দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়কের অধীনে হতে বাধা নেই by মিজানুর রহমান খান
অস্বচ্ছতা, অস্পষ্টতা এমনকি স্ববিরোধিতা সত্ত্বেও সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী, আগামী দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন হতে পারে। আদালত আক্ষরিক অর্থে বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করেননি। আবার সংসদ সিদ্ধান্ত নিলে তাঁরা বাধাও তৈরি করেননি।
বরং বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য এড়াতে দুই মেয়াদে নির্বাচন করার পথ সুগম করেছেন।
সার্বিক বিচারে সাতজন বিচারপতির একটি অভিন্ন অবস্থান হিসেবে দাবি করা চলে যে, তাঁরা প্রত্যেকে যেন অন্তত এটুকু একমত হয়েছেন, জাতীয় সংসদ চাইলে আগামী দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানে তাঁদের কোনো আপত্তি থাকবে না।
তবে বিচারপতি খায়রুল হকের মূল আদেশে দুই মেয়াদের বিষয়টি নেই বলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম গত রোববার যে মত দিয়েছেন, তা তথ্যভিত্তিক নয়। ২০১১ সালের ১০ মে ঘোষিত সংক্ষিপ্ত আদেশে একটি শর্তে আগামী দুটি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে বলে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকেরা মত দিয়েছিলেন। কিন্তু ওই সংক্ষিপ্ত আদেশে পূর্ণাঙ্গ রায়দানকারী সাত বিচারকের মধ্যে কতজন মিলে সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং কতজন মিলে সংখ্যালঘু ছিলেন, তা প্রকাশ করা হয়নি। এবার প্রথম জানা গেল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী মনে করেন বিচারপতি খায়রুল হক এবং আপিল বিভাগের তিন বিচারপতি।
অন্যদিকে সংখ্যালঘুর রায়দানকারী তিন বিচারপতির মধ্যে দুজন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে সংবিধানসম্মত মনে করেন। অন্যজন তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অবৈধ ও সংবিধানসম্মত বলে মনে করলেও সম্পূর্ণ ভিন্নমত পোষণ করেছেন। তাঁর কথায় কার্যত সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ ব্যক্তিগতভাবে অভিযুক্ত হয়েছেন। তাঁর যুক্তি, ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ তৎকালীন ত্রয়োদশ সংশোধনীর অধীনে তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেননি। আর সে কারণেই বিদ্যমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়েছে। আর এ বিষয়ে জাতীয় সংসদই উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে পারে। বিচারপতি মো. ইমান আলীর ওই অভিমতের প্রথম অংশের সঙ্গে সংখ্যালঘু রায়ের মূল লেখক বিচারপতি মো. ওয়াহাব মিঞা একমত পোষণ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘বিচারপতি ইমান আলী তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে যথার্থই সংবিধানসম্মত বলেছেন। কিন্তু এ ব্যবস্থা শুধু একজন রাষ্ট্রপতির কারণে অকার্যকর হয়ে পড়েছে বলে যে মত তিনি রেখেছেন, তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করি।’
উল্লেখ্য, মূল রায়ের লেখক বিচারপতি খায়রুল হকের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেও আলাদা রায় লিখেছেন বিচারপতি এস কে সিনহা। প্রধান বিচারপতি ও বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন শুধু একবাক্যে বিচারপতি খায়রুল হকের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছেন। অন্যদিকে বিচারপতি ওয়াহাব মিঞার রায়ের সঙ্গে একবাক্যে একাত্ম হয়েছেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা।
তিন শর্ত: তবে এখন দেখা যাচ্ছে, মূল রায়দানকারী বিচারপতি খায়রুল হক তিন শর্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দুই মেয়াদে নির্বাচনের কথা বলেছেন। শর্তগুলো হলো: ১. জাতীয় সংসদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় বাংলাদেশের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি বা আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের বাদ দেওয়ার জন্য আইন প্রণয়ন করতে পারে, কারণ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার স্বার্থে তাঁদের সম্পৃক্ত করা বাঞ্ছনীয় নয়। ২. তত্ত্বাবধায়ক সরকার শুধু জনগণের নির্বাচিত সাংসদদের দ্বারা গঠিত হতে পারে। কারণ, জনগণের সার্বভৌমত্ব ও ক্ষমতায়ন, গণতন্ত্র, প্রজাতান্ত্রিকতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের মৌলিক কাঠামো এবং এই রায়ে ওই বিষয়গুলোর ওপর সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে; ৩. ওপরে বর্ণিত নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলেও বহাল থাকবে।
২০১১ সালে সংক্ষিপ্ত আদেশে শুধু প্রথম শর্তটি ছিল। এবার দুটি নতুন শর্ত যুক্ত করা হয়েছে। ‘নির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের’ শর্তটি যুক্ত করায় বিচারপতি ওয়াহাব মিঞা উষ্মা প্রকাশ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘এই শর্তটি সংক্ষিপ্ত আদেশের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।’ অনেক আইনবিদ মনে করেন, পূর্ণাঙ্গ রায়ে এ রকম মৌলিক পরিবর্তন নজিরবিহীন। এটা গুরুতর বিচারিক বিচ্যুতি। এ ধরনের বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে রিভিউ হতে পারে।
দুই আদেশের পার্থক্য: অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম গত রোববার রাতে সুপ্রিম কোর্টে সাংবাদিকদের বলেন, বিচারপতি খায়রুল হকের লেখা পূর্ণাঙ্গ রায়ের চূড়ান্ত আদেশ অংশে দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধানের কথা উল্লেখ করা হয়নি।
এখানে স্মরণ করা প্রয়োজন, গত বছরের মে মাসে সংক্ষিপ্ত আদেশ প্রচারিত হওয়ার পর অ্যাটর্নি জেনারেলসহ আওয়ামী লীগ-সমর্থিত আইনবিদ ও আইনজীবীরা অবিটার ডিক্টা বা পর্যবেক্ষণ নামে একটি শব্দ ব্যবহার করেছিলেন। তাঁরা আরও দেখিয়েছিলেন, দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করার ক্ষেত্রে ‘শ্যাল’ নয় ‘মে’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। তাই এটা বাধ্যকর নয়।
অ্যাটর্নি জেনারেল এখন বলছেন যে, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইতিমধ্যে বাতিল হয়ে গেছে। তাই এ বিষয়টি একাডেমিক অর্থাৎ কার্যকারিতা হারিয়েছে।’ তাঁর এই বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়ের এ-সংক্রান্ত নির্দেশনা আগামী দুই মেয়াদে বৈধ হিসেবে গণ্য হবে।
ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের রায় আছে যে, ‘পর্যবেক্ষণ বা অবিটার ডিক্টা যখন সর্বোচ্চ আদালত থেকে আসবে তখন তাকে সুউচ্চ মর্যাদা দিতে হবে।’ এ ক্ষেত্রে এটা মেনে চলা বাধ্যকর বলে মনে করা হবে। যদি হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ হয়, তখন তা মানা বা না মানা ঐচ্ছিক। আলোচ্য ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ রায়ে তিন শর্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের যে বিধান রাখা হয়েছে, তাকে বাধ্যকর হিসেবে বিবেচনা করাটাই হবে সমীচীন ও প্রত্যাশিত। অ্যাটর্নি জেনারেল যেভাবে একতরফা বাধ্যকর নয় বলে মত দিচ্ছেন, তাতে কার্যত আংশিক সত্যের প্রতিফলন ঘটছে।
সংসদ ভেঙে দেওয়া: সংসদ ভেঙে না দিয়ে ২০১৪ সালের ২৪ জানুয়ারির পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। সেই থেকে বিরোধী দল সংসদ ভেঙে দেওয়ার পক্ষেই মত দিচ্ছে। বিচারপতি খায়রুল হক তাঁর ১৬ দফা আদেশের ১২ দফায় উল্লেখ করেছেন, ‘সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে, জাতীয় সংসদের বিবেচনা (ডিস্ক্রিশন) অনুসারে যুক্তিসংগতকাল পূর্বে যথা, ৪২ দিন পূর্বে, সংসদ ভেঙে দেওয়া বাঞ্ছনীয় হবে। তবে, নির্বাচন-পরবর্তী নতুন মন্ত্রিসভা কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত পূর্ববর্তী মন্ত্রিসভা সংক্ষিপ্ত আকার গ্রহণ করত উক্ত সময়ের জন্য রাষ্ট্রের স্বাভাবিক ও সাধারণ কার্যক্রম পরিচালনা করবে।’
অনেকে বলছেন, এই বিধান যুক্ত করার ফলে এক ঢিলে দুই পাখি মারা সম্ভব হয়েছে। প্রতীয়মান হবে যে, প্রধানমন্ত্রী যেখানে সংসদ রেখে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছেন, বিচারপতি খায়রুল হক সেখানে তাঁর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। ৪২ দিন আগে সংসদ ভেঙে দিতে বলেছেন। এটা অবশ্য একটা কথার কথা। শুধু উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
আদেশে আছে কি নেই: অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম রোববার সাত বিচারপতির সই করার পরপরই সুপ্রিম কোর্টে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের বলেন, মূল আদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার কথা বলা নেই। অথচ তাঁর এই ব্যাখ্যা যথাযথ নয়। কারণ, বিচারপতি খায়রুল হক তাঁর ৪৫ দফায় আদেশ শিরোনামে নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, ‘ইহা ছাড়াও উপরে ৪৪ দফায় বর্ণিত নির্দেশাবলী প্রদান করা হইল।’ আর ৪৪ দফার ১৩ দফায় বলা হয়েছে, ‘ত্রয়োদশ সংশোধনী অসাংবিধানিক ও অবৈধ হলেও জাতীয় সংসদের বিবেচনা ও সিদ্ধান্ত অনুসারে উপরে বর্ণিত নির্দেশাবলী সাপেক্ষে দশম ও একাদশ সাধারণ নির্বাচনকালীন প্রয়োজনমতো নতুনভাবে ও আঙ্গিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে।’ সুতরাং স্পষ্টতই এ বিষয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান রয়েছে। অপর তিন বিচারপতিও ওই ১৩ দফার সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছেন।
এখানে ‘উপরে বর্ণিত নির্দেশাবলী’ হিসেবে বিচারপতি খায়রুল লিখেছেন, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ অ্যামিকাস কিউরিগণ কোনো না কোনো আকারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বজায় রাখিবার পক্ষে মত প্রকাশ করিয়াছেন। তাঁহাদের আশঙ্কা, নির্বাচনকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে দেশে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হইতে পারে। তাঁহারা সকলেই দায়িত্বশীল ব্যক্তি। তাঁহাদের আশঙ্কা, আমরা একেবারে অবহেলা করিতে পারি না। তবুও এইরূপ আশঙ্কার কারণে সহস্র বৎসরের পুরাতন Latin Maxim, যেমন, Id Quod Alias Non Est Licitum, Necessitas Licitum Facit (That which otherwise is not lawful, necessity makes lawful), এর অর্থ হলো যা বৈধ নয় প্রয়োজন তাকে বৈধতা দেয়। Salus Populi Est Suprema Lex (Safety of the people is the supreme law) এর অর্থ জননিরাপত্তাই সর্বোচ্চ আইন এবং Salus Republicae Est Suprema Lex (Safety of the State is the Supreme law) এর অর্থ রাষ্ট্রনিরাপত্তাই সর্বোচ্চ আইন, ইহার সহায়তা লইতে হইল।
উপরোক্ত নীতিসমূহের আলোকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সাময়িকভাবে শুধুমাত্র পরবর্তী দুই সাধারণ নির্বাচনের ক্ষেত্রে থাকিবে কি না, সে সম্বন্ধে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র জনগণের প্রতিনিধি জাতীয় সংসদ লইতে পারে।
উক্ত সময়ের মধ্যে সংশ্লিষ্ট সকলেই নিজ নিজ কর্তব্য সঠিকরূপে পালন করিতে সম্পূর্ণ সজাগ ও পরিপূর্ণ দায়িত্বশীল হইবেন বলিয়া আশা করা যায়।
এইরূপ অসাধারণ পরিস্থিতির কারণে উপরোক্ত সহস্র বৎসরের পুরাতন ল্যাতিন প্রবাদ প্রয়োগ করত তর্কিত সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধন) আইন, ১৯৯৬, অবৈধ হওয়া সত্ত্বেও আগামী দশম ও একাদশ সর্বোচ্চ এই দুটি সাধারণ নির্বাচন জাতীয় সংসদের বিবেচনা অনুসারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীনে হইতে পারে।’
সার্বিক বিচারে সাতজন বিচারপতির একটি অভিন্ন অবস্থান হিসেবে দাবি করা চলে যে, তাঁরা প্রত্যেকে যেন অন্তত এটুকু একমত হয়েছেন, জাতীয় সংসদ চাইলে আগামী দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানে তাঁদের কোনো আপত্তি থাকবে না।
তবে বিচারপতি খায়রুল হকের মূল আদেশে দুই মেয়াদের বিষয়টি নেই বলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম গত রোববার যে মত দিয়েছেন, তা তথ্যভিত্তিক নয়। ২০১১ সালের ১০ মে ঘোষিত সংক্ষিপ্ত আদেশে একটি শর্তে আগামী দুটি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে বলে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকেরা মত দিয়েছিলেন। কিন্তু ওই সংক্ষিপ্ত আদেশে পূর্ণাঙ্গ রায়দানকারী সাত বিচারকের মধ্যে কতজন মিলে সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং কতজন মিলে সংখ্যালঘু ছিলেন, তা প্রকাশ করা হয়নি। এবার প্রথম জানা গেল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী মনে করেন বিচারপতি খায়রুল হক এবং আপিল বিভাগের তিন বিচারপতি।
অন্যদিকে সংখ্যালঘুর রায়দানকারী তিন বিচারপতির মধ্যে দুজন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে সংবিধানসম্মত মনে করেন। অন্যজন তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অবৈধ ও সংবিধানসম্মত বলে মনে করলেও সম্পূর্ণ ভিন্নমত পোষণ করেছেন। তাঁর কথায় কার্যত সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ ব্যক্তিগতভাবে অভিযুক্ত হয়েছেন। তাঁর যুক্তি, ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ তৎকালীন ত্রয়োদশ সংশোধনীর অধীনে তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেননি। আর সে কারণেই বিদ্যমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়েছে। আর এ বিষয়ে জাতীয় সংসদই উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে পারে। বিচারপতি মো. ইমান আলীর ওই অভিমতের প্রথম অংশের সঙ্গে সংখ্যালঘু রায়ের মূল লেখক বিচারপতি মো. ওয়াহাব মিঞা একমত পোষণ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘বিচারপতি ইমান আলী তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে যথার্থই সংবিধানসম্মত বলেছেন। কিন্তু এ ব্যবস্থা শুধু একজন রাষ্ট্রপতির কারণে অকার্যকর হয়ে পড়েছে বলে যে মত তিনি রেখেছেন, তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করি।’
উল্লেখ্য, মূল রায়ের লেখক বিচারপতি খায়রুল হকের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেও আলাদা রায় লিখেছেন বিচারপতি এস কে সিনহা। প্রধান বিচারপতি ও বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন শুধু একবাক্যে বিচারপতি খায়রুল হকের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছেন। অন্যদিকে বিচারপতি ওয়াহাব মিঞার রায়ের সঙ্গে একবাক্যে একাত্ম হয়েছেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা।
তিন শর্ত: তবে এখন দেখা যাচ্ছে, মূল রায়দানকারী বিচারপতি খায়রুল হক তিন শর্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দুই মেয়াদে নির্বাচনের কথা বলেছেন। শর্তগুলো হলো: ১. জাতীয় সংসদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় বাংলাদেশের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি বা আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের বাদ দেওয়ার জন্য আইন প্রণয়ন করতে পারে, কারণ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার স্বার্থে তাঁদের সম্পৃক্ত করা বাঞ্ছনীয় নয়। ২. তত্ত্বাবধায়ক সরকার শুধু জনগণের নির্বাচিত সাংসদদের দ্বারা গঠিত হতে পারে। কারণ, জনগণের সার্বভৌমত্ব ও ক্ষমতায়ন, গণতন্ত্র, প্রজাতান্ত্রিকতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের মৌলিক কাঠামো এবং এই রায়ে ওই বিষয়গুলোর ওপর সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে; ৩. ওপরে বর্ণিত নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলেও বহাল থাকবে।
২০১১ সালে সংক্ষিপ্ত আদেশে শুধু প্রথম শর্তটি ছিল। এবার দুটি নতুন শর্ত যুক্ত করা হয়েছে। ‘নির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের’ শর্তটি যুক্ত করায় বিচারপতি ওয়াহাব মিঞা উষ্মা প্রকাশ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘এই শর্তটি সংক্ষিপ্ত আদেশের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।’ অনেক আইনবিদ মনে করেন, পূর্ণাঙ্গ রায়ে এ রকম মৌলিক পরিবর্তন নজিরবিহীন। এটা গুরুতর বিচারিক বিচ্যুতি। এ ধরনের বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে রিভিউ হতে পারে।
দুই আদেশের পার্থক্য: অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম গত রোববার রাতে সুপ্রিম কোর্টে সাংবাদিকদের বলেন, বিচারপতি খায়রুল হকের লেখা পূর্ণাঙ্গ রায়ের চূড়ান্ত আদেশ অংশে দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধানের কথা উল্লেখ করা হয়নি।
এখানে স্মরণ করা প্রয়োজন, গত বছরের মে মাসে সংক্ষিপ্ত আদেশ প্রচারিত হওয়ার পর অ্যাটর্নি জেনারেলসহ আওয়ামী লীগ-সমর্থিত আইনবিদ ও আইনজীবীরা অবিটার ডিক্টা বা পর্যবেক্ষণ নামে একটি শব্দ ব্যবহার করেছিলেন। তাঁরা আরও দেখিয়েছিলেন, দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করার ক্ষেত্রে ‘শ্যাল’ নয় ‘মে’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। তাই এটা বাধ্যকর নয়।
অ্যাটর্নি জেনারেল এখন বলছেন যে, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইতিমধ্যে বাতিল হয়ে গেছে। তাই এ বিষয়টি একাডেমিক অর্থাৎ কার্যকারিতা হারিয়েছে।’ তাঁর এই বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়ের এ-সংক্রান্ত নির্দেশনা আগামী দুই মেয়াদে বৈধ হিসেবে গণ্য হবে।
ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের রায় আছে যে, ‘পর্যবেক্ষণ বা অবিটার ডিক্টা যখন সর্বোচ্চ আদালত থেকে আসবে তখন তাকে সুউচ্চ মর্যাদা দিতে হবে।’ এ ক্ষেত্রে এটা মেনে চলা বাধ্যকর বলে মনে করা হবে। যদি হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ হয়, তখন তা মানা বা না মানা ঐচ্ছিক। আলোচ্য ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ রায়ে তিন শর্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের যে বিধান রাখা হয়েছে, তাকে বাধ্যকর হিসেবে বিবেচনা করাটাই হবে সমীচীন ও প্রত্যাশিত। অ্যাটর্নি জেনারেল যেভাবে একতরফা বাধ্যকর নয় বলে মত দিচ্ছেন, তাতে কার্যত আংশিক সত্যের প্রতিফলন ঘটছে।
সংসদ ভেঙে দেওয়া: সংসদ ভেঙে না দিয়ে ২০১৪ সালের ২৪ জানুয়ারির পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। সেই থেকে বিরোধী দল সংসদ ভেঙে দেওয়ার পক্ষেই মত দিচ্ছে। বিচারপতি খায়রুল হক তাঁর ১৬ দফা আদেশের ১২ দফায় উল্লেখ করেছেন, ‘সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে, জাতীয় সংসদের বিবেচনা (ডিস্ক্রিশন) অনুসারে যুক্তিসংগতকাল পূর্বে যথা, ৪২ দিন পূর্বে, সংসদ ভেঙে দেওয়া বাঞ্ছনীয় হবে। তবে, নির্বাচন-পরবর্তী নতুন মন্ত্রিসভা কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত পূর্ববর্তী মন্ত্রিসভা সংক্ষিপ্ত আকার গ্রহণ করত উক্ত সময়ের জন্য রাষ্ট্রের স্বাভাবিক ও সাধারণ কার্যক্রম পরিচালনা করবে।’
অনেকে বলছেন, এই বিধান যুক্ত করার ফলে এক ঢিলে দুই পাখি মারা সম্ভব হয়েছে। প্রতীয়মান হবে যে, প্রধানমন্ত্রী যেখানে সংসদ রেখে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছেন, বিচারপতি খায়রুল হক সেখানে তাঁর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। ৪২ দিন আগে সংসদ ভেঙে দিতে বলেছেন। এটা অবশ্য একটা কথার কথা। শুধু উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
আদেশে আছে কি নেই: অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম রোববার সাত বিচারপতির সই করার পরপরই সুপ্রিম কোর্টে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের বলেন, মূল আদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার কথা বলা নেই। অথচ তাঁর এই ব্যাখ্যা যথাযথ নয়। কারণ, বিচারপতি খায়রুল হক তাঁর ৪৫ দফায় আদেশ শিরোনামে নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, ‘ইহা ছাড়াও উপরে ৪৪ দফায় বর্ণিত নির্দেশাবলী প্রদান করা হইল।’ আর ৪৪ দফার ১৩ দফায় বলা হয়েছে, ‘ত্রয়োদশ সংশোধনী অসাংবিধানিক ও অবৈধ হলেও জাতীয় সংসদের বিবেচনা ও সিদ্ধান্ত অনুসারে উপরে বর্ণিত নির্দেশাবলী সাপেক্ষে দশম ও একাদশ সাধারণ নির্বাচনকালীন প্রয়োজনমতো নতুনভাবে ও আঙ্গিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে।’ সুতরাং স্পষ্টতই এ বিষয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান রয়েছে। অপর তিন বিচারপতিও ওই ১৩ দফার সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছেন।
এখানে ‘উপরে বর্ণিত নির্দেশাবলী’ হিসেবে বিচারপতি খায়রুল লিখেছেন, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ অ্যামিকাস কিউরিগণ কোনো না কোনো আকারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বজায় রাখিবার পক্ষে মত প্রকাশ করিয়াছেন। তাঁহাদের আশঙ্কা, নির্বাচনকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে দেশে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হইতে পারে। তাঁহারা সকলেই দায়িত্বশীল ব্যক্তি। তাঁহাদের আশঙ্কা, আমরা একেবারে অবহেলা করিতে পারি না। তবুও এইরূপ আশঙ্কার কারণে সহস্র বৎসরের পুরাতন Latin Maxim, যেমন, Id Quod Alias Non Est Licitum, Necessitas Licitum Facit (That which otherwise is not lawful, necessity makes lawful), এর অর্থ হলো যা বৈধ নয় প্রয়োজন তাকে বৈধতা দেয়। Salus Populi Est Suprema Lex (Safety of the people is the supreme law) এর অর্থ জননিরাপত্তাই সর্বোচ্চ আইন এবং Salus Republicae Est Suprema Lex (Safety of the State is the Supreme law) এর অর্থ রাষ্ট্রনিরাপত্তাই সর্বোচ্চ আইন, ইহার সহায়তা লইতে হইল।
উপরোক্ত নীতিসমূহের আলোকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সাময়িকভাবে শুধুমাত্র পরবর্তী দুই সাধারণ নির্বাচনের ক্ষেত্রে থাকিবে কি না, সে সম্বন্ধে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র জনগণের প্রতিনিধি জাতীয় সংসদ লইতে পারে।
উক্ত সময়ের মধ্যে সংশ্লিষ্ট সকলেই নিজ নিজ কর্তব্য সঠিকরূপে পালন করিতে সম্পূর্ণ সজাগ ও পরিপূর্ণ দায়িত্বশীল হইবেন বলিয়া আশা করা যায়।
এইরূপ অসাধারণ পরিস্থিতির কারণে উপরোক্ত সহস্র বৎসরের পুরাতন ল্যাতিন প্রবাদ প্রয়োগ করত তর্কিত সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধন) আইন, ১৯৯৬, অবৈধ হওয়া সত্ত্বেও আগামী দশম ও একাদশ সর্বোচ্চ এই দুটি সাধারণ নির্বাচন জাতীয় সংসদের বিবেচনা অনুসারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীনে হইতে পারে।’
No comments