বিশেষ সাক্ষাৎকার : আ স ম হান্নান শাহ-দেশের বিভিন্ন স্থানে নীরব দুর্ভিক্ষ চলছে

কঠোর আন্দোলন কর্মসূচি থেকে পিছিয়ে এসেছে বিএনপি তথা ১৮ দলীয় জোট। সরকারের মন্ত্রিসভা সম্প্রসারিত হয়েছে। দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কালের কণ্ঠের মুখোমুখি হয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আ স ম হান্নান শাহ (অব.)।


সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলী হাবিব ও মোশাররফ বাবলু
কালের কণ্ঠ : সুশাসন নিয়েই শুরু করা যাক। সুশাসন ছাড়া একটি জাতির অগ্রগতি সম্ভব নয়। স্বাভাবিকভাবে জনগণের প্রত্যাশা সুশাসন_যা মহাজোটের নির্বাচনী অঙ্গীকারও। সেই প্রত্যাশিত সুশাসন কতটুকু নিশ্চিত করতে পেরেছে সরকার?
আ স ম হান্নান শাহ : এ প্রশ্নের জবাব এক কথায় দিলে বলতে হবে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার তাদের নির্বাচনী অঙ্গীকার অনুযায়ী এ দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। জনগণের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে বলেই বাংলাদেশের মানুষ বর্তমান মহাজোট সরকারের ওপর থেকে তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়েছে। যেহেতু সরকার প্রত্যাশিত সুশাসন নিশ্চিত করতে পারেনি, তাদের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করতে পারেনি, তাই জনগণ মনে করে, বর্তমান সরকার প্রতিশ্রুতি রক্ষায় ব্যর্থ। কাজেই ভবিষ্যতে এই জোট নির্বাচনে গেলে নির্বাচনে তাদের ভরাডুবি হবে।
কালের কণ্ঠ : সাড়ে তিন বছর পার করল মহাজোট সরকার। সরকারের এই সময়টাকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
আ স ম হান্নান শাহ : কেবল আমি নই, বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষই মনে করে, গত সাড়ে তিন বছরে এই মহাজোট সরকার পরিচালনায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। এই সরকারের শুরুর দিকে তাদের পেটোয়া বাহিনী; অর্থাৎ ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ অন্যান্য অঙ্গসংগঠনের টেন্ডারবাজি, বিরোধী দলের ওপর হামলা-মামলা, এমনকি বিরোধী দলের নেতাদের গুম-হত্যাসহ যেসব অপরাধ করেছে, তার জন্য জনগণ বর্তমান সরকারের প্রতি বীতশ্রদ্ধ। সরকারের ব্যর্থতার সূচক যদি নির্দিষ্ট করে বলতে হয়, তাহলে শুরুতেই বলতে হবে শেয়ারবাজারের কেলেঙ্কারির কথা। সেই কেলেঙ্কারিতে যাঁরা জড়িত, তাঁদের সরকার শাস্তি না দিয়ে পুরস্কৃত করেছে। আমরা লক্ষ করেছি, এই সরকার তাদের দলের নেতা-কর্মীদের সব অপরাধ ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে। সেই অপরাধের ফলে যে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হয়, মানুষ কষ্ট পায়_সেই কষ্টকে সরকার আমলে নেয় না। নিজেদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এই সরকার নিজেদের গণবিরোধী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি তো রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এখন মন্ত্রী বদল হওয়ার পর অবস্থা কী দাঁড়ায়, সেটাই দেখার বিষয়। বিডিআর হত্যাকাণ্ড প্রমাণ করে, দেশের নিরাপত্তা বাহিনী নিরাপদ নয়। এর জন্য সরকারকেই দায়ী করতে হবে। সরকার সচেষ্ট ও আন্তরিক হলে এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হতে পারত না। এই সরকার গণতন্ত্রের কথা বলে। কিন্তু নিজেরা তো গণতন্ত্র চর্চা করেই না, বিরোধী দলকেও গণতন্ত্র চর্চা করতে দেয় না। সরকারের ব্যর্থতার সূচক অনেক। বলে শেষ করা যাবে না। সোনালী ব্যাংকসহ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে যেসব জালিয়াতি সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিদের সহায়তায় হয়েছে, তাতেও জনগণ মনে করে এই সরকার ব্যর্থ।
এই সরকার দক্ষিণবঙ্গের জন্য পদ্মা সেতুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কী দেখলাম আমরা? বিগত সাড়ে তিন বছরে কোনো কাজ হয়নি। উল্টো বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য দাতা সংস্থার সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। এখন পদ্মা সেতু নির্মাণের বিষয়টিই অনিশ্চিত। এটাও সরকারের একটি ব্যর্থতা। গত সাড়ে তিন বছরে এই সরকার জনগণের কল্যাণে কিছু করতে পেরেছে বলে আমরা মনে করি না। যে বিদ্যুৎ ব্যবস্থার জন্য আগের বিএনপি সরকারকে দোষারোপ করা হয়, এই সরকারের আমলে তো অবস্থা আরো শোচনীয়। কুইক রেন্টাল দিয়ে কুইক মানি মেকিং প্রসেস করার পরও এখন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়নি। লোডশেডিং আগের তুলনায় বেড়েছে। যেদিকে তাকাই, সরকারের ব্যর্থতার ছাপ স্পষ্ট। সাফল্য কোথায়?
কালের কণ্ঠ : বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। বেড়েছে জীবনযাত্রার ব্যয়। এ অবস্থায় সরকার কী ব্যবস্থা নিতে পারত বলে আপনি মনে করেন? সরকারের পক্ষ থেকে কিন্তু বারবার বলা হচ্ছে, সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। এ প্রসঙ্গে আপনার অভিমত কী?
আ স ম হান্নান শাহ : বাজারে জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বেড়েছে। দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতির জন্য সরকারের বিভিন্ন নীতি দায়ী। সরকারের নীতি জনগণের জন্য গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। সরকার দাবি করছে, জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। ক্রয়ক্ষমতা জনগণের বেড়েছে কি না জানি না; তবে সরকারি দলের লোকজনের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় এখন নীরব দুর্ভিক্ষ চলছে। এই সরকার দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করার জন্য কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। একটা কথা চালু আছে, সরকারের লোকজন বাজার নিয়ন্ত্রণের কথা বললে বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। বাজারে চালের দাম কিছুটা কম। এটা সরকারের কৃতিত্ব নয়, কৃতিত্ব কৃষকের। সরকার বলেছিল বিনা মূল্যে সার দেবে। দিতে পারেনি। বরং বেগম খালেদা জিয়া সরকারের সময় ইউরিয়া সারের যে দাম ছিল, তা এখন অনেক বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। একইভাবে অন্যান্য সারের দাম দ্বিগুণ বা তিন গুণ। সরকার যে কৃষি উপকরণ সুলভ মূল্যে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তার প্রতিফলন কোথায়?
কালের কণ্ঠ : এর পাশাপাশি শেয়ারবাজার নিয়ে কথা বলা যেতে পারে। শেয়ারবাজার নিয়ে আপনার অভিমত জানতে চাই।
আ স ম হান্নান শাহ : একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করুন। যখনই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে, প্রতিবারই তারা লুটপাট করেছে। এই অপকর্ম ঢাকার জন্য প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে। আজ নতুন করে আবার শেয়ার কেলেঙ্কারির কথা উঠেছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় আসে, তখন শেয়ার কেলেঙ্কারি হয়েছিল। এবারও অভিযোগ উঠেছে, আওয়ামী লীগের হর্তাকর্তারাই এই কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত। খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল। সেই কমিটি একটি রিপোর্ট দিয়েছে। সেই রিপোর্টটি জনসমক্ষে প্রকাশ করলেই তো হয়। তাহলেই তো সবার নাম বেরিয়ে আসে। শুধু মুখে অভিযোগ না করে তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করা হোক। অর্থমন্ত্রী নিজেই তো বলেছেন, এর সঙ্গে অনেক রাঘব বোয়াল জড়িত। তাঁদের নাম প্রকাশ করলে নাকি স্বয়ং মন্ত্রীই অসুবিধায় পড়বেন। এই শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের নামের তালিকা বিএনপির কাছে আছে। শেয়ার কেলেঙ্কারির দায় বর্তমান সরকার কিছুতেই এড়াতে পারবে না। এ জন্য সরকারকে রাজনৈতিক মাসুল দিতে হবে।
কালের কণ্ঠ : নতুন যে ব্যাংকগুলোর লাইসেন্স দেওয়া হলো, এ নিয়ে আপনার অভিমত কী?
আ স ম হান্নান শাহ : আমরা জানি, আমাদের মতো একটি দরিদ্র দেশে চাহিদার চেয়ে বেশি ব্যাংক থাকলে সেগুলো সুষ্ঠুভাবে চলবে না। যাঁরা এখানে আমানত রাখবেন, তাঁদের আমানত নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা আছে। এই আশঙ্কা আছে বলেই বিএনপি সরকার গত শাসনামলে একটি ব্যাংকেরও অনুমোদন দেয়নি। এই সরকার সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিবেচনায় কয়েকটি ব্যাংকের অনুমোদন দিয়েছে। এর মধ্যে একটি প্রবাসী। দেশের ব্যাংকগুলোর বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের বা তাদের মিত্রদের দেওয়া হয়েছে। অনেকেই সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। তাঁদের পক্ষে বৈধ ৪০০ কোটি টাকা জোগান দেওয়া নিশ্চয়ই কষ্টকর। এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে তাঁরা বলেন, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে নিয়েছেন। সাফাই গাইতে আওয়ামী লীগ অত্যন্ত পারদর্শী।
পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অবস্থা দেখুন। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, সব রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে সরকারের ঘনিষ্ঠ লোকজনই জালিয়াতির মাধ্যমে টাকা তুলে নিয়ে গেছে। আত্মসাৎ করেছে। হলমার্ক গ্রুপের কথাই ধরুন। এই গ্রুপের সঙ্গে এখন অনেককে দায়ী করা হচ্ছে। শুধু হলমার্কই নয়, অনেক গ্রুপেরই জালিয়াতি ও লোপাটের কথা এখন ধীরে ধীরে জানা যাচ্ছে।
কালের কণ্ঠ : মন্ত্রিসভায় আবারও একটা পরিবর্তন লক্ষ করা গেল। শুরুতে মন্ত্রিপরিষদ সদস্যদের দক্ষতা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। আপনার মূল্যায়ন কী? আপনার কি মনে হয়, মন্ত্রীদের কারণে সরকারের ভাবমূর্তি ম্লান হয়েছে বা হচ্ছে? সাম্প্রতিক এই রদবদল কি সরকারের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করতে পারবে?
আ স ম হান্নান শাহ : আমি নিজেও একসময় মন্ত্রী ছিলাম। মন্ত্রীরা কতটুকু কাজ করতে পারেন বা পারেন না, তা আমি জানি। ঢালাওভাবে সব মন্ত্রীকে অদক্ষ বলা ঠিক হবে না। বেশ কয়েকজন দক্ষ মন্ত্রী আছেন। তবে অদক্ষ মন্ত্রীর সংখ্যাই বেশি। যে মন্ত্রীরা বলেন, ছাগল-গরু চিনতে পারলেই ড্রাইভার হওয়া যাবে, ওই মন্ত্রীদের সম্পর্কে কী আর বলা যাবে? তবে সততা ও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছেন_এমন অনেক মন্ত্রী আছেন। এই সরকারের বোঝা হচ্ছে উপদেষ্টামণ্ডলী। হলমার্ক কেলেঙ্কারির সঙ্গে এক উপদেষ্টার নাম এসেছে। বিদ্যুতের অব্যবস্থাপনার জন্য আরেক উপদেষ্টার নাম এসেছে। পদ্মা সেতুর যে বিপর্যয়, তার জন্য আবুল হোসেনকে মন্ত্রিত্ব ছাড়তে হয়েছে। এক উপদেষ্টার কারণে সরকার বিব্রত। মন্ত্রীদের দপ্তর বণ্টন করতে করতে যখন আর কোনো দপ্তর নেই, তখন দপ্তর ভেঙে নতুন দপ্তর করে নতুন মন্ত্রীদের দেওয়া হয়েছে। দপ্তরবিহীন মন্ত্রী তো আছেনই একজন। মন্ত্রিসভায় নতুন মুখ এসেছে। দেখার বিষয়, এতে কোনো গুণগত পরিবর্তন আসে কি না। এই পরিবর্তন বা মন্ত্রিসভার সম্প্রসারণ সরকারের জন্য কতটা সুখকর হবে, সেটা বলবে ভবিষ্যৎ।
কালের কণ্ঠ : বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি কতটুকু দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে পারছে? সেই দায়িত্বশীলতার প্রতিফলন কোথায়? বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক ধারায় বিএনপি কি যথার্থ ভূমিকা রাখতে পারছে? বিরোধী দলের লাগাতার সংসদ বর্জনকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন আপনি?
আ স ম হান্নান শাহ : সংসদে গিয়ে যেমন কথা বলা যায়, সংসদের বাইরেও বলা যায়। মওলানা ভাসানী কয়বার সংসদে গিয়ে কথা বলেছেন? নেতা হিসেবে তাঁকে কি উপেক্ষা করতে পারবেন? সংসদে গিয়ে কথা বলা নিয়ে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। বিবেচনার বিষয় হচ্ছে, যে কথা বলা হচ্ছে, সেটা যৌক্তিক কি না। বিরোধী দলের ভূমিকা নিয়ে কথা বলতে গেলে বলতে হবে, বিরোধী দলকে কি যথার্থ ভূমিকা রাখতে দেওয়া হচ্ছে? আজকের সরকারি দল বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় কত দিন সংসদ বর্জন করেছে, সেটা তাদের স্মরণে নেই। আমরা প্রথম দিনেই সংসদে যোগ দিয়েছিলাম। আমরা দেশের জন্য সংসদে কথা বলতে চেয়েছিলাম। দেশের জন্য অবদান রাখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেই পরিবেশ নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। সংসদে বিরোধী দলকে কটাক্ষ করা হয়, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয়। সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা এখন পর্যন্ত সঠিক বলেই আমরা মনে করি।
কালের কণ্ঠ : বিরোধী দলের জোট সম্প্রসারিত হয়েছে। এই জোট দেশের রাজনীতিতে কতটুকু প্রভাব ফেলতে পারবে বলে মনে করেন আপনি?
আ স ম হান্নান শাহ : শুরুতে সরকার পতন আমাদের লক্ষ্য ছিল না। আন্দোলনের শুরুতে আমাদের লক্ষ্য ছিল একটি নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান নিশ্চিত করা। কিছুদিন আগে একটি মিথ্যা মামলায় বিরোধী দলের ৩৫ জন শীর্ষ নেতাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। আমরা জেলে থাকলাম। পুলিশি নির্যাতনের শিকার হলাম। হয়রানির শিকার হলাম। গায়ের জোরে, প্রশাসনকে ব্যবহার করে এই সরকার বিরোধী দলকে দমন করছে। আমাদের আন্দোলন সরকারের এই আচরণের বিরুদ্ধে। কিন্তু সরকারের জানা উচিত, 'এক মাঘে শীত যায় না'। আমাদের কর্মসূচির বর্তমান লক্ষ্য জনগণকে সম্পৃক্ত করা। জনগণের পক্ষে, জনগণের দাবি নিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা জনগণের বিপুল সাড়া পেয়েছি। আরো পাব বলে আশা রাখি। জনসমর্থন জোরদার করেই আমরা এ সরকারকে বাধ্য করব আমাদের দাবি মেনে নিতে।
কালের কণ্ঠ : আরেকটি ওয়ান-ইলেভেন আসন্ন এমন কথা আজকাল অনেককেই বলতে শোনা যায়। এ সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী?
আ স ম হান্নান শাহ : আমি ও আমার দল গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। অগণতান্ত্রিক বা অসাংবিধানিক পন্থায় কেউ ক্ষমতায় আসুক, এটা আমরা চাই না। বিগত দিনে ফখরুদ্দীন-মঈনুদ্দিনের যে সরকার এসেছিল, সেটা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল না। সেটা ছিল বিদেশি প্রভু ও তাদের দেশি দোসরদের যোগসাজশে তৈরি সরকার। আমরা কেউ ওয়ান-ইলেভেন চাইনি, চাই না। গত ওয়ান-ইলেভেন সৃষ্টি করেছিল আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগী দলগুলো। নিজেদের অপকর্ম ঢাকতে ও জনগণের রুদ্ররোষ থেকে বাঁচার জন্য বিদেশি প্রভুদের সহায়তা নিয়ে আবার এমন পরিস্থিতি সৃৃষ্টি করে, যাতে আরেকটি ওয়ান-ইলেভেনের আশঙ্কা প্রকট হয়, তাহলে আমি অবাক হব না। এ দেশে সংঘাত ছাড়া, বিনা রক্তপাতে শুধু তত্ত্বাবধায়ক আমলেই ক্ষমতার পরিবর্তন হয়েছে। এক ফখরুদ্দীন-মঈনুদ্দিন, সেটা আওয়ামী লীগেরই সৃষ্টি, সেটাকে খারাপ উদাহরণ হিসেবে ধরে নিয়ে আমাদের ধমকালে চলবে না। যেহেতু আমরা জাতীয়তাবাদী শক্তি, কেউ আমাদের নির্মূল করতে পারবে না।
কালের কণ্ঠ : তত্ত্বাবধায়ক কিংবা অন্তর্বর্তী_নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা কী হবে, তা নিয়ে প্রধান দুই দলের অবস্থান পরস্পরবিরোধী। এর ফলে দেশের রাজনীতি কি ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ অবস্থার দিকে যাচ্ছে? আপনার কী মত?
আ স ম হান্নান শাহ : আমরা বিশ্বাস করি, সব সমস্যার সমাধান সংলাপের মাধ্যমে হতে পারে। কিন্তু সেই সংলাপের আগে একটা পটভূমি তৈরি করতে হয়। যেটাকে বলা যেতে পারে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড। প্রধানমন্ত্রী তাঁর আগের অবস্থান থেকে অনেকটাই সরে এসেছেন। এখন আরেকটু সরে এসে যদি ঘোষণা দেন, নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে, তাহলে সমস্যার অনেকটাই সমাধান হয়ে গেল। তত্ত্বাবধায়ক নাকি অন্তর্বর্তী_নাম নিয়ে দর কষাকষি আমরা করতে চাই না। 'গোলাপকে যে নামে ডাকুন' গোলাপ তো গোলাপই। নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারকে যে নামেই ডাকা হোক, তার কাজ হবে নির্দলীয়-নিরপেক্ষভাবে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান। প্রধানমন্ত্রী যে ফর্মুলা দিয়েছেন, তা গ্রহণযোগ্য নয়।
কালের কণ্ঠ : গাজীপুর-৪ আসনের আসন্ন উপনির্বাচনে আপনার দল অংশ নিচ্ছে না। অথচ আপনারা বলছেন, সেখানে জনগণ আওয়ামী লীগকে বয়কট করবে।
আ স ম হান্নান শাহ : আমরা সেখানে একটি জরিপ করেছি। তাতে দেখেছি, জনগণ সে এলাকায় আওয়ামী লীগকে চায় না। কারণ আওয়ামী লীগ বারবার কাপাসিয়ার জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। তাদের মিথ্যা আশ্বাস-প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ওই এলাকায় কোনো উন্নয়নই আওয়ামী লীগ সরকারের সময় হয়নি। সুতরাং আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সীমিত সুযোগের মধ্যেই কাপাসিয়ার জনগণ আওয়ামী লীগকে প্রত্যাখ্যান করবে। প্রশ্ন উঠতে পারে, বিএনপি সেখানে নির্বাচন করতে গেল না কেন? বিএনপি সেখানে নির্বাচন করতে গেলে জিতে আসত। মনে রাখতে হবে, বিএনপি সারা বাংলাদেশ নিয়ে চিন্তা করছে। ক্ষুদ্রস্বার্থ নিয়ে ভাবছে না। একটি আসনের জন্য দলের দাবি দুর্বল করবে না বিএনপি। বিএনপি মনে করে, বর্তমান নির্বাচন কমিশন সরকারের তল্পিবাহক। এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে বলে আমরা মনে করি না। সার্বিক বিবেচনায়ই নির্বাচন বর্জন করেছে বিএনপি।
কালের কণ্ঠ : যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে। এই বিচারপ্রক্রিয়াকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
আ স ম হান্নান শাহ : আমরা তো বরাবরই বলে এসেছি, এই বিচার হওয়া উচিত। কিন্তু এই বিচার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হবে, সেটা আমরা সমর্থন করি না। আমরা মনে করি, সুষ্ঠু বিচার হওয়া উচিত। বিচারটি আন্তর্জাতিকমানের হতে হবে। ট্রাইব্যুনাল গঠনের সময়ও উদ্দেশ্য এটাই ছিল।
কালের কণ্ঠ : আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলা অনেকটাই নির্ভর করে সরকারের দক্ষতার ওপর। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির গতি-প্রকৃতি কী হওয়া উচিত বলে মনে করেন আপনি?
আ স ম হান্নান শাহ : বর্তমান সরকারের ভুল পররাষ্ট্রনীতি ও ব্যর্থতার কারণে আজ বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বন্ধুহীন। বর্তমান সরকারের ব্যর্থতার কারণে সমুদ্রসীমা নিয়ে মিয়ানমারের কাছে আমাদের যে দাবি ছিল, সেটা আমরা শত ভাগ পূরণ করতে পারিনি বর্তমান সরকারের ব্যর্থতার কারণে। কেবল একটি দেশের প্রতি সরকারের আনুগত্য। মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। তার প্রভাব পড়েছে জনশক্তি রপ্তানিতে। কোনো সাফল্য নেই।
কালের কণ্ঠ : আগামী দেড় বছরে দেশ ও দেশের মানুষের ব্যাপারে সরকারের কাছে আপনার প্রত্যাশা কী?
আ স ম হান্নান শাহ : সরকারের কাছে কোনো প্রত্যাশা নেই। জনগণের কাছে সরকারের এক ধরনের অঙ্গীকার থাকে। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি থাকে। এসব অঙ্গীকার বা প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সরকার সফল হবে বলে মনে হয় না। দেশের মানুষ সরকারের প্রতি অনাস্থা জানাতে শুরু করেছে। প্রবীণ সাংবাদিক এ বি এম মূসা এক টেলিভিশন টক শোতে কী বলেছেন, সেটা আমরা জানি।
কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
আ স ম হান্নান শাহ : বাংলাদেশে রাজনীতিচর্চার ক্ষেত্রে বিভিন্ন দলের মধ্যে যে সম্পর্ক থাকার কথা, রাজনৈতিক পরিবেশ যেমন থাকার কথা, তা নেই। রাজনৈতিক পরিবেশ মোটেও সুখকর নয়। অতীতে পারস্পরিক একটি ভালো সম্পর্ক ছিল। আওয়ামী লীগের আচরণ তো রাজনীতিসুলভ নয়। সুস্থ রাজনীতির পরিবেশ আওয়ামী লীগের কারণে নষ্ট হয়েছে। এই পরিবেশ ঠিক করার দায়িত্ব বর্তমান সরকারের। কারণ তারাই এটাকে কলুষিত করেছে। আমি আশাবাদী মানুষ। শত নিরাশার মধ্যেও আশার আলো দেখি। আমি আশা রাখি, একদিন সব প্রতিকূল পরিবেশ কেটে যাবে। যোগ্য নেতৃত্ব সব প্রতিকূলতা দূর করবে। বাংলাদেশের মানুষের জন্য একটি সোনালি ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে বলে আমি মনে করি।
কালের কণ্ঠ : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
আ স ম হান্নান শাহ : আপনাদেরও ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.