কীর্তিমান অধ্যক্ষ আবুল হুসাইন ওয়াইসী by খান মাহবুব

মহাকাল নির্দয়ভাবে মানুষকে জগৎ থেকে অপ্রাসঙ্গিক করে ফেলে দেহনাশের মাধ্যমে। সাধারণ মানুষ দেহনাশের পর আস্তে আস্তে বিস্মৃতি হয়ে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়। কিন্তু সমাজঘনিষ্ঠ কীর্তিমান মানুষ? সমাজে প্রাসঙ্গিক থাকে বহুকাল, কর্মগুণে। এমন এক কীর্তিমান মানুষ টাঙ্গাইলের অধ্যক্ষ আবুল হুসাইন ওয়াইসী।


জন্ম ১৯২৮ সালে ঘাটাইল উপজেলার বেণীমাধব গ্রামে। কিশোর বয়স থেকেই কোমল মনের পরোপকারী ছিলেন আবুল হুসাইন। ছাত্রাবস্থায় ওয়াইসী তরিকাভুক্ত হয়ে তিনি সৎ ও তরিকত মোতাবেক জীবনযাপন করতেন। সারা জীবন অন্তরে ধারণ করেছেন বিশুদ্ধ অহিংসার নীতি। সামাজিক সাম্য, শিক্ষা বিস্তার ও সামষ্টিক উন্নয়ন ছিল তার স্বপ্ন। ১৯৫৪তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামের ইতিহাসে এমএ ডিগ্রি লাভের পর সুদীর্ঘ সময় ধনবাড়ী কলেজ, ঘাটাইল হাইস্কুল, করটিয়া সা'দত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, সরকারি কুমুদিনী কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। ১৯৮৫ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে জীবনের সঞ্চিত অভিজ্ঞতার নিগূঢ় অংশ দিয়ে গড়ে তুলেছেন পর্যায়ক্রমে বাসাইল এমদাদ-হামিদা মহাবিদ্যালয় ও টাঙ্গাইল শহরে শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব মহাবিদ্যালয়। বাসাইল এমদাদ-হামিদা মহাবিদ্যালয় স্থাপনে যখন আবুল হুসাইন ওয়াইসীকে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদানের আমন্ত্রণ জানানো হয়, সেই পর্বে তার বক্তব্য_ 'চাকরির একটা গ্গ্নানিবোধ আছে। আছে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণের আধিপত্যের চাপ। চাকরিতে সার্বক্ষণিক দায়িত্ববোধের মর্মপীড়াও আছে। এসব জানা সত্ত্বেও, এই এলাকায় কলেজ নেই, আমি অধ্যক্ষ হতে রাজি হলেই বাসাইলে কলেজ হবে_ তাই নিজের সুখ-সুবিধে বাদ দিয়ে রাজি হয়ে গেলাম।'
তিনি ভূঞাপুর ইব্রাহীম খাঁ কলেজের অধ্যাপনায় যোগদান প্রসঙ্গে বলেন_ '১৯৯৩ সালের শেষ দিকে বাসাইল এমদাদ-হামিদা মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষের পদ থেকে অবসর নিয়ে টাঙ্গাইলের বাসায় অবস্থান করছি। এই সময় ভূঞাপুর ইব্রাহীম খাঁ কলেজ কর্তৃপক্ষের তরফ হতে ইসলামের ইতিহাসের বিভাগীয় প্রধান সফিউদ্দীন সাহেব আমার বাসায় আসলেন। তিনি বললেন, কলেজের ইসলামের ইতিহাসের এমএ ক্লাস চালাতে পারছেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে তাদের কলেজের এমএ ক্লাস নেয়ার কথা বলেছেন। শরীরটা ভালো না, বয়স হয়েছে, কিন্তু আমি না ক্ল্লাস নিলে এমএর ক্লাস চলবে না, রাজি না হয়ে পারলাম না।'
আবুল হুসাইন ওয়াইসীর জীবনের প্রতিটি ক্ষণে নিষ্ঠা, নিয়মানুবর্তিতা ও সততার ছাপ। তিনি সাংগঠনিক দক্ষতার উত্তুঙ্গে গিয়ে বাস্তবে প্রমাণ দিয়েছেন_ দানবীরের দান নয়, তৃণমূলের মানুষের ঐকান্তিকতা ও একতার মাধ্যমেও বড় সাফল্য অর্জন করা যায়। আর এর জলজ্যান্ত প্রমাণ অধ্যক্ষ আবুল হুসাইন ওয়াইসী সাহেবের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা বিশাল ঘাটাইল উপজেলার জিবিজি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ। ঘাটাইল কলেজের প্রাথমিক পর্যায়ের কথা বলতে গিয়ে অধ্যক্ষ আবুল হুসাইন সাহেব বলেছিলেন_ 'ঘাটাইল কলেজের পক্ষ থেকে ডিগ্রি ক্লাস খোলার সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো। আমি আমার কর্মী বাহিনী নিয়ে ঘাটাইলের গ্রামগুলোতে চাঁদা সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। অর্থ সংগ্রহ হয়ে গেল।'
সাধারণ মানুষের যৎসামান্য ছোট ছোট অনুদানকে একত্র করে গড়ে ওঠা এই বিশাল কলেজ প্রমাণ করে ব্যাষ্টিক থেকেই সামষ্টিক।
পারিবারিক জীবনে নির্মোহ, সাদামাটা চলাচলে অভ্যস্ত অধ্যক্ষ আবুল হুসাইনের ভাবনায় ক্ষুদ্রত্ব ছিল না। আজকের সমাজের আমিত্ব অর্থাৎ আমি ও আমার পরিবারের ভাবনায় বুঁদ হয়ে থাকতে দেখিনি তাকে। তার ভাবনার ক্যানভাসে পরিবার হলো পারিপাশর্ি্বক সমাজ। সবার অটল ঐক্য আর গভীর সংকল্পের সম্মিলন ঘটিয়ে কাজ করার চেষ্টা করেছেন সবসময়। এলাকার মানুষের সামগ্রিক সুখ-সুবিধার চিন্তা ধারণ করতেন তিনি তার চিন্তা ও কর্মে_ এমন এক বিশাল অভিভাবক ছিলেন তিনি।
উত্তর টাঙ্গাইলের উন্নয়নের লক্ষ্যে ঘাটাইলকে মহকুমায় রূপান্তরে আমি তাকে দিনরাত ছুটতে দেখেছি। ঘাটাইলকে মহকুমায় রূপান্তর করে উত্তর টাঙ্গাইল অর্থাৎ মধুপুর, গোপালপুর, ভূঞাপুর, কালিহাতী ও ঘাটাইল থানার উন্নয়নের সুদূরপ্রসারী চিন্তার ভ্রূণটি অঙ্কুরিত হয়েছিল এই মানুষটির মনে। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে তৎকালীন রাষ্ট্রপতির ঘোষণাও আদায় করেছিলেন, কিন্তু ক্ষমতার পটপরিবর্তনে সে আশা গুড়েবালি হয়েছে।
কী প্রাণান্তকর চেষ্টাই না তিনি করে গেছেন সমাজের সামগ্রিক উন্নয়নে। তার কর্মে সমাজের সদস্যরা প্রতিভাসিত হয়েছেন সন্তানরূপে, আর তিনি কর্মগুণেই হয়েছেন সবার পিতৃসম।
শুধু কি উন্নয়ন! সামাজিক দায়বদ্ধ মানুষ হিসেবে সৌহার্দ্য রক্ষায় সবসময় বিবদমান পক্ষের মাঝে সমঝোতার সেতু রচনা করেছেন। জীবনে যখন যেখানেই অবস্থান করেছেন, নেতৃত্বের জন্য যুদ্ধ করতে হয়নি; তার দক্ষতা, সততা, দৃঢ়তা তাকে নেতৃত্বের আসনে বসিয়েছে। প্রায় অর্ধশত প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন একজীবনে।
তামাটে বর্ণের এই সমাজঘনিষ্ঠ মানুষটি আমাদের জন্যই হেঁটেছেন রৌদ্রতপ্ত দুপুরে। বিশ্রাম নেননি কখনও। এই মানুষটি গত পবিত্র রমজানের প্রথম দিনে (২১ জুলাই, ২০১২) চলে গেছেন চিরবিশ্রামে। তবে বহুকাল তার কর্মযজ্ঞ জ্যোতির্ময় থাকবে টাঙ্গাইলের মানুষের মনের আকাশে। এমন দায়িত্ববোধের অভিভাবক কোথায় পাব আমরা? দুঃখ হয় এই ভেবে, আমাদের পরের প্রজন্মের মানুষদের হয়তো পরিচয় হবে না এমন গুণী মানুষের সঙ্গে!

খান মাহবুব :গবেষক ও প্রকাশক
mahbub.sahana@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.