বিডিআর বিদ্রোহের নেতৃত্বে ছিলেন ডিএডি তৌহিদ- আইজিপি হাসান মাহমুদের সাক্ষ্য

বিডিআর বিদ্রোহের সময় বিদ্রোহী জওয়ানদের কাছে ভারি অস্ত্রশস্ত্র থাকায় র‌্যাবের পক্ষে অভিযান চালানো সম্ভব ছিল না। ডিএডি তৌহিদকে বিডিআর বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিতে দেখা গেছে। পিলখানা হত্যাযজ্ঞ মামলায় পুলিশ মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার আদালতে এ কথা জানান।


আগামীকাল বুধবার সকালে আবার আদালতের কার্যক্রম শুরু হচ্ছে।
সোমবার সকাল ১০টায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের মাঠে স্থাপিত ঢাকার অস্থায়ী বিশেষ জজ আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়। বিচারক হিসেবে ছিলেন জহুরুল হক। তাঁকে সহায়তা করেন বিশিষ্ট ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ সুপ্রীমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী আনিসুল হক, এ্যাডভোকেট মোশারফ হোসেন কাজলসহ অন্য আইনজীবীরা। পূর্ব নির্ধারিত দিনক্ষণ অনুযায়ী আদালতে সাক্ষ্য দিতে যান পুলিশ মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার। প্রসঙ্গত, বিডিআর বিদ্রোহের সময় হাসান মাহমুদ খন্দকার র‌্যাবের মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। এ জন্য পিলখানা হত্যাযজ্ঞ মামলায় আদালত তাঁকে সাক্ষ্য দিতে নির্দেশ দেয়।
বেলা সোয়া ১১টায় পুলিশ মহাপরিদর্শক আদালতে সাক্ষ্য দিতে শুরু করেন। পুলিশ মহাপরিদর্শক আদালতকে বলেন, ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ৯টার দিকে র‌্যাব-২-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সামসুজ্জামান মোবাইল ফোনে পিলখানায় গোলযোগের কথা জানতে পারেন। র‌্যাব সদর দফতর থেকে গুলিস্তান পুলিশ সদর দফতরে যাওয়ার পথে মৎস্য ভবনের কাছে পৌঁছলে তিনি এ খবর পান। তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি ভালভাবে খতিয়ে দেখতে তিনি র‌্যাব কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন। এ বিষয়ে মোবাইল ফোনে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদের সঙ্গেও কথা হয়।
পরে পুলিশ সদর দফতরে এ বিষয়ে আইজিপি ও অন্যান্য পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা হয়। আলোচনা শেষে সেখান থেকেই র‌্যাবের উর্ধতন অন্য কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়। নির্দেশ মোতাবেক সকাল ১০টা থেকে সাড়ে ১০টার মধ্যে র‌্যাবের অন্যান্য ব্যাটালিয়ন এবং র‌্যাব সদর দফতরের প্রয়োজনীয় জনবল ও ফোর্স পিলখানার কাছাকাছি বিভিন্ন সড়কে অবস্থান নেয়। এ সময় বিভিন্ন ব্যাটালিয়নের অধিনায়করাও সেখানে ছিলেন।
এদিকে বিদ্রোহের দিন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আইজিপি ও পুলিশের অন্যান্য উর্ধতন কর্মকর্তাসহ তিনি শাহবাগ পুলিশ কন্ট্রোলরুমে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বৈঠকে বসেন। সেখানে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তৎকালীন কমিশনার নাঈম আহমেদও উপস্থিতি ছিলেন। কন্ট্রোলরুম থেকেই ঘটনা পর্যবেক্ষণ এবং র‌্যাব কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেয়া হয়।
নির্দেশনা মোতাবেক র‌্যাব-২-এর অধিনায়কের নেতৃত্বে র‌্যাবের একটি দল প্রথম পিলখানার কাছাকাছি অবস্থান নেয়। তখন থেমে থেমে ভেতর থেকে গুলি হচ্ছিল। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সেনাবাহিনীর অগ্রগামী দল ঝিগাতলায় অবস্থান নেয়। এরপর বিদ্রোহীরা পিলখানার বিভিন্ন ফটকে ভারি অস্ত্র মোতায়েন করে। এতে র‌্যাবের পক্ষে পিলখানার ভেতরে অভিযান চালানো রীতিমতো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। বিকেল ৪টা থেকে সাড়ে ৪টার দিকে আইজিপি নূর মোহাম্মদসহ তিনি প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন যমুনায় যান। ওই সময় আপৎকালীন মুহূর্ত মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তায় অন্যান্য বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে যমুনায় বিপুলসংখ্যক ফোর্স মোতায়েন করা হয়। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আগাম নির্দেশ দেয়া হয়। যুমনায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে ডিএডি তৌহিদের নেতৃত্বে বিডিআরের ১২-১৪ জন বিদ্রোহী আলোচনা করছিল। আলোচনায় আত্মসমর্পণ করা নিয়ে একটি সমঝোতা হয়। সমঝোতার পর তৌহিদের নেতৃত্বে থাকা বিদ্রোহীরা যমুনা ত্যাগ করে।
পরবর্র্তীতে তিনি বিডিআর সদর দফতরের ৪ নম্বর ফটকের কাছে হোটেল আম্বালার সামনে অন্য বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন। ওই সময় সেখানে প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক ও জাতীয় সংসদের হুইপ মীর্জা আযমসহ অন্য নেতারা উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে আত্মসমর্পণের চেষ্টা চালাতে থাকেন।
রাত ১২টার দিকে বিদ্রোহীদের সঙ্গে সমঝোতা হয়। এরপর সদ্য সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, আইনপ্রতিমন্ত্রী এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম ও তৎকালীন পুলিশ মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ পিলখানার ভেতরে যান।
পরদিন ২৬ ফেব্রুয়ারি ভোর ৪টার দিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইন প্রতিমন্ত্রী ও আইজিপি পিলখানার ভেতর থেকে অনেককে উদ্ধার করে বাইরে নিয়ে আসেন। সে সময় অন্যদের সঙ্গে আইজিপির মেয়েকেও বাইরে আনা হয়। এরপর দুপুর ১২টা থেকে পুলিশ ও র‌্যাব সমন্বিতভাবে মাইকিং করে সাধারণ মানুষকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নেয়া চেষ্টা চালায়।’
এ সময় পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টাকালে অনেক বিদ্রোহী আটক হয়। তাদের কাছ থেকে পিলখানার বিভিন্ন অফিসার্স কোয়ার্টার থেকে লুণ্ঠিত মালামাল উদ্ধার হয়। ২৬ ফেব্রুয়ারি বিদ্রোহী জওয়ানরা ডিএডি তৌহিদকে বিডিআরের মহাপরিচালক (ডিজি) হিসেবে তাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। ডিএডি তৌহিদকে বিদ্রোহীদের নেতৃত্ব দিতে দেখা যায়। প্রসঙ্গত, গত ১২ সেপ্টেম্বর আইজিপির সাক্ষ্যগ্রহণের নির্ধারিত তারিখ ছিল। কিন্তু রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যস্ত থাকায় আদালত সোমবার আইজিপির সাক্ষ্য গ্রহণ করে।
সাক্ষ্যদান শেষে পুলিশ মহাপরিদর্শককে আইনজীবী আমিনুল ইসলাম জেরা শুরু করেন। জেরার সময় হালকা উত্তেজনার সৃষ্টি হলে কয়েক মিনিট জেরা বন্ধ থাকে। বেলা দেড়টার দিকে আইজিপিকে জেরা শেষ হয়।
এর আগে বিচারপতি জহুরুল হকের একই আদালতে ঢাকার মহানগর হাকিম মিনহাজুম মনিরার অসমাপ্ত জেরা শেষ করা হয়। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় ২৫ আসামির জবানবন্দী গ্রহণ করায় বিচারপতি মনিরাকে এ মামলায় সাক্ষী করা হয়।
এছাড়া এ মামলায় সোমবার একই আদালত বিডিআর বিদ্রোহে নিহত মেজর হুমায়ুন হায়দারের স্ত্রী শামীমা পারভীনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। শামীমা পারভীন জনকণ্ঠকে বলেন, ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বিডিআরে গোলযোগের বিষয়টি আমার স্বামীর কাছে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে জানতে পারি। এ সময় আমি মিরপুর আমার পিতামাতার সঙ্গে ছিলাম। মোবাইল ফোনে তার স্বামী তাকে জানায়, যদি জীবিত থাকি দেখা হবে। আর যদি মরে যাই আমাকে ক্ষমা করো। এরপর থেকেই দুইটি মোবাইল ফোন বহুবার বাজলেও আর কেউ ধরেনি। বিকেল ৪টার দিকে আদালতের কার্যক্রম শেষ হয়। আদালতের কার্যক্রম আগামীকাল সকালে আবার শুরু হবে।
এর আগে এ মামলায় নৌবাহিনীপ্রধান ভাইস এ্যাডমিরাল জহিরউদ্দিন আহমেদ, বিমানবাহিনীর সাবেকপ্রধান এয়ার মার্শাল শাহ মোহাম্মদ জিয়াউর রহমান, সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ, স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, জাতীয় সংসদের হুইপ ও আওয়ামী লীগ নেতা মির্জা আজম সাক্ষ্য দিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে বিদ্রোহীরা। এ ঘটনায় তৎকালীন লালবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নবজ্যোতি খীসা বাদী হয়ে ২৮ ফেব্রুয়ারি ওই থানায়ই একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। পিলখানা নিউমার্কেট থানার অধীক্ষেত্র এলাকা হওয়ায় পরবর্তীতে আদালতের নির্দেশে ৭ এপ্রিল মামলাটি লালবাগ থানা থেকে নিউমার্কেট থানায় স্থানান্তর হয়।
দীর্ঘ তদন্ত শেষে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) মামলাটির তদন্ত শেষে চার্জশীট দাখিল করে। চার্জশীটে ৮৫০ জনকে আসামি করা হয়। আসামিদের মধ্যে ২০ জন পলাতক। ৩ জন মারা গেছেন। বাকি ৮২৭ আসামির বিচার চলছে। বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় সারাদেশে দায়েরকৃত ৫৭টি বিদ্রোহ মামলার মধ্যে ৫৬টির বিচার শেষ হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.