চার হাজার কিলোমিটার সড়কপথ ঝুঁকিপূ by পার্থ সারথি দাস

সারা দেশে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) অধীন কমপক্ষে চার হাজার কিলোমিটার সড়ক-মহাসড়ক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কসহ এসব ঝুঁকিপূর্ণ সড়কপথে দুর্ঘটনায় দিনে কমপক্ষে ১১ ব্যক্তির প্রাণহানি ঘটছে। অর্থ বরাদ্দ থাকার পরও বর্ষা মৌসুমের অজুহাতে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণকাজ বেশির ভাগ স্থানে বন্ধ রয়েছে।


অন্যদিকে রক্ষণাবেক্ষণকাজে ঠিকাদারদের পাওনা জমেছে ১৮৮ কোটি টাকা। সরকার এই অর্থ পরিশোধে গাড়িমসি করায় ঠিকাদারদের অনেকেই কাজে এখন অনীহ। যোগাযোগ মন্ত্রণালয় এবং সওজ অধিদপ্তর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন জেলায় সওজ অধিদপ্তরের কাছে ঠিকাদারদের পাওনা জমেছে প্রায় ১৮৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে মহাজোট সরকারের সাড়ে তিন বছরের বকেয়াই ১৭৭ কোটি টাকা। অধিদপ্তরের ৯টি জোনের মধ্যে আটটির অধীন সওজের বিভিন্ন অফিসে এই বকেয়া পড়েছে।
তবে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা দাবি করছেন, সরকারি ক্রয় নীতিমালা না মেনে কার্যাদেশ দেওয়া, উন্নয়ন প্রকল্পে রক্ষণাবেক্ষণ খাতের অর্থ স্থানান্তরসহ প্রকৌশলীদের অনিয়মের কারণেই এই বকেয়া জমেছে। আর সওজের প্রকৌশলীদের দাবি, জরুরি অবস্থায় মন্ত্রণালয়ের চাপে ও জনপ্রতিনিধিদের নির্দেশে এসব রক্ষণাবেক্ষণকাজ করা হয়েছে। ঠিকাদাররা বকেয়া পাওনার দাবিতে কয়েক মাস আগে রাজশাহীসহ বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ কর্মসূচিও পালন করেছিলেন।
সড়ক মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে বকেয়ার বিবরণী সওজ অধিদপ্তর থেকে কিছুদিন আগে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এই বিবরণী থেকে জানা গেছে, ১৯৯৮-৯৯ থেকে ২০১১-১২_এই ১৩ অর্থবছরে সওজ অধিদপ্তরের কাছে ঠিকাদারদের বকেয়া পাওনা জমেছে ১৮৭ কোটি ৯৯ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বকেয়া ঢাকা জোনে_১৩৬ কোটি ৫১ লাখ টাকা। আর সবচেয়ে কম বকেয়া চট্টগ্রাম জোনে_৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এ ছাড়া বকেয়া জমেছে সিলেট, কুমিল্লা, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও গোপালগঞ্জ জোনে।
যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এই পাওনা পরিশোধের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে সর্বশেষ গত ৯ সেপ্টেম্বর যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে আপাতত ২০০৬-০৭ থেকে ২০১১-১২ অর্থবছরের বকেয়া পরিশোধ করার বিষয়ে আলোচনা হয়। আর আগের বছরগুলোর বকেয়া পরিশোধের বিষয়টি পরে ভেবে দেখা হতে পারে বলে জানানো হয়।
সওজের প্রধান প্রকৌশলী আমিনুর রহমান লস্করের কাছে জানতে চাইলে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, 'আমরা বকেয়ার পরিমাণ ও তালিকা তৈরি করে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। বিষয়টি গুরুত্বসহকারেই দেখা হচ্ছে।'
সওজের রাজশাহী জোনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'জনপ্রতিনিধিরা বলেন, কাজ করো। আমরা চাপে পড়ে কাজ করাতে বাধ্য হই। অর্থ পাওয়া যাবে করে করে বছর চলে যায়। কিন্তু আমরা প্রকাশ্যে কিছু বলতে পারি না।'
সওজ ঢাকা বিভাগের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী গোলাম কিবরিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, এখন পরিকল্পনা ও কর্মসূচি ছাড়া কোনো কাজ নেওয়া হচ্ছে না। আগে হয়তো নেওয়া হয়েছে। ঠিকাদারদের বকেয়া জমেছে সওজের এ বিভাগেও। এই বকেয়া পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সওজ ময়মনসিংহের নির্বাহী প্রকৌশলী চন্দন কুমার বসাক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমাদের এখানেও ঠিকাদারদের বকেয়া জমেছে। সব বকেয়াই মিলবে, এমন আশ্বাস আমরা পেয়েছি।'
গত ১৬ সেপ্টেম্বর সওজ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী আমিনুর রহমান লস্কর যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এ এন ছিদ্দিকের কাছে অর্থ ব্যয়সংক্রান্ত আগস্ট মাসের প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন। এই প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, সড়ক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সওজের সব মিলিয়ে ৯টি জোনে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত বরাদ্দ ছিল ২৮৮ কোটি ৫৮ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। কিন্তু এর মধ্যে ব্যয় হয়েছে মাত্র চার কোটি ২৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা। দেখা গেছে, দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৩২টি জেলায় কোনো অর্থ ব্যয় হয়নি চলতি অর্থবছরে। ৯টি জোনের মধ্যে ঢাকা জোনে রক্ষণাবেক্ষণে বরাদ্দ ছিল ৬৩৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যয় হয়েছে ২২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। এভাবেই অন্য জোনগুলোয় অর্থ ব্যয় হয়েছে যৎসামান্য। কোনো অর্থ ব্যয় হয়নি_এমন জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, দোহাজারি, কক্সবাজার, রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, ব্রাক্ষণবাড়িয়া, চাঁদপুরসহ বিভিন্ন জেলা।
জানা গেছে, যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে সওজ অধিদপ্তরের অধীন সড়কপথ রয়েছে ২১ হাজার ২৭১ কিলোমিটার। সওজ অধিদপ্তর সর্বশেষ জরিপ করে গত বছরের সেপ্টেম্বরে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ১৪ হাজার ৬৫৩ কিলোমিটার বিভিন্ন ধরনের সড়কে জরিপ চালিয়ে সওজ দেখতে পায়, মাত্র দেড় হাজার কিলোমিটার সড়ক ভালো অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে খুব খারাপ অবস্থায় রয়েছে তিন হাজার ৬০০ কিলোমিটার সড়ক। গত এক বছরে এসব সড়ক রক্ষণাবেক্ষণকাজ শুরু হলেও অধিকাংশ সড়কেই কাজ হয়েছে নামকাওয়াস্তে। এর মধ্যে অধিকাংশ স্থানে বৃষ্টিপাতের অজুহাতে কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে প্রকৌশলীরা বলছেন, চলতি অর্থবছরের অর্থ ছাড় হয়েছে দেরিতে। কাজ করতে গেলে বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষ করতেও সময় লাগে। এ জন্য রক্ষণাবেক্ষণকাজ শুরু হয়নি।
ফরিদপুর সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী সন্তোষ কুমার রায় কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বরাদ্দ পেয়েছি আড়াই কোটি টাকা। এই অর্থ নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে ব্যয় করতে পারব।' জামালপুর সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল ওয়াহিদ জানান, রুটিন রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে জরুরি প্রয়োজনে কাজ শুরু করা যায়। কিন্তু মৌসুমি রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে বর্ষা মৌসুম প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে থাকে।

No comments

Powered by Blogger.