কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে আমার বাবাকে হত্যা করা হয়- যুদ্ধাপরাধী বিচার- সাক্ষী জিয়াউল ইসলামের সাক্ষ্য
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আটক জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন পক্ষের দশম সাক্ষী সৈয়দ আব্দুল কাইয়ুম তাঁর জবানবন্দীতে বলেন, আমি মারা গেছি মনে করে বাড়িতে আমার কুলখানিও হয়ে গিয়েছিল। সোমবার চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবিরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ সাক্ষী তার জবানবন্দী প্রদান করেন।
পরে এ মামলার কার্যক্রম আগামী ২৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মুলতবি করে আদালত। ওই দিন আসামি পক্ষের আইনজীবী সাক্ষীকে জেরা করবেন। অপরদিকে, মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আটক আরেক জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন পক্ষের ৭ম সাক্ষী লিয়াকত আলী ও ৮ম সাক্ষী মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউল ইসলাম তাদের জবানবন্দী পেশ করেছেন। লিয়াকত আলী তার জবানবন্দীতে বলেন, কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে আমার বাবাকে হত্যা করা হয়। ৮ম সাক্ষী জিয়াউল ইসলাম তার জবানবন্দীতে বলেন, আল বদর ক্যাম্পে আমাদের আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়।
কাদের মোল্লা
সাক্ষী সৈয়দ আব্দুল কাইয়ুম তার জবানবন্দীতে বলেন, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের পরে অসহযোগ আন্দোলনের কারণে দেশের সব স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে যায়। তখন আমরাও অসহযোগ আন্দোলন শুরু করি। ২৩ মার্চ ছিল পাকিস্তান প্রজাতন্ত্র দিবস। ওই দিন পাকিস্তান সরকারের নির্দেশে সারা পূর্ব পাকিস্তানের সব স্কুল-কলেজে পাকিস্তানী পতাকা উত্তোলন করলেও মিরপুরে পতাকা উত্তোলন করা হয়নি।
তিনি বলেন, ২৩ মার্চ আমার স্কুলের কয়েকজন ছাত্র স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে। ওই দিন রাতে আমি সাংবাদিক তালেব সাহেবের বাসায় টিভি দেখছিলাম। প্রতিদিন রাত সাড়ে ১১টায় টিভি বন্ধ হলেও ওই দিন বন্ধ করা হয় রাত ১২টায়। টিভি দেখার সময় আমরা অপেক্ষা করতে থাকি যে, প্রতিদিন পাকিস্তানের পতাকা দেখায়, আজকে কোন্টা দেখায়। দেখলাম পাকিস্তানের পতাকাই দেখাল।
সাক্ষী আব্দুল কাইয়ূম বলেন, ওইদিন রাতে আমাকে তিন-চারজন লোক আটকিয়ে জানতে চায় যে স্কুলে পতাকা উঠল কি করে। তাদের সঙ্গে কথা বলার সময় সঙ্গে থাকা একজন আমাকে ছুরিকাঘাত করতে চাইলে আমি ছুরিটি ধরে ফেলি, তাতে বাম হাতের আঙুল কেটে যায়। ওই অবস্থায় সাংবাদিক তালেব সাহেবের বাসার দিকে দৌড় দিই।
তিনি বলেন, ‘আমার চিৎকার শুনে পাশেই থাকা বাঙালী বাড়ি থেকে লোকজন বের হয়ে এলে তারা পালিয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আমাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে সুস্থ হয়ে গ্রামের বাড়ি চলে যাই। আমি মারা গেছি মনে করে বাড়িতে আমার কুলখানিও হয়ে গিয়েছিল।
সাক্ষী বলেন, ওই দিন রাতে শহীদ মিনারে বোমা ফাটানো হয়। বোমার শব্দে মেডিক্যালের খাটগুলোতেও ঝনঝন আওয়াজ হয়। অল্প কিছুক্ষণ পরেই মৃত-অর্ধমৃত মানুষে ভরে গেছে পুরো হাসপাতাল। সাক্ষী আব্দুল কাইয়ুম আসামি কাদের মোল্লাকে ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় শনাক্ত করেন।
কামারুজ্জামান ৭ম সাক্ষীর জবানবন্দী
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আটক জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন পক্ষের ৭ম সাক্ষী লিয়াকত আলী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ তার জবানবন্দী পেশ করেন। জবানবন্দীতে তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় শেরপুরে থাকাকালে আমি আলবদর ও পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ি। আমাকেসহ ৩ জনকে হত্যার উদ্দেশে লাইনে দাঁড় করানো হয়। কিন্তু গুলি করার আগমুহূর্তে পাকিস্তানী মেজরের নির্দেশে আমাদের হত্যা করা হয়নি। সে সময় আলবদর কমান্ডার কামারুজ্জামান ও কামরানকে দেখেছি।
লিয়াকত আলী বলেন, আমি তখন শেরপুরে থাকি। ঢাকায় যখন পাকিস্তানী সেনারা আক্রমণ করে, তখন আমরা তাদের প্রতিরোধ করার জন্য কালীহাতি, জামালপুর, শেরপুরে মুজাহিদ ও ইপিআর সদস্যদের নিয়ে ছাত্র সংগঠন যা ছিল তাদের নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য যাই। আমরা প্রতিরোধ গড়তে না পেরে ফিরে আসি। এরপর আমি ভারতের মেঘালয় রাজ্যের তুরা জেলার ঢালু ক্যাম্পে যাই। তিনি বলেন, সেখানে কিছুদিন থাকার পর আমার বড় ভাই আব্দুল্লাহ আমাকে সঙ্গে নিয়ে শেরপুরের নালিতাবাড়ীতে আসেন। সেখানে আমি একটি ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে পালিয়ে শেরপুরে চলে আসি। বড় ভাই কোথায় যান, জানতে পারিনি।
জবানবন্দীতে লিয়াকত আলী বলেন, শেরপুরে আমি যে বাসায় ছিলাম, সেখানে একদিন বিকেলে আলবদরের সদস্যরা ঘেরাও করে। তারা আমাকে ধরে নিয়ে বানথিয়া বিল্ডিংয়ের চিলেকোঠায় রাখে। সন্ধ্যার সময় দেখি, আলবদর বাহিনীর ছোট ক্যাম্প বানথিয়া বিল্ডিংয়ে মজিবুর ও ছাত্তার নামে আরও দু’জনকে ধরে নিয়ে আসে। রাত দশটার দিকে আমার পিতা অনেক কষ্ট করে জনৈক পুলিশ ইন্সপেক্টর কবির সাহেবকে দিয়ে আমাদের পুলিশ হেফাজতে নেবার ব্যবস্থা করেন। সাক্ষী বলেন, দু’দিন থানা হাজতে থাকার পর আমাদের আহমদনগর ক্যাম্পে চালান দেয় পুলিশ। তখন আমাদের ড্রাইভার সাবান আলী মিয়া ও অবাঙালী মোটরসাইকেল মেকানিক আলাউদ্দিন মিয়া আমাদের ছাড়ার অনুরোধ করলেও তারা আমাদের ছাড়েনি। তখন আমার দুলাভাই সড়ক ও জনপথ বিভাগের মেকানিক মন্টু মিয়া আহমদনগর ক্যাম্পের ওয়ারলেস অপারেটর জালালুদ্দিনকে ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দেন।
সাক্ষী বলেন, ঘটনার সময় একদিন পাকিস্তানী সেনারা আমাদের আনুমানিক দুপুর ১২টায় আহমদনগর ক্যাম্পের পাশে ইউনিয়ন পরিষদ অফিসের পাশে নিয়ে যান। সেখানে আর্মিরা আমাদের একটি লম্বা গর্তের মধ্যে দাঁড় করান। কিছুক্ষণ পর একজন ক্যাপ্টেন আমাদের কলেমা পড়িয়ে গুলি করে মারার নির্দেশ দেয়। সাক্ষী লিয়াকত আলী বলেন, এ সময় মেজর রিয়াজ কোথা থেকে এসে গুলি করা থামান। এরপর আমাদের তিনজনকে গর্ত থেকে ওপরে তোলা হয়। সেখান থেকে কিছুদূর আসার পর আমাদের চোখের বাঁধন খুলে দিলে সামনে দেখি কামরান। তার পেছনে কামারুজ্জামানকে দেখি বলে মনে হলো। তারপর তারা আমাদের ছেড়ে দেন। আমরা তখন শেরপুর চলে আসি। এরপর দেশ স্বাধীন হলো।
গত ১৫ জুলাই প্রথম সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন ১৯৭১ সালে ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি হামিদুল হক। ২য় সাক্ষী হিসেবে গত ২৬ জুলাই সাক্ষ্য দেন শেরপুরে কামারুজ্জামানের স্থাপন করা আলবদর ক্যাম্প ও নির্যাতন কেন্দ্রের দারোয়ান মনোয়ার হোসেন খান মোহন। ৩য় সাক্ষী বীর মুক্তিযোদ্ধা জহুরুল হক মুন্সী বীরপ্রতীক সাক্ষ্য দেন ১ আগস্ট। ৬ আগস্ট সাক্ষ্য দেন ৪র্থ সাক্ষী বীর মুক্তিযোদ্ধা ফকির আব্দুল মান্নান। ৫ম সাক্ষী মুক্তিযুদ্ধের শহীদ গোলাম মোস্তফা হোসেন তালুকদারের ছোট ভাই মোশাররফ হোসেন তালুকদার সাক্ষ্য দেন ২৯ আগস্ট। ৩ সেপ্টেম্বর সাক্ষ্য দেন ৬ষ্ঠ সাক্ষী শহীদ মুক্তিযোদ্ধা বদিউজ্জামানের বড় ভাই ডা. মোঃ হাসানুজ্জামান।
কামারুজ্জামান ৮ম সাক্ষীর জাবনবন্দী
কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন পক্ষের ৮ম সাক্ষী জিয়াউল ইসলাম তাঁর সাক্ষ্যে বলেন, এপ্রিল মাসে ময়মনসিংহ ইপিআর ক্যাম্পে অবস্থানরত অবাঙালীদের হত্যা করে ময়মনসিংহকে শত্রুমুক্ত করি। রসুলপুর ও মুক্তাগাছা থানার অর্ন্তগত কাউরাইত এলাকায় পাকিস্তানী সেনাদের সঙ্গে প্রতিরোধযুদ্ধে মুখোমুখি হই। পরের দিনই পাকিস্তানী সেনারা ময়মনসিংহ দখল করে। ওই সময় আমার বাবা-মা গ্রামে চলে গেলেও আমি শহরে থেকে যাই। পাকিস্তানী সেনারা শহরে ঢোকার পর আমি ভারতে চলে যাই। আমার বাবার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ নয় মাস কোন যোগাযোগ ছিল না। একাত্তর সালের ১০ সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহ শহর মুক্ত করি। তিনি বলেন, ভারত থেকে আসার পথে হালুয়াঘাটে এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়। আমার বাবাকে পাকিস্তানী সেনারা মেরে ফেলেছে বলে তিনি জানান। এরপর আমার মার কাছে জানান, তুই মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার পর তোর সম্পর্কে শান্তিবাহিনীর লোকজন খোঁজখবর দিতে তোর বাবাকে চাপ দেয়।
তিনি বলেন, ময়মনসিংহের কোতোয়ালি থানায় অবস্থিত ডাকবাংলোতে আলবদর বাহিনীর ক্যাম্প ছিল। কামারুজ্জামানের নির্দেশেই আমার বাবাকে হত্যা করা হয়। বাবাকে বড় মসজিদের ইমাম সাহেবের ছেলে রব্বানী ধরে নিয়ে যান। তাঁকে জিজ্ঞেস করলে তিনিও বলেন, কামারুজ্জামানের নির্দেশেই ধরে নেয়া হয়। ক্যাম্পের লোকজন জানান, কামারুজ্জামানের হুকুম ছাড়া তাকে ছাড়া যাবে না। আত্মীয়স্বজনরা যোগাযোগ করলে ছেড়ে দেবেন বলে আশ্বাস দেন।
তিনি বলেন, একাত্তর সালে ২৩ নবেম্বর ময়মনসিংহ শহর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে বাবরা ইউনিয়ন পরিষদের বাবেরাখালের পাশে আমার বাবা এবং অন্য একজন যাকে কেনেডী বলে ডাকতো, তাদের বেয়নেট দিয়ে হত্যা করে। পরের দিন স্থানীয় লোকজন বাবার লাশ দেখে চিনতে পারেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আমাদের একটা চিঠি এবং আর্থিক সাহায্য দেন। আমাদের সংসারের অবস্থা ভাল ছিল না, বিধায় মামলা করতে পারিনি। এরপর সাক্ষী আসামির ডকে থাকা আসামি কামারুজ্জামানকে শনাক্ত করেন। পরে এ মামলার কার্যক্রম ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মুলতবি করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল- ২।
কাদের মোল্লা
সাক্ষী সৈয়দ আব্দুল কাইয়ুম তার জবানবন্দীতে বলেন, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের পরে অসহযোগ আন্দোলনের কারণে দেশের সব স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে যায়। তখন আমরাও অসহযোগ আন্দোলন শুরু করি। ২৩ মার্চ ছিল পাকিস্তান প্রজাতন্ত্র দিবস। ওই দিন পাকিস্তান সরকারের নির্দেশে সারা পূর্ব পাকিস্তানের সব স্কুল-কলেজে পাকিস্তানী পতাকা উত্তোলন করলেও মিরপুরে পতাকা উত্তোলন করা হয়নি।
তিনি বলেন, ২৩ মার্চ আমার স্কুলের কয়েকজন ছাত্র স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে। ওই দিন রাতে আমি সাংবাদিক তালেব সাহেবের বাসায় টিভি দেখছিলাম। প্রতিদিন রাত সাড়ে ১১টায় টিভি বন্ধ হলেও ওই দিন বন্ধ করা হয় রাত ১২টায়। টিভি দেখার সময় আমরা অপেক্ষা করতে থাকি যে, প্রতিদিন পাকিস্তানের পতাকা দেখায়, আজকে কোন্টা দেখায়। দেখলাম পাকিস্তানের পতাকাই দেখাল।
সাক্ষী আব্দুল কাইয়ূম বলেন, ওইদিন রাতে আমাকে তিন-চারজন লোক আটকিয়ে জানতে চায় যে স্কুলে পতাকা উঠল কি করে। তাদের সঙ্গে কথা বলার সময় সঙ্গে থাকা একজন আমাকে ছুরিকাঘাত করতে চাইলে আমি ছুরিটি ধরে ফেলি, তাতে বাম হাতের আঙুল কেটে যায়। ওই অবস্থায় সাংবাদিক তালেব সাহেবের বাসার দিকে দৌড় দিই।
তিনি বলেন, ‘আমার চিৎকার শুনে পাশেই থাকা বাঙালী বাড়ি থেকে লোকজন বের হয়ে এলে তারা পালিয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আমাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে সুস্থ হয়ে গ্রামের বাড়ি চলে যাই। আমি মারা গেছি মনে করে বাড়িতে আমার কুলখানিও হয়ে গিয়েছিল।
সাক্ষী বলেন, ওই দিন রাতে শহীদ মিনারে বোমা ফাটানো হয়। বোমার শব্দে মেডিক্যালের খাটগুলোতেও ঝনঝন আওয়াজ হয়। অল্প কিছুক্ষণ পরেই মৃত-অর্ধমৃত মানুষে ভরে গেছে পুরো হাসপাতাল। সাক্ষী আব্দুল কাইয়ুম আসামি কাদের মোল্লাকে ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় শনাক্ত করেন।
কামারুজ্জামান ৭ম সাক্ষীর জবানবন্দী
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আটক জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন পক্ষের ৭ম সাক্ষী লিয়াকত আলী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ তার জবানবন্দী পেশ করেন। জবানবন্দীতে তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় শেরপুরে থাকাকালে আমি আলবদর ও পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ি। আমাকেসহ ৩ জনকে হত্যার উদ্দেশে লাইনে দাঁড় করানো হয়। কিন্তু গুলি করার আগমুহূর্তে পাকিস্তানী মেজরের নির্দেশে আমাদের হত্যা করা হয়নি। সে সময় আলবদর কমান্ডার কামারুজ্জামান ও কামরানকে দেখেছি।
লিয়াকত আলী বলেন, আমি তখন শেরপুরে থাকি। ঢাকায় যখন পাকিস্তানী সেনারা আক্রমণ করে, তখন আমরা তাদের প্রতিরোধ করার জন্য কালীহাতি, জামালপুর, শেরপুরে মুজাহিদ ও ইপিআর সদস্যদের নিয়ে ছাত্র সংগঠন যা ছিল তাদের নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য যাই। আমরা প্রতিরোধ গড়তে না পেরে ফিরে আসি। এরপর আমি ভারতের মেঘালয় রাজ্যের তুরা জেলার ঢালু ক্যাম্পে যাই। তিনি বলেন, সেখানে কিছুদিন থাকার পর আমার বড় ভাই আব্দুল্লাহ আমাকে সঙ্গে নিয়ে শেরপুরের নালিতাবাড়ীতে আসেন। সেখানে আমি একটি ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে পালিয়ে শেরপুরে চলে আসি। বড় ভাই কোথায় যান, জানতে পারিনি।
জবানবন্দীতে লিয়াকত আলী বলেন, শেরপুরে আমি যে বাসায় ছিলাম, সেখানে একদিন বিকেলে আলবদরের সদস্যরা ঘেরাও করে। তারা আমাকে ধরে নিয়ে বানথিয়া বিল্ডিংয়ের চিলেকোঠায় রাখে। সন্ধ্যার সময় দেখি, আলবদর বাহিনীর ছোট ক্যাম্প বানথিয়া বিল্ডিংয়ে মজিবুর ও ছাত্তার নামে আরও দু’জনকে ধরে নিয়ে আসে। রাত দশটার দিকে আমার পিতা অনেক কষ্ট করে জনৈক পুলিশ ইন্সপেক্টর কবির সাহেবকে দিয়ে আমাদের পুলিশ হেফাজতে নেবার ব্যবস্থা করেন। সাক্ষী বলেন, দু’দিন থানা হাজতে থাকার পর আমাদের আহমদনগর ক্যাম্পে চালান দেয় পুলিশ। তখন আমাদের ড্রাইভার সাবান আলী মিয়া ও অবাঙালী মোটরসাইকেল মেকানিক আলাউদ্দিন মিয়া আমাদের ছাড়ার অনুরোধ করলেও তারা আমাদের ছাড়েনি। তখন আমার দুলাভাই সড়ক ও জনপথ বিভাগের মেকানিক মন্টু মিয়া আহমদনগর ক্যাম্পের ওয়ারলেস অপারেটর জালালুদ্দিনকে ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দেন।
সাক্ষী বলেন, ঘটনার সময় একদিন পাকিস্তানী সেনারা আমাদের আনুমানিক দুপুর ১২টায় আহমদনগর ক্যাম্পের পাশে ইউনিয়ন পরিষদ অফিসের পাশে নিয়ে যান। সেখানে আর্মিরা আমাদের একটি লম্বা গর্তের মধ্যে দাঁড় করান। কিছুক্ষণ পর একজন ক্যাপ্টেন আমাদের কলেমা পড়িয়ে গুলি করে মারার নির্দেশ দেয়। সাক্ষী লিয়াকত আলী বলেন, এ সময় মেজর রিয়াজ কোথা থেকে এসে গুলি করা থামান। এরপর আমাদের তিনজনকে গর্ত থেকে ওপরে তোলা হয়। সেখান থেকে কিছুদূর আসার পর আমাদের চোখের বাঁধন খুলে দিলে সামনে দেখি কামরান। তার পেছনে কামারুজ্জামানকে দেখি বলে মনে হলো। তারপর তারা আমাদের ছেড়ে দেন। আমরা তখন শেরপুর চলে আসি। এরপর দেশ স্বাধীন হলো।
গত ১৫ জুলাই প্রথম সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন ১৯৭১ সালে ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি হামিদুল হক। ২য় সাক্ষী হিসেবে গত ২৬ জুলাই সাক্ষ্য দেন শেরপুরে কামারুজ্জামানের স্থাপন করা আলবদর ক্যাম্প ও নির্যাতন কেন্দ্রের দারোয়ান মনোয়ার হোসেন খান মোহন। ৩য় সাক্ষী বীর মুক্তিযোদ্ধা জহুরুল হক মুন্সী বীরপ্রতীক সাক্ষ্য দেন ১ আগস্ট। ৬ আগস্ট সাক্ষ্য দেন ৪র্থ সাক্ষী বীর মুক্তিযোদ্ধা ফকির আব্দুল মান্নান। ৫ম সাক্ষী মুক্তিযুদ্ধের শহীদ গোলাম মোস্তফা হোসেন তালুকদারের ছোট ভাই মোশাররফ হোসেন তালুকদার সাক্ষ্য দেন ২৯ আগস্ট। ৩ সেপ্টেম্বর সাক্ষ্য দেন ৬ষ্ঠ সাক্ষী শহীদ মুক্তিযোদ্ধা বদিউজ্জামানের বড় ভাই ডা. মোঃ হাসানুজ্জামান।
কামারুজ্জামান ৮ম সাক্ষীর জাবনবন্দী
কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন পক্ষের ৮ম সাক্ষী জিয়াউল ইসলাম তাঁর সাক্ষ্যে বলেন, এপ্রিল মাসে ময়মনসিংহ ইপিআর ক্যাম্পে অবস্থানরত অবাঙালীদের হত্যা করে ময়মনসিংহকে শত্রুমুক্ত করি। রসুলপুর ও মুক্তাগাছা থানার অর্ন্তগত কাউরাইত এলাকায় পাকিস্তানী সেনাদের সঙ্গে প্রতিরোধযুদ্ধে মুখোমুখি হই। পরের দিনই পাকিস্তানী সেনারা ময়মনসিংহ দখল করে। ওই সময় আমার বাবা-মা গ্রামে চলে গেলেও আমি শহরে থেকে যাই। পাকিস্তানী সেনারা শহরে ঢোকার পর আমি ভারতে চলে যাই। আমার বাবার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ নয় মাস কোন যোগাযোগ ছিল না। একাত্তর সালের ১০ সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহ শহর মুক্ত করি। তিনি বলেন, ভারত থেকে আসার পথে হালুয়াঘাটে এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়। আমার বাবাকে পাকিস্তানী সেনারা মেরে ফেলেছে বলে তিনি জানান। এরপর আমার মার কাছে জানান, তুই মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার পর তোর সম্পর্কে শান্তিবাহিনীর লোকজন খোঁজখবর দিতে তোর বাবাকে চাপ দেয়।
তিনি বলেন, ময়মনসিংহের কোতোয়ালি থানায় অবস্থিত ডাকবাংলোতে আলবদর বাহিনীর ক্যাম্প ছিল। কামারুজ্জামানের নির্দেশেই আমার বাবাকে হত্যা করা হয়। বাবাকে বড় মসজিদের ইমাম সাহেবের ছেলে রব্বানী ধরে নিয়ে যান। তাঁকে জিজ্ঞেস করলে তিনিও বলেন, কামারুজ্জামানের নির্দেশেই ধরে নেয়া হয়। ক্যাম্পের লোকজন জানান, কামারুজ্জামানের হুকুম ছাড়া তাকে ছাড়া যাবে না। আত্মীয়স্বজনরা যোগাযোগ করলে ছেড়ে দেবেন বলে আশ্বাস দেন।
তিনি বলেন, একাত্তর সালে ২৩ নবেম্বর ময়মনসিংহ শহর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে বাবরা ইউনিয়ন পরিষদের বাবেরাখালের পাশে আমার বাবা এবং অন্য একজন যাকে কেনেডী বলে ডাকতো, তাদের বেয়নেট দিয়ে হত্যা করে। পরের দিন স্থানীয় লোকজন বাবার লাশ দেখে চিনতে পারেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আমাদের একটা চিঠি এবং আর্থিক সাহায্য দেন। আমাদের সংসারের অবস্থা ভাল ছিল না, বিধায় মামলা করতে পারিনি। এরপর সাক্ষী আসামির ডকে থাকা আসামি কামারুজ্জামানকে শনাক্ত করেন। পরে এ মামলার কার্যক্রম ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মুলতবি করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল- ২।
No comments