শ্রদ্ধাঞ্জলি-কিংবদন্তি মুক্তিযোদ্ধা শাফায়াত জামিল by এসআইএম নূরুন্নবী খান

গুরুতর আহত হওয়ার পরও মেজর শাফায়াত জামিল তার কর্তব্য ভুলে যাননি। সমর ইতিহাসে এ ধরনের কমান্ডার খুব একটা নেই। মেজর শাফায়াত জামিলের বীরত্বের কোনো তুলনা দেওয়া যাবে না। জাতি এই বীরের সঠিক মূল্যায়ন এবং সম্মান দিতে ব্যর্থ হয়েছে


২৬ মার্চ '৭১-এ ঢাকায় গণহত্যার সংবাদ পেয়ে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটা থেকে করাচি হয়ে ২৮ মার্চ '৭১ ঢাকায় পেঁৗছি। ২৯ মার্চ '৭১-এ ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে যশোরে প্রাথমিক প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এপ্রিলের মাঝামাঝি যাই ভারতে। কলকাতার বালিগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্নেল (অব.) এমএজি ওসমানীকে রিপোর্ট করলে তিনি আমাকে তার এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেন। ১০ মে আগরতলা বিডিএফ থেকে মেজর শাফায়াত জামিল কলকাতায় এসে কর্নেল ওসমানীকে রিপর্োট করেন। ১৫ মে কর্নেল ওসমানী মেজর শাফায়াত জামিল এবং আমাকে তৃতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টে পোস্টিং দেন।
ওই সময় তৃতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টে একমাত্র অফিসার ছিলেন যুদ্ধাহত ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেন। তিনি হিলি বিওপি সংলগ্ন কামারপাড়া ক্যাম্পে অবস্থান করছিলেন। মেজর শাফায়াত জামিলের সঠিক নেতৃত্বে এবং সার্বিক পরিচালনায় মাত্র ২০ দিনের মধ্যেই আমি ১১০০ সদস্যের একটি ব্যাটালিয়ন পুনর্গঠনে সক্ষম হই। রিত্রুক্রট চলাকালেই বৃহত্তর রাজশাহী, বগুড়া ও দিনাজপুর এলাকায় অসংখ্য ক্র্যাসবুশ, রেইড এবং ডোমোলিশন ধরনের অপারেশন পরিচালিত হয়েছিল। আর এসবই করা হতো মেজর শাফায়াত জামিলের নির্দেশেই।
১৭ জুন পশ্চিম রণাঙ্গন থেকে পুনর্গঠিত তৃতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিয়ে আসা হয় গারো পাহাড়ে তুরা শহরের নিকটবর্তী তেলঢালার অরণ্যাঞ্চলে। এখানে একটি নিয়মিত ব্রিগেড গঠন করা হয়। মাত্র এক মাসের ওরিয়েন্টেশন কোর্স শেষে এই তিনটি ব্যাটালিয়নকে ভিন্ন ভিন্ন ৩টি টার্গেটে প্রথাগত আক্রমণ পরিচালনার নির্দেশ দেওয়া হয়।
তৃতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টকে বাংলাদেশের ৩৫ মাইল অভ্যন্তরে পাকিস্তানিদের শক্ত ঘাঁটি বাহাদুরাবাদ ঘাটে আক্রমণ পরিচালনার নির্দেশ দেওয়া হয়। ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক মেজর শাফায়াত জামিল হাসিমুখে এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন। তিনি আমার ডেল্টা কোম্পানিকে এসলট্ কোম্পানি হিসেবে বেছে নেন। আক্রমণটির সার্বিক পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক মেজর শাফায়াত জামিল নিজেই। ৩১ জুলাইয়ের এ আক্রমণে একশ' ভাগ সফল হই। পরদিন আমরা দেওয়ানগঞ্জ শহর আক্রমণে করে দখল করে নিতে সক্ষম হই। ৪ আগস্ট রৌমারী থানা সদরটি দখলের লক্ষ্যে পাকিস্তানি বাহিনী ব্রহ্মপুত্র নদের মূল স্রোতধারার পাশে মুক্তিবাহিনীর কোদালকাটি চরের ক্যাম্পটি দখল করে নেয়। তখনও রৌমারী থানা সদর ছিল মুক্ত। তৃতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সুবেদার আফতাবের (আলতাফ সুবেদার নামে খ্যাত) নেতৃত্বে ৭০-৮০ জনের একটি সেনাদল রৌমারীর চরাঞ্চলে এসে অবস্থান নিয়েছিল। তিনি তেলঢালায় এসে রৌমারী রক্ষার আবেদন জানালে মেজর শাফায়াত ব্রিগেড কমান্ডারের অনুমতি নিয়ে ৬ আগস্ট আমার ডেল্টা কোম্পানি এবং ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার কোম্পানিকে এ কাজে পাঠান। সম্ভাব্য এপ্রোচগুলোতে ওই রাতের মধ্যেই আমি প্রতিরক্ষা অবস্থান নিয়ে নিই। পরদিন মেজর শাফায়ত জামিল ক্যান্টেন আনোয়ারের নেতৃত্বে আলাদা কোম্পানি কর্মীমারীর চর এলাকায় প্রতিরক্ষা অবস্থান নেওয়ার জন্য পাঠান। প্রায় দু'মাস ধরে পাকিস্তানিদের অনেক আক্রমণ প্রতিহত করতে আমরা সক্ষম হই। প্রায় ৬০০ বর্গামাইল এলাকায় আমরা আমাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসি। আর এ কাজটি সম্ভব হয়েছে মেজর শাফায়াত জামিলের যোগ্য নেতৃত্বের কারণেই
১০ অক্টোবর '৭১-এ আমাদের ব্যাটালিয়নটিকে সিলেট জেলার ছাতক-ভোলাগঞ্জ এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। ছাতক অপারেশনে আমাদের পুরো ব্যাটালিয়ন এবং সে সঙ্গে রৌমারীতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একটি স্টুডেন্ট কোম্পানি অংশ নেয়। ৫ দিন স্থায়ী ছাতক অপারেশনে আমাদের পক্ষে শহীদের সংখ্যা ছিল ৪৫ জন এবং আহত শতাধিক। পাকিস্তানিদের পক্ষে মৃত ৩০৪ এবং আহত প্রায় ৪শ'। এরপর পাকিস্তানিদের সীমান্তবর্তী গোয়াইনঘাট থানা সদরের শক্তিশালী অবস্থানে আক্রমণ পরিচালনা করি। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী নদী পার হওয়ার জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক নৌকা না পাওয়ায় নদীর পশ্চিম তীর ধরে বাঙ্কার খননের মাধ্যমে গোয়াইন গ্রাম পর্যন্ত প্রতিরক্ষা অবস্থান নেওয়ার জন্য ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক মেজর শাফায়াত জামিল নির্দেশ দেন। ভোর হতে না হতেই পাকিস্তানিরা নদীর পশ্চিম তীর ধরে অবস্থান গ্রহণকারী আলফা, ডেল্টা এবং লে. ইয়ামীনের এফ এফ কোম্পানির অবস্থানগুলোর ওপর ব্যাপক গুলিগোলা নিক্ষেপ শুরু করে। দুপুরের দিকে ৩টি হেলিকপ্টারে করে তাদের একটি কমান্ডো বাহিনী আমাদের পেছনে নেমে গুলি নিক্ষেপ করতে করতে অগ্রসর হয়। দিনভর তাদের সঙ্গে আমাদের প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। সন্ধ্যার দিকে আমরা পুনর্গঠিত হয়ে তাদের ওপর পাল্টা আক্রমণ শুরু করি। মেজর শাফায়াত জামিল একটি 'সুইসাইড স্কোয়াড' গঠন করে নিজে নেতৃত্বে থেকে আহত, নিহত ও নিখোঁজ সৈন্যদের খোঁজে বেরিয়ে পড়েন। ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক হয়ে একটি আত্মঘাতী দলের নেতৃত্বে ফেরা একমাত্র শাফায়াত জামিলের পক্ষেই সম্ভব ছিল।
২৮ অক্টোবর আমাদের ডাউকি-তামাবিল পেঁৗছার নির্দেশ দেওয়া হয়। ২৬ নভেম্বর ভোররাতে জানতে পারি মিত্রবাহিনীর গুর্খা রেজিমেন্ট পাকিস্তানিদের ছোটখেল এবং তৎসংলগ্ন আলমনগর অবস্থানে দ্বিমুখী আক্রমণ পরিচালনা করবে। ব্যাপক আর্টিলারির গোলা নিক্ষেপের পর মিত্রবাহিনীর ওই আক্রমণ পরিচালনা করে ব্যর্থ হয়। গুর্খাদের পক্ষে ৪ জন অফিসার সহ ৭৫ জন নিহত হয় এবং আহত হয় ১৫০ জনের মতো।
২৭ নভেম্বর '৭১-এ বিকেলের দিকে মিত্রবাহিনীর ই-১ সেক্টর কমান্ডার কর্নেল রাজ সিং পরদিন ভোরবেলায় আমাকে একটি কোম্পানি নিয়ে ছোটখেল অবস্থানে আক্রমণ পরিচালনার নির্দেশ দিলে আমি তাতে সম্মতি জানাই। মিত্রবাহিনীর আর্টিলারির ফায়ার সাপোর্ট ছাড়াই আমি ৪টি প্লাটুন নিয়ে আত্মঘাতী এই সাইলেন্ট অ্যাটাকের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিই। রাত সাড়ে ১১টার দিকে ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক মেজর শাফায়াত জামিল মাত্র একজন দেহরক্ষী নিয়ে আমার অবস্থানে এসে পেঁৗছেন। আমি ছোটখেল আক্রমণে যাচ্ছি এই সংবাদ পেয়ে তিনি ডাউকি থেকে দীর্ঘ ৭-৮ মাইল রাস্তা পেরিয়ে ওই অন্ধকারে আমার প্রতিরক্ষা অবস্থানে পেঁৗছান। ছোটখেল আক্রমণে যাচ্ছি কিনা জানতে চাইলে আমি হ্যাঁ-সূচক উত্তর দিই। আগের দিন ছোটগেল আক্রমণে গুর্খাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সংবাদ পাওয়ার পরও আমি কেন এই আক্রমণে যেতে সম্মত হয়েছি তা জানতে চাইলেন। উত্তরে জানালাম, 'স্যার, আমরা শহীদ হওয়ার জন্যই তো মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছি। গুর্খারা আমাদের স্বাধীনতার জন্য অকাতরে হাসিমুখে প্রাণ দিয়েছে। এ অবস্থায় আমরা তো বসে থাকতে পারি না। মেজর শাফায়াত জামিল গর্জে উঠে বললেন, 'আমি জানি তোমরা কেউই এই অপারেশন থেকে ফিরে আসবে না। আমিও তোমাদের সঙ্গে শহীদ হওয়ার জন্য এই অপারেশনে যাব।' সারিবদ্ধ হয়ে প্লাটুন ভিত্তিক আমার ৪টি প্লাটুনের ১৬০ জন সৈনিক যখন অ্যাসল্ট ফর মিশনে যাওয়ার জন্য মুভ করল, তখন ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক মেজর শাফায়াত অগ্রবর্তী প্লাটুনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। প্লাটুন কমান্ডারসহ সিনিয়র জেসিও এবং এনসিওরা তার পায়ে পড়ে এই অপারেশনে যেতে বারণ করতে থাকলেন। কিন্তু তিনি কারও কথা শুনতে রাজি নন। তার এক কথা_ 'আমিও তোমাদের সঙ্গে শহীদ হতে চাই।' আমি বাধা দিলে তিনি ধমকের স্বরে বলে উঠলেন, 'তোমরা সব মরে গেলে আমি কাকে কমান্ড করব?' ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক একটি কোম্পানি অ্যাটাকে যাচ্ছে। এটা তো সমর ইতিহাসে বিরল! যা হোক মেজর শাফায়াতকে সর্বাগ্রে অ্যাসল্ট লাইনের বাঁয়ের প্লাটুনের সঙ্গে দিয়ে আমি ডানের প্লাটুনের সঙ্গে থেকে লক্ষ্যস্থলের উদ্দেশে ধীরগতিতে এবং কুয়াশার আড়ালে অতি সঙ্গোপনে এগিয়ে চললাম। শত্রুর অবস্থানের ২০-২৫ গজের মধ্যে পেঁৗছে ১৪০টি ৩৬ হ্যান্ড গ্রেনেড নিক্ষেপের মাধ্যমে আমাদের সৈন্যরা পাকিস্তানিদের ছোটখেল গ্রামের প্রতিরক্ষা অবস্থানে উঠে পড়ে। কোথাও কোথাও হাতাহাতি যুদ্ধ। ওদের অস্ত্রগুলো সব বহির্মুখী করে 'ফিক্সড লাইনে' বসানো ছিল। তারা কোনো অবস্থান থেকেই আমাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে পারছিল না। ২-৩ মিনিটের মধ্যে গ্রামটির মাঝামাঝি আমরা পেঁৗছে যাই। আমাদের উল্লসিত সৈনিকরা কয়েকটি খড়ের গাদায় আগুন দিলে চারদিক আলোকিত হয়ে ওঠে। এ সময় আমি পাকিস্তানিদের কমান্ড পোস্টে একটি স্টিল হেলমেট পরে থাকতে দেখে তা তুলে নিই। উঁচু করে স্টিল হেলমেটটি মেজর শাফায়াত স্যারকে দেখালে তিনি উচ্চস্বরে ইংরেজিতে বলে ওঠেন, নবী, চিয়ার আপ। কনগ্র্যাচুলেশন, কনভে মাই গ্রিটিংগস্ টু ইউর ট্রপ...।' আমাদের অফিসার এবং সৈনিকদের সবার পরনেই ছিল লুঙ্গি এবং শার্ট। মেজর শাফায়াত জামিল ইংরেজিতে ওই কথাগুলো বলাতে পাশের কাশবনে লুকিয়ে থাকা এক পাকিস্তানি সৈনিক বুঝতে পারে যে তিনি অফিসার হবেন। আর তাই মেজর শাফায়াতকে লক্ষ্য করে ওই সৈনিক গুলি নিক্ষেপ করলে একটি গুলি তার পেছনের কটির মাংসযুক্ত স্থানে একদিকে ঢুকে অন্যদিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। গুলিবিদ্ধ মেজর শাফায়াত জামিলকে পেছনের লুনিগ্রামের অবস্থানে পাঠিয়ে দিই। প্যাথেডিন ইনজেকশন দেওয়ার আগে আমাদের ব্যাটালিয়নের আরএমও ডা. ওয়াহেদের কাছ থেকে একটু টুকরো কাগজ ও একটি কলম নিয়ে আমাকে ৮টি নির্দেশিকা পাঠান। গুরুতর আহত হওয়ার পরও মেজর শাফায়াত জামিল তার কর্তব্য ভুলে যাননি। সমর ইতিহাসে এ ধরনের কমান্ডার খুব একটা নেই। মেজর শাফায়াত জামিলের বীরত্বের কোনো তুলনা দেওয়া যাবে না। জাতি এই বীরের সঠিক মূল্যায়ন এবং সম্মান দিতে ব্যর্থ হয়েছে।

লে. কর্নেল (অব.) এসআইএম নূরুন্নবী খান বীরবিক্রম
 

No comments

Powered by Blogger.