছি: জেরোনিমো ই.কে.আই.এ. (এনিমি কিল্ড ইন অ্যাকশন)।’
তার কয়েক ঘণ্টা পর আমেরিকার জনগণ ও বিশ্ববাসী টেলিভিশনের পর্দায় দেখতে পায়, হোয়াইট হাউসের লালগালিচা বিছানো করিডর ধরে গট গট করে হেঁটে এসে মাইকের সামনে দাঁড়ালেন প্রেসিডেন্ট ওবামা, দৃঢ় কণ্ঠে বললেন: ‘যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ ও বিশ্ববাসীকে আজ আমি জানাতে পারি, যুক্তরাষ্ট্র একটি অভিযান চালিয়ে আল-কায়েদার নেতা ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করেছে।...আল-কায়েদার সন্ত্রাসের কাছে যাঁরা প্রিয়জনদের হারিয়েছেন, আমরা তাঁদের বলতে পারি, ন্যায়বিচার সম্পন্ন করা হয়েছে..।’ জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন বললেন, ‘ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যু সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিন্ন বৈশ্বিক লড়াইয়ে একটি মোড় ফেরানো মুহূর্ত। ব্যক্তিগতভাবে আমি অত্যন্ত স্বস্তি বোধ করছি যে ন্যায়বিচার সম্পন্ন হয়েছে।’ কিন্তু অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এই ঘটনার আইনি বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। ইউরোপের কয়েকজন বিশিষ্ট মানবাধিকার আইনজ্ঞ এই ঘটনাকে ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড’ বলে অভিহিত করেন। পাকিস্তানের সরকার ও সামরিক বাহিনী ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে তাদেরকে না জানিয়ে তাদের সীমান্ত অতিক্রম করে ওই হামলা চালানো হয়েছে বলে।
কিন্তু লাদেন হত্যা অভিযান পুরোপুরি শেষ হতে আরও কিছু সময় বাকি। ম্যাট বিসোনেট ট্রুপ নেটের বেতারযন্ত্রে শুনতে পাচ্ছেন, অন্য কমান্ডোরা বাড়িটির বিভিন্ন ঘর থেকে লাদেনের ব্যবহূত বিভিন্ন সরঞ্জাম, নথিপত্র, গোয়েন্দা তথ্য ইত্যাদি সংগ্রহের কাজে আরও সহযোগিতা চাইছেন। নিচে, বাইরের উঠানে অচল হেলিকপ্টারটি বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ধ্বংস করার প্রস্তুতি চলছে। সিল টিমের (মার্কিন নৌবাহিনীর সি, এয়ার অ্যান্ড ল্যান্ড টিম—সিইএএল) একজনকে সে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তাঁর সঙ্গে আছেন একজন ইওডি টেক (এক্সপ্লোসিভ অর্ডন্যান্স ডিসপোজাল টেকনিশিয়ান, বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ)। ম্যাট শুনতে পাচ্ছেন, সিল সদস্যটি বলছে, ‘আমরা এখন বিস্ফোরণ ঘটাতে যাচ্ছি।’ সামরিক সাংকেতিক ভাষায় ‘বুঝেছি’ বলে বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ টেকনিশিয়ানটি বাড়ির মূল ভবনের মেঝেতে বিস্ফোরক বসাতে শুরু করে দিল।
‘কী করছ?’ সিল সদস্যটি চিৎকার করে বলল ইওডিকে।
‘তুমি আমাকে বললে উড়িয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নিতে, ঠিক আছে?’
‘বাড়ি উড়িয়ে দিতে বলিনি, হেলিকপ্টারটা।’
‘কোন হেলিকপ্টার?’
বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ তখনো জানেন না যে একটি হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়েছে, ধ্বংস করতে বলা হচ্ছে সেটিকে। হেলিকপ্টারটির চালকদল সেটির ভেতরের ক্ল্যাসিফাইড যন্ত্রপাতিগুলো ইতিমধ্যে ধ্বংস করে ফেলছেন। বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ ও সিল সদস্যটি গিয়ে হেলিকপ্টারটির ফিউলিলেজের চারপাশে বিস্ফোরক স্থাপন করতে লাগলেন। অক্ষত একমাত্র ‘ব্ল্যাক হক’ হেলিকপ্টার ও আর বিমানবাহিনীর কুইক রিঅ্যাকশন ফোর্সের (কিউআরএফ) সদস্যদের বহনকারী সিএইচ-৪৭ হেলিকপ্টারটি কাছাকাছি বেশ নিচু দিয়ে ধীরে ধীরে চক্কর খাচ্ছে। ওগুলোর জ্বালানি ফুরিয়ে আসছে।
এই সময় বেতারযন্ত্রে ম্যাট শুনতে পেলেন সহযোদ্ধা মাইকের কণ্ঠ: আর মাত্র ১০ মিনিট। এর মধ্যেই সব কাজ শেষ করে হেলিকপ্টারে উঠে পড়তে হবে। ফিরে যেতে হবে আফগানিস্তানের জালালাবাদে। কিন্তু ভেতরে আরও অনেক কাজ বাকি। দোতলার কয়েকটি ঘরে লাদেনের মিডিয়া বিভাগ, ওখানে একটা অফিস বানিয়েছিলেন তিনি। তাঁর কম্পিউটারগুলো রাখা ছিল সেখানে, সেখানে বসেই তিনি বক্তৃতাগুলো রেকর্ড করে বাইরে পাঠিয়ে দিতেন। ম্যাট লিখছেন, ‘ঘরগুলো বেশ সাজানো-গোছানো। প্রতিটি জিনিস সুনির্দিষ্ট জায়গায় ঠিকমতো রাখা। সিডি, ডিভিডি, মেমোরি কার্ড—সবকিছু বেশ গুছিয়ে রাখা। সিল সদস্যরা বিশেষ যত্নের সঙ্গে সংগ্রহ করছিল ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি: কম্পিউটার, রেকর্ডার, মেমোরি কার্ড, থাম ড্রাইভ। প্রশিক্ষণের সময় সিআইএ আমাদের বলেছিল, লাদেন কী ধরনের ডিজিটাল ভয়েস রেকর্ডার ব্যবহার করেন, এমনকি নমুনাও দেখিয়েছিল। সিল সদস্যরা দোতলায় হুবহু একই রকমের রেকর্ডার পেয়েছে..।
‘ছবি তোলা ও ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ শেষ হলে ওয়াল্ট ও আরেকজন সিল সদস্য লাদেনের পা দুটি ধরে টেনে ঘরের বাইরে নিয়ে গেল...ওরা সিঁড়ি বেয়ে লাশটি নিচে নামিয়ে নিয়ে গেল। আমি ওই ঘরেই রয়ে গেলাম, গুরুত্বপূর্ণ যা কিছু চোখে পড়ল, সংগ্রহ করতে লাগলাম। তেমন কিছু নেই। কিছু কাগজপত্র, সম্ভবত ধর্মীয় লেখা, আর কয়েকটি অডিও ক্যাসেট ঢুকিয়ে নিলাম ব্যাগের মধ্যে। লাদেনের ব্যবহূত এসব জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা হালকা, মুড়িয়ে পকেটে রাখা যায়—এমন ব্যাগ সঙ্গে নিয়ে এসেছি।...তারপর দ্রুত সার্চ করে নিলাম সবুজ টাইল বসানো বাথরুমটি। সেখানেও তেমন কিছু নেই। চুলের কলপের একটা বাক্স দেখতে পেলাম, শুধু পুরুষের জন্য...বাথরুম আর অফিসের মাঝখানের দেয়ালে একটি কাঠের আলমারি, সেটির দুই কপাট প্রায় ছয় ফুট উঁচু, ভেতরে কয়েক সেট পোশাক: জোব্বা, ঢোলা পাজামা, কুর্তা...সবকিছু এত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন যে আমি অভিভূত হয়ে গেলাম...তাঁর সবগুলো গেঞ্জি চৌকোণ করে ভাঁজ করে একটার ওপর আরেকটা পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখা। হ্যাঙ্গারে ঝোলানো পোশাকগুলো একদম নিভাঁজ।...কয়েকটি জোব্বা ও কুর্তা আমার ব্যাগে গুঁজে নিলাম...বেরিয়ে আসার আগে লক্ষ করলাম, দরজার ওপরে একটা শেলফ...আমি হাত ঢুকিয়ে দিলাম, হাতে ঠেকল দুটি অস্ত্রের স্পর্শ: একটি একে-৪৭ রাইফেল, আর হোলস্টারের মধ্যে একটি মাকারভ পিস্তল। দুটোই নামিয়ে এনে ম্যাগাজিন খুলে চেম্বারগুলো দেখলাম। দুটো চেম্বারই শূন্য।’
প্রেসিডেন্ট ওবামা তাঁর জনগণ ও বিশ্ববাসীকে জানিয়েছেন, ওসামা বিন লাদেন ‘গানফাইটে’ মারা গেছেন। অভিযানের কমান্ডার প্রেসিডেন্টকে জানিয়েছেন, ‘এনিমি কিল্ড ইন অ্যাকশন।’ কিন্তু লাদেনের শোবার ঘরে তাঁর বহুদিনের ব্যবহূত দুটি অস্ত্রের (কথিত আছে, একে-৪৭ রাইফেলটি লাদেন ছিনিয়ে নিয়েছিলেন এক সোভিয়েত জেনারেলের কাছ থেকে, যখন তিনি আফগানিস্তানকে সোভিয়েতদের আগ্রাসন থেকে মুক্ত করার জন্য মুজাহিদদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন, আর আমেরিকা ও পাকিস্তান তাঁকে অস্ত্র, গোলাবারুদ, টাকা-পয়সা ও বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেছিল) শূন্য চেম্বার দেখে সিল টিম সিক্সের দুর্ধর্ষ যোদ্ধা ম্যাট বিসোনেটের মনে হচ্ছে, লাদেন ‘এমনকি আত্মরক্ষার প্রস্তুতিটুকুও নেননি। লড়াই করার কোনো ইচ্ছাই তাঁর ছিল না। দুই দশক ধরে তিনি তাঁর অনুসারীদের উদ্বুদ্ধ করেছেন বুকে আত্মঘাতী বোমা বেঁধে নিতে, বা বিমানসুদ্ধ বিল্ডিংয়ের ভেতরে ঢুকে পড়তে। কিন্তু তিনি নিজে হাত বাড়িয়ে অস্ত্রটি তুলেও নেননি। আমরা সব সময়ই এই বিষয়টা লক্ষ করেছি: নেতা যত ওপরের দিকের, ততই তাঁর ভয় বেশি। সরাসরি লড়াইয়ের ব্যাপারে নেতাদের আগ্রহ কম। বুকে বিস্ফোরক বেঁধে নিজেদের উড়িয়ে দেয় সব সময়ই তরুণেরা, যাদের মন কচি, সহজেই প্রভাবিত হয়।...
‘আমার বরং বেশি শ্রদ্ধাবোধ হচ্ছে অতিথিশালার আল-কুয়েতির প্রতি, তিনি অন্তত চেষ্টা করেছিলেন নিজেকে ও নিজের পরিবারকে রক্ষা করতে। আত্মরক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য অন্য সবার চেয়ে বেশি সময় পেয়েছিলেন লাদেন, কিন্তু তিনি কিছুই করেননি। নিজের আদর্শের প্রতি তাঁর নিজেরই বিশ্বাস ছিল তো? যে যুদ্ধের ডাক তিনি দিয়েছিলেন, সেই যুদ্ধে লড়ার আগ্রহ কি তাঁর ছিল? আমার তা মনে হয় না। যদি তাঁর সে আগ্রহ থাকত, তা হলে নিজের বিশ্বাসের জন্য অন্তত অস্ত্র হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াতেন। যে আদর্শের জন্য নিজে লড়বেন না, তার জন্য অন্যদের প্রাণ উৎসর্গ করতে পাঠানোর মধ্যে কোনো সম্মান নেই...।’
ইতিমধ্যে এলাকায় বিদ্যুৎ চলে এসেছে। আশপাশের লোকজন টের পেয়ে গেছে ‘ওয়াজিরিস্তান হাভেলি’ নামের রহস্যময় বাড়িটিতে কিছু ঘটছে। কৌতূহলী কিছু মানুষ জড়ো হয়েছে বাড়িটির সামনের রাস্তায়। তাদের সামাল দিচ্ছেন আলী নামের এক দোভাষী, তিনি আফগান না পাকিস্তানি, কীভাবে, কখন তিনি কমান্ডোদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন, নাকি হেলিকপ্টারে করে তাঁদের সঙ্গেই এসেছেন—ম্যাট বিসোনেট এসব কিছুই লেখেননি। শুধু লিখেছেন, বাড়ির সামনে সিল টিমের চার কমান্ডোর সঙ্গে আলী আছেন অভিযানের একদম শুরু থেকে। রাত দেড়টার দিকে অভিযানের প্রায় শেষ পর্যায়ে বাড়িটির সামনের রাস্তায় কিছু কৌতূহলী লোক জড়ো হলে আলী তাঁদের বলেন, ‘নিরাপত্তা অভিযান চলছে। আপনারা নিজ নিজ ঘরে চলে যান।’ লোকজন চলে গেছে।
সময় ফুরিয়ে আসছে দ্রুত, হাতে আর মাত্র পাঁচ মিনিট। ম্যাট তিনতলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগলেন। ওয়াল্ট ও আরেক কমান্ডো একটু আগেই নামিয়ে নিয়ে গেছে লাদেনের লাশ। সিঁড়ি রক্তে পিচ্ছিল। সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে ম্যাট দেখতে পেলেন, নিচে ‘ওরা খালিদের লাশের ওপর টেনে তুললেন লাদেনের লাশ। ছেলের সাদা জামা ভিজে গেল বাবার রক্তে...’
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
No comments