পদ্মা সেতু উপাখ্যান ॥ সত্য বনাম কল্পনা by ড. মোজাম্মেল খান
আমি কোন সাংবাদিক নই, অনুসন্ধানী তো অনেক দূরের কথা। তবুও আমি এ লেখাটি লিখছি কয়েকটি কারণে। প্রথমত, এটা এমন একটা ইস্যু যার সাথে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং ভাবমূর্তি জড়িত, যে দেশের উন্নয়ন এবং গর্ব আমার হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত।
দ্বিতীয়ত, কানাডিয়ান যে প্রকৌশল প্রতিষ্ঠানটি এ উপাখ্যানের মূল নায়ক সেটার সুদৃশ্য দুটো অফিস বলা যেতে পারে আমার বাড়ির পিছনের আঙ্গিনায়, যেটা টরেন্টোর বিজিনেস ডিসিট্রিকে যাওয়ার পথে কোন ভিজেটরের চোখ এড়াবার কোন কারণ নেই। তৃতীয়ত, আমার অনেক প্রাক্তন ছাত্র কানাডার এ অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠানে গৌরবের সাথে কর্মরত আছে। চতুর্থত, যে দুই ব্যক্তি এ ব্যাপারে অভিযুক্ত হয়েছেন তাঁদের একজন আমাদের বুয়েট থেকে পাস করা এক মেধাবী প্রকৌশলী, যিনি আমাকে ২০০০ (যখন আমি অন্টারিওর বাংলাদেশ প্রকৌশল এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলাম) সাল থেকে চেনেন বলে জানালেন এবং ঘটনাক্রমে আমার বাড়ি থেকে কয়েক মিনিটের দূরত্বে থাকেন। এবং পরিশেষে এবং সবচেয়ে যেটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ সেটা হলো : বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমে এ উপাখ্যান নিয়ে এমন সব কাল্পনিক কাহিনী রচিত হয়েছে যার সাথে সত্যের খুব কমই সম্পর্ক রয়েছে এবং যার বেশিরভাগই শোনা কথা এবং গুজবের ওপর ভিত্তি করে রচিত, দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার সাথে যার খুব কমই সম্পর্ক রয়েছে।
এমনকি বাংলাদেশের কয়েকটি সংবাদপত্র ঘুষের (যেটা কোনদিন দেয়া হয়নি) এমন সংখ্যা আবিষ্কার করেছে যেটা কিনা ঐ প্রজেক্টের কানাডীয় প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনের দাখিল করা দরপত্রের অর্থনৈতিক পরিমাণ থেকেও অনেক বেশি। গত মাসে বাংলাদেশের এক অতি পুরনো ইংরেজী সাপ্তাহিক, যেটা এখন কয়জন লোক পড়েন সেটা আমার জানা নেই, সেটাতে খোদ টরন্টো থেকে এক ব্যক্তি লিখেছেন এসএনসি-লাভালিনের দুই ব্যক্তি নাকি এখন টরন্টোর জেলে পচছেন। কানাডার বাইরে থেকে এ খবর যখন আমার এক বন্ধু আমাকে জানালেন তখন আমি ঘটনাচক্রে ঐ দুইজনের যিনি বাংলাদেশ বংশোদ্ভূত তার সাথে এক কফি শপে বসে কফি পান করছিলাম। এমনকি গত ৬ সেপ্টেম্বর চ্যানেল আই তাদের রাতের সংবাদে একই ধরনের আজগুবি সংবাদ পরিবেশন করেছে। ডেইলি স্টার যেটাকে কানাডার সংবাদ মাধ্যমসমূহ প্রতিনিয়ত উদ্ধৃত করেন এবং সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য হিসেবে গণ্য করেন তাদের ২৬ জুন সংখ্যায় লিখলেন, ‘কানাডার আরসিএমপি এসএনসি-লাভালিনের অফিস তল্লাশি চালিয়ে অনেক দলিল দস্তাবেজ জব্দ করার পাশাপাশি ঐ প্রতিষ্ঠানের সিইও পিয়ার ডুহেম, বাংলাদেশ বংশোদ্ভূত মোহাম্মদ ইসমাইল এবং ভারতীয় বংশোদ্ভূত রমেশ শাহকে আটক করেছে। আসল ঘটনা হলো সিইও পিয়ার ডুহেম এ ঘটনায় কোনদিনও দৃশ্যপটে ছিলেন না। লিবিয়া এবং তিউনিসিয়াতে কয়েকটি প্রজেক্ট পাওয়ার ব্যাপারে এক এজেন্টকে ৫৬ মিলিয়ন ঘুষ দেয়ায় তাঁর অনুমোদন ছিল- এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি গত মার্চ মাসে কোম্পানি থেকে পদত্যাগ করেন।
এ উপাখ্যানের সত্য বের করার প্রচেষ্টায় আমি একমাত্র বিশ্বব্যাংক ছাড়া বাংলাদেশের বাইরে আর সবাই, যাদের সাথে এ প্রজেক্টের বা অনুসন্ধানের সম্পর্ক রয়েছে তাদের সাথে কথা বা যোগাযোগ করেছি। এদের মধ্যে কানাডিয়ান পুলিশ আরসিএমপি অফিসার লুছি শোরে এবং এসএনসি-লাভালিনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট লেসলী কুইয়ন্টনও রয়েছেন। এসএনসি-লাভালিনের কর্মরত যে তিন ব্যক্তির নাম এ তদন্তে উল্লিখিত হয়েছে তাঁরা হলেন : কেভিন ওয়ালেছ যিনি ঐ প্রতিষ্ঠানের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং জেনারেল ম্যানেজার ছিলেন। তিনি ২০১১ সালের অক্টোবরে পদত্যাগ করে কানডু এনার্জি নামে একটা প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে যোগদান করেন। রমেশ শাহ যিনি ইন্টারন্যাশনাল প্রজেক্টের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন, যাকে ২০১১ সালে পদত্যাগ করতে হয় এবং এরপর থেকে কানাডার সাসকাচুয়ান প্রদেশের রেজাইনা নামক শহরে ফিন্যান্সিয়াল কনসালট্যান্ট হিসেবে কর্মরত আছেন। মোহাম্মদ ইসমাইল, যিনি ম্যাটেরিয়াল ইঞ্জিনিয়ার হিসেব ২০০৪ সালে ঐ কোম্পানিতে যোগদান করেন এবং খুব তাড়াতাড়ি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে ঐ কোম্পানির আন্তর্জাতিক প্রজেক্ট ডিরেক্টর হিসেবে নিয়োজিত হন। ২০১১ সালের মে মাসে ইসমাইল ঐ কোম্পানি ছেড়ে মিসিসাগা শহরে এসসিও নামে একটি কনসালটিং কোম্পানি গঠন করেন এবং সে থেকে ঐ প্রতিষ্ঠানের সিইও হিসেবে কর্মরত আছেন।
২০১১ সালের প্রথমদিকে পদ্মা ব্রিজ প্রজেক্টের কনস্ট্রাকশন কন্ট্রাকটরদের সুপারভিশনের জন্য বাংলাদেশ সরকারের ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ পাওয়ার উদ্দেশ্যে ইসমাইল কেভিন ওয়ালেছকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশে যান। ঐ সফরে তাঁরা ঢাকাতে যে সম¯ত ব্যক্তিবর্গের সাথে কথা বলেন তাঁদের নাম এবং আলোচনার সারসংক্ষেপ ইসমাইল টেলিফোনে রমেশ শাহকে নিয়মিতভাবে অবহিত করতেন এবং রমেশ সেটা তাঁর ডায়রিতে অনেকটা সাঙ্কেতিক ভাষায় লিখে রাখতেন। পরবর্তীতে বিশ্বব্যাংক রমেশের ডায়রি থেকে উদ্ধার করা নামগুলোই বাংলাদেশের দুদককে সরবরাহ করেছে, যে তথ্য দুদক চেয়ারম্যান গত জুলাই মাসের এক তারিখে সাংবাদিকদের কাছে প্রকাশ করেন। আমি যখন এ ব্যাপারে আরসিএমপি অফিসারের সাথে কথা বলি তখন তিনি ‘ঘটনাটা নিয়ে এখনও অনুসন্ধান চলছে’ এ অজুহাতে এর বেশি কিছু জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
ইসমাইল এবং কেভিন ওয়ালেছের বাংলাদেশ সফরের পর তাদের ঐ প্রজেক্টটা পাওয়ার ব্যর্থতার পর ২০১১-এর ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সবকিছুই নীরব ছিল। আসলে ঐ প্রজেক্টটা কত ডলারের ছিল সেটা বাংলাদেশের কোন গণমাধ্যমে আমি দেখিনি। রয়টার সংবাদ সংস্থার ভাষ্য অনুযায়ী এটা ছিল ১০ মিলিয়ন ডলারের, প্রাক্তন মন্ত্রী আবুল হোসেন তার দুদককে দেয়া বক্তব্য অনুযায়ী ৩৭ মিলিয়ন ডলার, এসএনসি-লাভালিনের ভাইস প্রেসিডেন্টের আমার কাছে দেয়া বক্তব্য অনুযায়ী ‘আমাদের অংশটা একেবারেই অল্প, যেহেতু আমরা বিড করেছিলাম শুধু মাত্র ক্লায়েন্টের ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করার জন্য’। আমার নিজস্ব নির্ভরযোগ্য সূত্র বলেছে এটা ছিল ৪৫ মিলিয়ন ডলারের যেটা অবশ্য এসএনসি-লাভালিনের ভাইস প্রেসিডেন্টের কাছে অতিরঞ্জিত মনে হয়েছে। ২০১১ সালে ৩ সেপ্টেম্বরে সংবাদ মাধ্যমে প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হলো যে বিশ্বব্যাংকের অনুরোধ পদ্মা ব্রিজের কথিত দুর্নীতি তদন্তে কানাডিয়ান পুলিশ এসএনসি-লাভালিনের অকভিল অফিসে অভিযান চালিয়েছে। ২০১১ এর ৬ সেপ্টেম্বর তারিখে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসএনসি-লাভালিন এ অভিযানের সত্যতা স্বীকার করে। তদন্ত পরিক্রমায় এ বছরের ২৯ ফেব্রুয়ারি তারিখে আরসিএমপি-এর দুর্নীতি দমন টিম রমেশ শাহ এবং মোহাম্মদ ইসমাইলকে গ্রেফতার করে। বাংলাদেশ সংবাদ মাধ্যমসমূহে গ্রেফতারকৃত দুই ব্যক্তির ভুল নাম (রমেশ সাহা এবং ইসমাইল হোসেন হিসেবে বাংলা সংবাদ মাধ্যম প্রকাশ করেছে) প্রকাশিত হওয়ার আগ পর্যন্ত (২৪ জুন, ২০১২) তাদের গ্রেফতার হওয়ার সংবাদ আরসিএমপি প্রকাশ করেনি। যদিও কোন অর্থ হস্তান্তরিত হয়নি তবুও তাদের বিরুদ্ধে ১১ এপ্রিল করাপশন অব ফরেন পাবলিক অফিসিয়াল এ্যাক্ট-এর আওতায় অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে, যার সর্বোচ্চ শাস্তি পাঁচ বছরের কারাদ-।
১৯৯৯ সাল থেকে প্রবর্তিত এ আইনটি এমন সব ব্যবসায়ীকে বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে টার্গেট করে তৈরি করা হয়েছে যারা “প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোন বিদেশী সরকারী কর্মকর্তা বা ব্যক্তিকে কোন ধরনের সুযোগ সুবিধা বা পারিতোষিক দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।” “বিদেশী কোন সরকারী ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ তাদের নিজের বা নিজেদের ক্ষমতা বলে যেন সে দেশের কোন সিদ্ধান্তকে প্রভান্বিত না করতে পারেন” সেটাকে বন্ধ করার জন্যই এ আইনটি প্রবর্তিত হয়েছে। ঘটনাক্রমে এ আইনের প্রথম শিকার হয়েছে নাইকো নামে একটি প্রতিষ্ঠান (বাংলাদেশের মানুষ নিশ্চয়ই এ প্রতিষ্ঠানটিকে ভাল করেই জানেন) গত বছরের জুন মাসে যাকে বাংলাদেশেরই এক মন্ত্রীকে ঘুষ দেয়ার অপরাধে ৯.৫ মিলিয়ন ডলার জরিমানা করা হয়েছে।
রমেশ শাহ এবং মোহাম্মদ ইসমাইলের বিরুদ্ধে গত ১১ এপ্রিল প্রাথমিক অভিযোগ দায়েরের পর থেকেই তারা জামিনে মুক্ত রয়েছেন এবং এর মাঝে কয়েকবার আদালতে হাজিরা দিয়েছেন যার সর্বশেষটি ঘটেছে গত ২৫ জুন তারিখে। ঐদিন আদালত আগামী বছরের (২০১৩) ৮ থেকে ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত মামলার পরবর্তী শুনানির তারিখ নির্ধারণ করেছে এ সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য যে তাদের বিরুদ্ধে বিচার করার মতন পর্যাপ্ত অভিযোগ রয়েছে কিনা।
গত এপ্রিলের ২ তারিখে এসএনসি-লাভালিনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট লেসলী কুইয়ন্টন দাবি করলেন তাদের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ দায়ের করা হয়নি এবং রমেশ এবং ইসমাইল ছাড়া অন্যকোন প্রাক্তন কর্মকর্তা অভিযুক্ত হয়েছেন কিনা বা বাংলাদেশ ইস্যুতে অন্য কোন কর্মকর্তা এসএনসি-লাভালিন ছেড়ে গেছেন কিনা সেটা তার জানা নেই। তিনি আরও স্বীকার করলেন যে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশে এ প্রজেক্টে তাদের প্রতিষ্ঠানতে ‘ঊধৎষু ঞবসঢ়ড়ৎধৎু ঝঁংঢ়বহংরড়হ’ ইস্যু করেছে যার পরিপ্রেক্ষিতে তারা আপাতত বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংক সম্পর্কিত কোন কনট্রাক্টে দরপত্র দাখিলের ক্ষমতা হারিয়েছেন। আমার নির্ভরযোগ্য সূত্রের তথ্য অনুযায়ী যদি প্রজেক্টটা ৪৫ মিলিয়ন ডলারের বলে ধরে নেয়া যায় তবে সেটা বিশ্বব্যাংকের বাতিল করা প্রতিশ্রুত অর্থের মাত্র ৩.৭৫ শতাংশ। অন্যদিকে আরসিএমপি মুখপাত্র আমাকে প্রজেক্টের আর্থিক পরিমাণ বা প্রতিশ্রুত ঘুষের অঙ্ক কোনটাই জানাতে রাজি হননি যেহেতু ঘটনার এখনও তদন্ত চলছে। মোহাম্মদ ইসমাইল ছিলেন ঐ প্রতিষ্ঠানের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর যার সত্যিকার অর্থে কোন অর্থ প্রদানের ক্ষমতা ছিল না, আর রমেশ শাহ যদিও ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন তারও এসএনসি-লাভালিনের সর্বোচ্চ ব্যক্তির অনুমোদন ছাড়া, যেমনভাবে অনুমোদিত হয়েছিল লিবিয়া এবং তিউনিসিয়াতে প্রজেক্ট পাওয়ার ক্ষেত্রে, কোন বিদেশী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে কোন বেআইনী অর্থ প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেয়ার কোন ক্ষমতাই ছিল না। অতএব স্বাভাবিক জ্ঞানতাড়িত হওয়া যে কোন ব্যক্তির মনেই মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন জাগবে : কে বা কারা কার স্বার্থ উদ্ধারের মানসে এই দুই ব্যক্তিকে বলির পাঁঠা বানিয়েছে?
লেখক : কানাডা প্রবাসী অধ্যাপক
এমনকি বাংলাদেশের কয়েকটি সংবাদপত্র ঘুষের (যেটা কোনদিন দেয়া হয়নি) এমন সংখ্যা আবিষ্কার করেছে যেটা কিনা ঐ প্রজেক্টের কানাডীয় প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনের দাখিল করা দরপত্রের অর্থনৈতিক পরিমাণ থেকেও অনেক বেশি। গত মাসে বাংলাদেশের এক অতি পুরনো ইংরেজী সাপ্তাহিক, যেটা এখন কয়জন লোক পড়েন সেটা আমার জানা নেই, সেটাতে খোদ টরন্টো থেকে এক ব্যক্তি লিখেছেন এসএনসি-লাভালিনের দুই ব্যক্তি নাকি এখন টরন্টোর জেলে পচছেন। কানাডার বাইরে থেকে এ খবর যখন আমার এক বন্ধু আমাকে জানালেন তখন আমি ঘটনাচক্রে ঐ দুইজনের যিনি বাংলাদেশ বংশোদ্ভূত তার সাথে এক কফি শপে বসে কফি পান করছিলাম। এমনকি গত ৬ সেপ্টেম্বর চ্যানেল আই তাদের রাতের সংবাদে একই ধরনের আজগুবি সংবাদ পরিবেশন করেছে। ডেইলি স্টার যেটাকে কানাডার সংবাদ মাধ্যমসমূহ প্রতিনিয়ত উদ্ধৃত করেন এবং সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য হিসেবে গণ্য করেন তাদের ২৬ জুন সংখ্যায় লিখলেন, ‘কানাডার আরসিএমপি এসএনসি-লাভালিনের অফিস তল্লাশি চালিয়ে অনেক দলিল দস্তাবেজ জব্দ করার পাশাপাশি ঐ প্রতিষ্ঠানের সিইও পিয়ার ডুহেম, বাংলাদেশ বংশোদ্ভূত মোহাম্মদ ইসমাইল এবং ভারতীয় বংশোদ্ভূত রমেশ শাহকে আটক করেছে। আসল ঘটনা হলো সিইও পিয়ার ডুহেম এ ঘটনায় কোনদিনও দৃশ্যপটে ছিলেন না। লিবিয়া এবং তিউনিসিয়াতে কয়েকটি প্রজেক্ট পাওয়ার ব্যাপারে এক এজেন্টকে ৫৬ মিলিয়ন ঘুষ দেয়ায় তাঁর অনুমোদন ছিল- এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি গত মার্চ মাসে কোম্পানি থেকে পদত্যাগ করেন।
এ উপাখ্যানের সত্য বের করার প্রচেষ্টায় আমি একমাত্র বিশ্বব্যাংক ছাড়া বাংলাদেশের বাইরে আর সবাই, যাদের সাথে এ প্রজেক্টের বা অনুসন্ধানের সম্পর্ক রয়েছে তাদের সাথে কথা বা যোগাযোগ করেছি। এদের মধ্যে কানাডিয়ান পুলিশ আরসিএমপি অফিসার লুছি শোরে এবং এসএনসি-লাভালিনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট লেসলী কুইয়ন্টনও রয়েছেন। এসএনসি-লাভালিনের কর্মরত যে তিন ব্যক্তির নাম এ তদন্তে উল্লিখিত হয়েছে তাঁরা হলেন : কেভিন ওয়ালেছ যিনি ঐ প্রতিষ্ঠানের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং জেনারেল ম্যানেজার ছিলেন। তিনি ২০১১ সালের অক্টোবরে পদত্যাগ করে কানডু এনার্জি নামে একটা প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে যোগদান করেন। রমেশ শাহ যিনি ইন্টারন্যাশনাল প্রজেক্টের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন, যাকে ২০১১ সালে পদত্যাগ করতে হয় এবং এরপর থেকে কানাডার সাসকাচুয়ান প্রদেশের রেজাইনা নামক শহরে ফিন্যান্সিয়াল কনসালট্যান্ট হিসেবে কর্মরত আছেন। মোহাম্মদ ইসমাইল, যিনি ম্যাটেরিয়াল ইঞ্জিনিয়ার হিসেব ২০০৪ সালে ঐ কোম্পানিতে যোগদান করেন এবং খুব তাড়াতাড়ি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে ঐ কোম্পানির আন্তর্জাতিক প্রজেক্ট ডিরেক্টর হিসেবে নিয়োজিত হন। ২০১১ সালের মে মাসে ইসমাইল ঐ কোম্পানি ছেড়ে মিসিসাগা শহরে এসসিও নামে একটি কনসালটিং কোম্পানি গঠন করেন এবং সে থেকে ঐ প্রতিষ্ঠানের সিইও হিসেবে কর্মরত আছেন।
২০১১ সালের প্রথমদিকে পদ্মা ব্রিজ প্রজেক্টের কনস্ট্রাকশন কন্ট্রাকটরদের সুপারভিশনের জন্য বাংলাদেশ সরকারের ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ পাওয়ার উদ্দেশ্যে ইসমাইল কেভিন ওয়ালেছকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশে যান। ঐ সফরে তাঁরা ঢাকাতে যে সম¯ত ব্যক্তিবর্গের সাথে কথা বলেন তাঁদের নাম এবং আলোচনার সারসংক্ষেপ ইসমাইল টেলিফোনে রমেশ শাহকে নিয়মিতভাবে অবহিত করতেন এবং রমেশ সেটা তাঁর ডায়রিতে অনেকটা সাঙ্কেতিক ভাষায় লিখে রাখতেন। পরবর্তীতে বিশ্বব্যাংক রমেশের ডায়রি থেকে উদ্ধার করা নামগুলোই বাংলাদেশের দুদককে সরবরাহ করেছে, যে তথ্য দুদক চেয়ারম্যান গত জুলাই মাসের এক তারিখে সাংবাদিকদের কাছে প্রকাশ করেন। আমি যখন এ ব্যাপারে আরসিএমপি অফিসারের সাথে কথা বলি তখন তিনি ‘ঘটনাটা নিয়ে এখনও অনুসন্ধান চলছে’ এ অজুহাতে এর বেশি কিছু জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
ইসমাইল এবং কেভিন ওয়ালেছের বাংলাদেশ সফরের পর তাদের ঐ প্রজেক্টটা পাওয়ার ব্যর্থতার পর ২০১১-এর ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সবকিছুই নীরব ছিল। আসলে ঐ প্রজেক্টটা কত ডলারের ছিল সেটা বাংলাদেশের কোন গণমাধ্যমে আমি দেখিনি। রয়টার সংবাদ সংস্থার ভাষ্য অনুযায়ী এটা ছিল ১০ মিলিয়ন ডলারের, প্রাক্তন মন্ত্রী আবুল হোসেন তার দুদককে দেয়া বক্তব্য অনুযায়ী ৩৭ মিলিয়ন ডলার, এসএনসি-লাভালিনের ভাইস প্রেসিডেন্টের আমার কাছে দেয়া বক্তব্য অনুযায়ী ‘আমাদের অংশটা একেবারেই অল্প, যেহেতু আমরা বিড করেছিলাম শুধু মাত্র ক্লায়েন্টের ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করার জন্য’। আমার নিজস্ব নির্ভরযোগ্য সূত্র বলেছে এটা ছিল ৪৫ মিলিয়ন ডলারের যেটা অবশ্য এসএনসি-লাভালিনের ভাইস প্রেসিডেন্টের কাছে অতিরঞ্জিত মনে হয়েছে। ২০১১ সালে ৩ সেপ্টেম্বরে সংবাদ মাধ্যমে প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হলো যে বিশ্বব্যাংকের অনুরোধ পদ্মা ব্রিজের কথিত দুর্নীতি তদন্তে কানাডিয়ান পুলিশ এসএনসি-লাভালিনের অকভিল অফিসে অভিযান চালিয়েছে। ২০১১ এর ৬ সেপ্টেম্বর তারিখে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসএনসি-লাভালিন এ অভিযানের সত্যতা স্বীকার করে। তদন্ত পরিক্রমায় এ বছরের ২৯ ফেব্রুয়ারি তারিখে আরসিএমপি-এর দুর্নীতি দমন টিম রমেশ শাহ এবং মোহাম্মদ ইসমাইলকে গ্রেফতার করে। বাংলাদেশ সংবাদ মাধ্যমসমূহে গ্রেফতারকৃত দুই ব্যক্তির ভুল নাম (রমেশ সাহা এবং ইসমাইল হোসেন হিসেবে বাংলা সংবাদ মাধ্যম প্রকাশ করেছে) প্রকাশিত হওয়ার আগ পর্যন্ত (২৪ জুন, ২০১২) তাদের গ্রেফতার হওয়ার সংবাদ আরসিএমপি প্রকাশ করেনি। যদিও কোন অর্থ হস্তান্তরিত হয়নি তবুও তাদের বিরুদ্ধে ১১ এপ্রিল করাপশন অব ফরেন পাবলিক অফিসিয়াল এ্যাক্ট-এর আওতায় অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে, যার সর্বোচ্চ শাস্তি পাঁচ বছরের কারাদ-।
১৯৯৯ সাল থেকে প্রবর্তিত এ আইনটি এমন সব ব্যবসায়ীকে বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে টার্গেট করে তৈরি করা হয়েছে যারা “প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোন বিদেশী সরকারী কর্মকর্তা বা ব্যক্তিকে কোন ধরনের সুযোগ সুবিধা বা পারিতোষিক দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।” “বিদেশী কোন সরকারী ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ তাদের নিজের বা নিজেদের ক্ষমতা বলে যেন সে দেশের কোন সিদ্ধান্তকে প্রভান্বিত না করতে পারেন” সেটাকে বন্ধ করার জন্যই এ আইনটি প্রবর্তিত হয়েছে। ঘটনাক্রমে এ আইনের প্রথম শিকার হয়েছে নাইকো নামে একটি প্রতিষ্ঠান (বাংলাদেশের মানুষ নিশ্চয়ই এ প্রতিষ্ঠানটিকে ভাল করেই জানেন) গত বছরের জুন মাসে যাকে বাংলাদেশেরই এক মন্ত্রীকে ঘুষ দেয়ার অপরাধে ৯.৫ মিলিয়ন ডলার জরিমানা করা হয়েছে।
রমেশ শাহ এবং মোহাম্মদ ইসমাইলের বিরুদ্ধে গত ১১ এপ্রিল প্রাথমিক অভিযোগ দায়েরের পর থেকেই তারা জামিনে মুক্ত রয়েছেন এবং এর মাঝে কয়েকবার আদালতে হাজিরা দিয়েছেন যার সর্বশেষটি ঘটেছে গত ২৫ জুন তারিখে। ঐদিন আদালত আগামী বছরের (২০১৩) ৮ থেকে ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত মামলার পরবর্তী শুনানির তারিখ নির্ধারণ করেছে এ সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য যে তাদের বিরুদ্ধে বিচার করার মতন পর্যাপ্ত অভিযোগ রয়েছে কিনা।
গত এপ্রিলের ২ তারিখে এসএনসি-লাভালিনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট লেসলী কুইয়ন্টন দাবি করলেন তাদের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ দায়ের করা হয়নি এবং রমেশ এবং ইসমাইল ছাড়া অন্যকোন প্রাক্তন কর্মকর্তা অভিযুক্ত হয়েছেন কিনা বা বাংলাদেশ ইস্যুতে অন্য কোন কর্মকর্তা এসএনসি-লাভালিন ছেড়ে গেছেন কিনা সেটা তার জানা নেই। তিনি আরও স্বীকার করলেন যে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশে এ প্রজেক্টে তাদের প্রতিষ্ঠানতে ‘ঊধৎষু ঞবসঢ়ড়ৎধৎু ঝঁংঢ়বহংরড়হ’ ইস্যু করেছে যার পরিপ্রেক্ষিতে তারা আপাতত বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংক সম্পর্কিত কোন কনট্রাক্টে দরপত্র দাখিলের ক্ষমতা হারিয়েছেন। আমার নির্ভরযোগ্য সূত্রের তথ্য অনুযায়ী যদি প্রজেক্টটা ৪৫ মিলিয়ন ডলারের বলে ধরে নেয়া যায় তবে সেটা বিশ্বব্যাংকের বাতিল করা প্রতিশ্রুত অর্থের মাত্র ৩.৭৫ শতাংশ। অন্যদিকে আরসিএমপি মুখপাত্র আমাকে প্রজেক্টের আর্থিক পরিমাণ বা প্রতিশ্রুত ঘুষের অঙ্ক কোনটাই জানাতে রাজি হননি যেহেতু ঘটনার এখনও তদন্ত চলছে। মোহাম্মদ ইসমাইল ছিলেন ঐ প্রতিষ্ঠানের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর যার সত্যিকার অর্থে কোন অর্থ প্রদানের ক্ষমতা ছিল না, আর রমেশ শাহ যদিও ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন তারও এসএনসি-লাভালিনের সর্বোচ্চ ব্যক্তির অনুমোদন ছাড়া, যেমনভাবে অনুমোদিত হয়েছিল লিবিয়া এবং তিউনিসিয়াতে প্রজেক্ট পাওয়ার ক্ষেত্রে, কোন বিদেশী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে কোন বেআইনী অর্থ প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেয়ার কোন ক্ষমতাই ছিল না। অতএব স্বাভাবিক জ্ঞানতাড়িত হওয়া যে কোন ব্যক্তির মনেই মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন জাগবে : কে বা কারা কার স্বার্থ উদ্ধারের মানসে এই দুই ব্যক্তিকে বলির পাঁঠা বানিয়েছে?
লেখক : কানাডা প্রবাসী অধ্যাপক
No comments