গ্রামেই থাকবে গরিব বহুতল ভবনে, গ্যাস বিদ্যুত নিজেদের- বগুড়ায় গরিবের ফ্ল্যাট ॥ রোজগারের ব্যবস্থা, উন্নত জীবন by সমুদ্র হক

স্বপ্নের মতো হলেও বাস্তব। একটি গ্রামকে একটি বহুতল ভবনের মধ্যে আনা হবে। বিদ্যুত পানি গ্যাসসহ আধুনিক সকল সুবিধা দিয়ে প্রত্যেক গরিব পরিবারের জন্য উন্নত জীবন ব্যবস্থা থাকবে। গরিব মানুষ ফ্ল্যাট নিতে না পারলে ট্রেনিং দিয়ে আয়বর্ধক কাজে রোজগারের ব্যবস্থাও করা হবে। সেই রোজগারের ডাউন পেমেন্ট অর্থে পাবেন ফ্ল্যাট।


তারপর ১৫ বছরে মাসিক কিস্তিতে পরিশোধ। তারাই বাড়ির মালিক। যারা দেশের বাইরে থাকেন তারাও রেমিট্যান্স পাঠিয়ে বাড়ি নিতে পারেন সহজে। বাস্তবতার নিরিখে বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমী (আরডিএ) উদ্ভাবিত এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের অনুমোদন চাওয়া হয়েছে দু’বছর আগে। পড়েছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার জালে। আরডিএর মহাপরিচালক এমএ মতিন সর্বশেষ খবর দিলেন ‘প্রি একনেক পর্যন্ত গিয়ে ফের দাঁড়িয়ে পড়েছে। গতি আসছে না।’ দেশের কৃষি জমি পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে এই প্রকল্পটি প্রণয়ন করে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন তিনি। বাস্তবসম্মত ভাবনার এই প্রকল্পটি সরকারী পর্যায়ে প্রশংসিত হয়েছে। বলাও হয়েছে প্রাথমিক পর্যায়ে পাইলট প্রকল্প হিসেবে প্রতি বিভাগে একটি করে গ্রাম এই বহুতল ভবনের মধ্যে আনা হবে, যেখানে আবাসন ঠাঁই হবে ২শ’ ৭২টি পরিবারের। এরপর পর্যায়ক্রমে সকল জেলায় এবং উপজেলায়। এভাবে দেশের আবাদী জমি রক্ষা পাবে। এক হিসাবে দেখা যায় ২০ বছর আগে যেখানে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ছিল ৯ মিলিয়ন হেক্টর সেখানে বছরে এক শতাংশ করে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৮ মিলিয়ন হেক্টর। এই রেসিও অনুযায়ী চললে আগামী ৫০ বছর পর আবাদযোগ্য জমি খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। এই বিবেচনায় সুদূরপ্রসারী ভাবনায় বগুড়া আরডিএ গ্রামে স্বল্প ব্যয়ে বহুতল ভবন নির্মাণের প্রকল্প তৈরি করে। মাত্র দেড় একর জায়গার মধ্যে ফেরো সিমেন্টে তৈরি ৬ তলা বহুতল ভবন নির্মাণের পাশাপাশি বিদ্যুত পানি গ্যাসের ব্যবস্থাও থাকবে পরিকল্পিত উপায়েই। এ জন্য বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড বা পল্লী বিদ্যুত সমিতি, গ্যাস কোম্পানির সহযোগিতা লাগবে না। ওই ভবনের এক ধারে ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা রোজগারের জন্য যে গরু-ছাগল পালন করবে তার বর্জ্য এবং গৃহস্থালি বর্জ্য দিয়ে তৈরি বায়োগ্যাস প্লান্টের মাধ্যমে বিদ্যুত ও গ্যাস উৎপাদন হবে। পানির পাম্পও চলবে বিদ্যুতে। এই বায়ো গ্যাসের পরীক্ষামূলক উৎপাদন এবং তা দিয়ে বহুমুখী কাজ ইতোমধ্যে আরডিএ প্রাঙ্গণে শুরু হয়েছে। ওই ক্যাম্পাসে ১শ’টি গাভী দিয়ে মিনি ডেইরি ফার্ম বানিয়ে তার গোবর ব্যবহার করে বায়োগ্যাস প্লান্ট তৈরি হয়েছে। এই প্লান্টের নির্ধারিত উৎপাদন ক্ষমতা দিয়েই আরডিএর আবাসিক ভবনে বিদ্যুত ও গ্যাসের সংযোগ দেয়া হয়েছে। এই বিষয়ে মহাপরিচালক এমএ মতিন জানালেন, পঁচনশীল এই জৈব পদার্থে ৫০ থেকে ৬০ ভাগ মিথেন থাকে। যা দিয়ে রান্নার কাজ ছাড়াও জেনারেটর চালিয়ে বিদ্যুত উৎপাদন করে বাতি ফ্যান টিভি ফ্রিজ কম্পিউটার চালানো যায়। বর্তমানে আরডিএ বায়োগ্যাস সিলিন্ডারে ভরে গাড়িও চালাচ্ছে। আবার এই বায়োগ্যাসের সøারি (গোবর ব্যবহারের পর পরিত্যক্ত অংশ) উন্নতমানের জৈব সার হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। বগুড়া আরডিএ নিজেদের এই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে গ্রামের বহুতল ভবনে সেট আপ করবে। এমএ মতিন বললেন, জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় দিনে দিনে গ্রামে আবাদী জমিগুলো বসত ভিটায় পরিণত হচ্ছে। একটা সময় দেশে ছিল একান্নবর্ত্তী পরিবার। আজ আর তা নেই। পরিবার ভেঙ্গে খ- খ- হয়ে গেছে। গ্রামের অনেক পরিবারের সদস্য বিদেশে গেছেন। তাঁরা টাকা পাঠিয়ে প্রথমে জমি কিনে বাড়ি করছেন। অন্যদিকে গ্রামে দারিদ্রের হার যদিও একটা পর্যায়ে এসে কমে গেছে তারপরও শুধু কৃষির ওপর নির্ভর করে জীবন মান বাড়ানো যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে গরিব পরিবারে একটি বাড়ি করা অতি দুরূহ। এই জায়গাটিতে আরডিএ রুরাল ইাউজিংয়ের বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা করেছে। অতি স্বল্প ব্যয়ে যে বহুতল ভবন নির্মাণ করা যায় তার পরীক্ষা-নিরীক্ষাও হয়েছে। সাধারণভাবে বহুতল ভবন নির্মাণে যে ব্যয় হয় তার চেয়ে অন্তত ৪০ শতাংশ কমে আরডিএর পরিকল্পনার বহুতল ভবন নির্মাণ করা যাবে। যে ভবন হবে ভূমিকম্প প্রতিরোধক। ভবনে সর্বনিম্ন ৩শ’ ৩০ বর্গফুট থেকে ১ হাজার ১শ’৫০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট থাকবে। ছোট, মধ্যম ও বড় পরিবার যার যতটুকু ফ্ল্যাট দারকার ততটুকুই নেবে। যিনি ফ্ল্যাট চাইবেন তাঁর অর্থের যোগান না থাকলে আরডিএ ট্রেনিং দিয়ে আয়বর্ধক অবস্থানে আনবে। নিজের রোজগারের টাকাতেই সে ফ্ল্যাট পাবে পরিশোধও করবে। এই বাড়ি পরিচালিত হবে সমবায়ী ভিত্তিতে। তারাই রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেবেন। বায়োগ্যাস প্লান্ট বিদ্যুত পানি গ্যাস সবই নিয়মের মধ্যে ব্যবহৃত হবে। সবচেয়ে বড় কথা বহুতল ভবনের সবই হবে পরিবেশবান্ধব। ভবনের বাসিন্দা কৃষক তাঁর নিজের জমিতে কাজ করার পর জীবন মান উন্নয়নের বাড়িতে উঠবে। ফসল ফলানোর পর ধান মাড়াই কাটাই হবে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে। ওই বাড়ির নির্দিষ্ট জায়গায় সে ব্যবস্থাও রাখা আছে। গ্রামীণ পরিবেশে এমন বহুতল ভবনের পর আশপাশে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দোকান পাট বাড়বে। এলাকাও হবে উন্নত। এই পরিকল্পনার সফলতায় আরও গ্রামকে একই ভবনের মধ্যে আনা যাবে। মহাপরিচালক বললেন, প্রাথমিক পর্যায়ে বগুড়ার শেরপুরের গাড়িদহ গ্রামকে এই মডেলের আওতায় আনার পরিকল্পনা আছে। প্রকল্পটি যাত্রা শুরু করতে পারলে উন্নয়নের নতুন ধারা সৃষ্টি হবে। এখন সব কিছুই নির্ভর করছে সরকারী অনুমোদনের ওপর।

No comments

Powered by Blogger.