সমকালীন প্রসঙ্গ-আত্মপ্রচারে ঢেকে যায় রাজনীতি by আবু সাঈদ খান

স্বীকার করি, আত্মপ্রচারের বিষয়টি মানুষের সহজাত। এ ব্যাপারে একটি প্রচলিত প্রবাদ আছে_ আপনার ঢোল আপনিই পিটাইবেন, অন্য কেউ পিটাইতে গেলে ফাটাইয়া দিতে পারে। এ রসের প্রবাদটির মধ্যেও মাত্রাজ্ঞানের প্রসঙ্গ আছে। জোরে ঢোলে বাড়ি মারলে ফেটে যাওয়ার আশঙ্কার উল্লেখ আছে।


কিন্তু আমাদের প্রচারপ্রিয় নেতাকর্মীদের প্রচারের ধরন-ধারণ সেই মাত্রাজ্ঞান ছাড়িয়ে যায়। আপত্তি সেইখানে। আমি কেবল রাজনীতিকদের কথাই বলছি না; অন্যদের ক্ষেত্রেও মাত্রাজ্ঞানের অভাব লক্ষণীয়

রাজনীতিতে প্রচার-প্রচারণার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞাপনের কেরামতিতে অখাদ্য যেমন সুখাদ্য বলে প্রতীয়মান হয়, প্রচার-প্রচারণার তোড়ে রাজনীতিতেও এমনটি ঘটছে আকসার। অতীতেও ঘটত, তবে এখন মুক্তবাজার অর্থনীতির বিজ্ঞাপনী রমরমা রাজনীতিকেও প্রভাবিত করে ফেলেছে। অতীতে প্রচার-প্রচারণার ক্ষেত্রে দলীয় আদর্শ ও কর্মসূচির আড়ালে সর্বদা ব্যক্তির উপস্থিতি থাকত। তবে সাম্প্রতিককালে ব্যক্তির গুণকীর্তনের বাগাড়ম্বরের আড়ালে আদর্শ ও কর্মসূচির বিষয়টি গৌণ হয়ে পড়েছে। ঢাকাসহ সারাদেশে রাজপথের ধারে, দেয়ালে, তোরণে, বিলবোর্ডে তাকালেই বোঝা যায়_ আত্মপ্রচার কী এবং কত প্রকার! না, কেবল দেয়াল-বিলবোর্ড-তোরণেই সীমাবদ্ধ নেই; বিভিন্ন দিবস ও নানা উপলক্ষে সংবাদপত্রে দেওয়া বিজ্ঞাপনেও আত্মপ্রচারের স্থূল নমুনা পাওয়া যায়। রাজনৈতিক দলের প্রচারের মাইকে, কিংবা জনসভায় নেতাদের পরিচয় বয়ানকালে বিশেষণের ঘনঘটায় মনে হতে পারে_ সবাই যেন বাংলার বাঘ!
কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, এই প্রচার-প্রচারণার ইতিবাচক দিক কি নেই? আলবৎ আছে। পাকিস্তান আমলে, এমনকি স্বাধীনতা-উত্তরকালেও হাটে টিন পিটিয়ে, চোঙা ফুঁকিয়ে সভায় উপস্থিত হওয়ার আহ্বান করা হতো। দেয়ালে খবরের কাগজের ওপর কালি দিয়ে লেখা পোস্টার সেঁটে দেওয়া হতো। কেন্দ্রীয় নেতাদের আগমনে বড় জনসভা ভিন্ন ছাপানো পোস্টারের কথা ভাবা যেত না। পোড়া মোবিল ব্যবহার করে দেয়াল লিখন হতো। সে জায়গা দখল করেছে রঙবেরঙের পোস্টার। ডিজিটাল ব্যানার ব্যবহারে প্রযুক্তিগত ও নান্দনিক সৌন্দর্যের বিকাশ ঘটেছে। সেটি নিয়ে আমার কথা নেই। কথা হচ্ছে ওই মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে নির্লজ্জ কায়দায় ব্যক্তিগত স্বার্থে বিভিন্ন ব্যক্তিকে তুলে ধরা নিয়ে। আগে পোস্টার বা ব্যানারে কোথায় সভা, কী দাবি, দলের নাম ও শাখা লেখার রেওয়াজ ছিল। তাতে অতিথি বা বক্তাদের ছবি থাকাও স্বাভাবিক। কিন্তু এখন পোস্টারে বা ব্যানারে তার নামও থাকে, যিনি ছাপিয়েছেন বা টাকা দিয়েছেন। নেতার পাশে পাতিনেতাদের নাম এবং হাসি হাসি মুখের প্রতিকৃতি শোভা পায়। ভাবখানা এমন_ যার টাকায় পোস্টার-ব্যানার হবে, তার ছবি থাকবে না কেন? অনেক ক্ষেত্রে সেই ছবি প্রধান অতিথি বা প্রধান বক্তার ছবির চেয়ে দৈর্ঘ্য-আয়তনে বড়। ঢাকার রাস্তায় কিছু বাঁশের তৈরি স্থায়ী তোরণ আছে, যাতে বিভিন্ন দিবস, ঈদ-পার্বণে নেতাদের শুভেচ্ছা বাণী এঁটে দেওয়া হয়। কার সৌজন্যে তোরণ_ তারও বিশাল ছবি স্থান পায়। তার পাশে স্থানীয় নেতাদের ছবি_ এক কোনায় ঠাঁই মেলে জাতীয় নেতা-নেত্রীর প্রতিকৃতি। আওয়ামী লীগের কর্মীদের টানানো ব্যানারে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনা এবং বিএনপির ক্ষেত্রে জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়া। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু-হাসিনার সঙ্গে জয় এবং জিয়া-খালেদার সঙ্গে তারেক জিয়ার ছবি থাকে। ইদানীং তাতে ভাটা পড়েছে। হতে পারে দুই পরিবারের দুই উত্তরাধিকারীকে আপাতত দূরে রাখার কৌশল নেওয়া হয়েছে।
সেদিন ওয়াসার সামনে ব্যানারে দেখলাম, শ্রমিক লীগের কোনো কর্মকর্তা নির্বাচিত হওয়ায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানানো হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, শেখ হাসিনা কি তাকে ভোট দিয়ে কিংবা হুকুম দিয়ে কি ওই দায়িত্বে বসিয়েছেন! এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সদস্য বা কাউন্সিলর; যাদের ভোটে তিনি নির্বাচিত হয়েছেন, অভিনন্দন তাদের প্রাপ্য। কিন্তু শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানানোর মাজেজা হচ্ছে, শেখ হাসিনার পাশে বিজয়ী নেতার একখানা হাস্যোজ্জ্বল ছবি থাকবে। সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে আর ভাববে, কত বড় নেতা!
এবার যুবলীগের সম্মেলন সামনে রেখে দেখলাম আরেক ধাপ অগ্রগতি! রাস্তার ধারের বিলবোর্ডগুলোয় সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক বা অন্য পদ-পদবি ইচ্ছুক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ছবি। যথারীতি দলীয় নেত্রীর ছবিও রয়েছে। কেউ কেউ দলীয় নেত্রীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিও বিলবোর্ডে ঠাঁই দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা বা বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ছবি কোথায়, কীভাবে ব্যবহৃত হবে_ সেটি তাদের সিদ্ধান্তের ব্যাপার। যদিও দল বা অঙ্গ সংগঠনের পদ-পদবি নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারীরা এভাবে নেতা-নেত্রীর নাম ব্যবহার করলে তাতে তাদের ভাবমূর্তি মহিমান্বিত হয় না। কিন্তু কোনো সংগঠনের সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী হীনস্বার্থে স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি ব্যবহার করবেন_ তা কি সমর্থনযোগ্য? আমার মনে হয়, এ ব্যাপারে একটি নীতিমালা থাকা জরুরি। যাতে স্পষ্ট বর্ণিত থাকবে, কোন কোন ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর ছবি রাখা যাবে, কোন কোন ক্ষেত্রে তা রাখা যাবে না। কারণ বঙ্গবন্ধু একদা আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন সত্য; কিন্তু আজ অধিকতর সত্য, তিনি দলীয় সীমানার ওপরে জাতির মহান নেতা। এ সত্য যারা উপলব্ধি না করে বঙ্গবন্ধুর ছবি যথেচ্ছ ব্যবহার করে, তাদের কি বঙ্গবন্ধুর সত্যিকার অনুসারী বলা যায়?
এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয়, দলের অঙ্গ সংগঠনের কাউন্সিলে নেতা নির্বাচন অভ্যন্তরীণ বিষয়। যেখানে সাধারণের ভোটাধিকার নেই, থাকার কথাও নয়_ তাহলে ব্যানার-ফেস্টুন টানিয়ে, বিলবোর্ড দখল করে প্রচারের মানে কী? এর মাধ্যমে যে অর্থের অপচয় হলো তা আসছে কোথা থেকে?
যুবলীগের দলীয় সম্মেলনের আগে শহরের বিভিন্ন স্থানে সিটি করপোরেশনের মেয়র প্রার্থীদের পোস্টার, ব্যানার, বিজ্ঞাপন ভরা ছিল, সেগুলো নির্বাচনী বিধিবহির্ভূত হওয়ায় নির্বাচন কমিশনারের নির্দেশে তা অপসারিত হয়েছে। কিন্তু সেই স্থান দখল করল যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্মেলন এবং সেই সম্মেলনে প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণা। সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন এসে যায়, যা স্থানীয় সরকারের নির্বাচনের বিধিবহির্ভূত, তা কি যুব বা অন্য কোনো সংগঠনের কমিটি নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য? বলাবাহুল্য, ওইসব কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সদস্যদের মতামতের চেয়ে ওপর থেকে পদ-পদবি ঠিক করে দেওয়ার রীতিই গুরুত্বের সঙ্গে অনুসৃত হচ্ছে। তারপরও তাদের কথা শোনানোর, চেহারা দেখানো কি তুমুল প্রতিযোগিতা!
স্বীকার করি, আত্মপ্রচারের বিষয়টি মানুষের সহজাত। এ ব্যাপারে একটি প্রচলিত প্রবাদ আছে_ আপনার ঢোল আপনিই পিটাইবেন, অন্য কেউ পিটাইতে গেলে ফাটাইয়া দিতে পারে। এ রসের প্রবাদটির মধ্যেও মাত্রাজ্ঞানের প্রসঙ্গ আছে। জোরে ঢোলে বাড়ি মারলে ফেটে যাওয়ার আশঙ্কার উল্লেখ আছে। কিন্তু আমাদের প্রচারপ্রিয় নেতাকর্মীদের প্রচারের ধরন-ধারণ সেই মাত্রাজ্ঞান ছাড়িয়ে যায়। আপত্তি সেইখানে। আমি কেবল রাজনীতিকদের কথাই বলছি না; অন্যদের ক্ষেত্রেও মাত্রাজ্ঞানের অভাব লক্ষণীয়। বহু ঘটনা চোখে পড়ে_ কবে কোন বেসরকারি কলেজে ৬ মাস প্রভাষকের কাজ করেছিলেন, তিনি নামের আগে দিব্যি অধ্যাপক লাগিয়ে বসে আছেন। এভাবেই কেউ লাগিয়েছেন অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ। এ ক্ষেত্রে কেউ সাবেক হচ্ছেন না। শুনেছি, বিচারপতিদের ক্ষেত্রে নাকি সাবেক শব্দটি বসে না। এখন দেখছি, কোনো ক্ষেত্রেই কেউ সাবেক হচ্ছেন না। সংবাদপত্র অফিসে এমন ফোনও পেয়েছি_ আমার নিবন্ধ ছাপিয়েছেন, কিন্তু নামের আগে ডক্টরটি কেন বসাননি? কিংবা ব্যারিস্টার পরিচয় যার, তাকে আইনজীবী বলায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন_ এমন উদাহরণও দেখেছি। নিবন্ধের গুণমান বা মুন্সিয়ানায় নয়, পদ-পদবি তুলে ধরার মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশে আগ্রহী অনেক লেখক। পশ্চিমবঙ্গের প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ব্যারিস্টার ছিলেন_ তা ক'জন জানতেন? আমাদের দেশেও এমন দুই-চারজন হয়তো পাওয়া যাবে।
এখানে নামের সঙ্গে পারিবারিক পদবিটি অনেক ক্ষেত্রে আভিজাত্যের ব্যাপার। এমনকি সমাজে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পদবি বদলিয়ে সবার দৃষ্টি কাড়ার নজিরও আছে। মধ্যযুগেও এভাবে অনেকেই অভিজাত শ্রেণীতে নাম লেখাত। এ ব্যাপারে সে সময়ের এক ফার্সি কবির একটি কবিতা উদৃব্দত করতে চাই_ 'পেশ আজ ইন কাসাব বুদেঁ/বাদাজান গুসতেঁ শৈখ/খালচু আরজান শাওয়াদ/ইসসাল সৈয়দ মেশ ওঁয়ে।' এর অর্থ_ 'প্রথম বছরে আমরা কসাই ছিলাম, পরের বছর শেখ, এ বছর যদি ফসলের দাম পাই তাহলে আমরা সৈয়দ হবো।'
সমাজে আত্মপ্রচারের প্রবণতা নতুন নয়। কিন্তু আমরা তো সভ্যতার দিকে এগোচ্ছি; গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে শাণিত হতে চাইছি। সেখানে কেন মাত্রাজ্ঞানহীন আত্মপ্রচারে নামব? আর যে রাজনীতিকরা দেশকে নেতৃত্ব দেয়, পথ দেখায়; তাদের মধ্যে যদি রুচিহীন, সামন্তসুলভ আত্মপ্রচারের ভড়ং দেখি, তবে জাতি তাদের কাছ থেকে কী শিক্ষা পাবে_ সেটিই ভাববার বিষয়।

আবু সাঈদ খান :সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com

No comments

Powered by Blogger.