উন্নয়ন-বৈশ্বিক অর্থনীতি ও আমাদের নতুন ভাবনা by আবুল বারকাত

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির অষ্টাদশ দ্বিবার্ষিক সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় 'বৈশ্বিক অর্থনীতি ও রূপকল্প ২০২১' (Global Economy and Vision 2021)|)। 'রূপকল্প ২০২১' একটি উন্নয়ন দর্শন_ দেশের মাটি উত্থিত উন্নয়ন দর্শন। 'রূপকল্প ২০২১'-এর স্বপ্ন হলো মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর পূর্তির বাংলাদেশ হবে 'অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল,


উদার গণতান্ত্রিক কল্যাণ রাষ্ট্র', ২০২১-এর বাংলাদেশ হবে 'স্বল্প বৈষম্যপূর্ণ মধ্য আয়ের দেশ'; ২০২১-এর বাংলাদেশ হবে 'জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি সমৃদ্ধ মানুষের শান্তির বাংলাদেশ'।
এ স্বপ্নকল্প যখন বিনির্মাণ করা হয়েছিল তখন যুক্তিযুক্ত কারণেই ধরে নেওয়া হয়েছিল যে, বিষয়টি শুধু আমাদের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির বিষয় নয়; এর সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত বৈশ্বিক অর্থনীতির গতিপ্রবাহ। সুতরাং সঙ্গত কারণেই এ দুয়ের আন্তঃসম্পর্ক আমাদের বুঝতে হবে এবং সে অনুযায়ী নীতি-কৌশল প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
বৈশ্বিক অর্থনীতির গতিপ্রবাহ যা আমরা দেখছি তাতে মনে হয় অন্যদের comparative-disadvantage (তুলনামূলক অসুবিধা)গুলো বোঝা দরকার এবং সেসবে আমাদের comparative advantage (তুলনামূলক সুবিধা) থাকলে তা বিকশিত হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া দরকার। আর এ কর্মকাণ্ডটি জ্ঞানসংশিল্গষ্ট; সচেতন পরিকল্পনা-নীতি প্রণয়ন সংশিল্গষ্ট। আমার মনে হয়েছে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিকল্প উন্নয়ন চিন্তা হিসেবে যে ধারণা-কাঠামো গত বছর জাতিসংঘে উপস্থাপন করেছেন এবং যা জাতিসংঘভুক্ত ১৮৯ দেশ গ্রহণ করেছে তা আত্মস্থকরণ জরুরি। তত্ত্বটি ÔPeople’s empowerment- mediated development and peace modelÕ (জনগণের ক্ষমতায়ন-মধ্যস্থতাকারী উন্নয়ন ও শান্তির মডেল)।
বেশ জোর দিয়েই এখন বলা যায় যে, বৈশ্বিক অর্থনীতিতে এখন টালমাটাল অবস্থা; 'বাণিজ্য চক্রে' মন্দাবস্থা প্রলম্বিত হচ্ছে; ভবিষ্যৎ প্রক্ষেপণ সহজ নয়। বিশ্ব অর্থনীতি ২০০৮-০৯-এর বৈশ্বিক মন্দার পর থেকে মন্দা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই_ অনেকের মতে, আরও বড়মাপের, গভীর এবং সম্ভবত দীর্ঘমেয়াদের মন্দার দিকে যাচ্ছে।
অভিন্ন মুদ্রা ব্যবহারকারী ১৭টি দেশ নিয়ে যে ইউরোজোন তা আবারও মন্দার দিকে ধাবমান। ইউরোপের সার্বভৌম ঋণ সংকট বিশ্ব অর্থনীতির স্থিতিশীলতার বড় বাধা। গ্রিস থেকে সংকট শুরু হয়ে অর্থাৎ 'প্রান্তস্থ সার্বভৌম' থেকে এখন তা কেন্দ্রের দিকে (অর্থাৎ core countries) যেমন জার্মানি ও ফ্রান্সের দিকে ধাবমান।
মার্কিন যুুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ২০০৮-০৯-এর মন্দা থেকে এখনও উঠে দাঁড়াতে পারেনি। পারছে না। যুুক্তরাষ্ট্রে সরকারি ব্যয় কমছে, মার্কিন কংগ্রেস সংশিল্গষ্ট বাজেট পাস করছে না_ প্রবৃদ্ধি কমছে, বেকারত্ব বাড়ছে। দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক মন্দার ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে ইতিমধ্যেই দেখা যাচ্ছে চাহিদার সংকোচন। এসব অর্থনীতি যেহেতু আমাদের প্রধান রফতানি বাজার সেহেতু সঙ্গত কারণেই আমাদের রফতানিকারকরা উদ্বিগ্ন (জুলাই ২০১২-র রফতানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৪.২৬%) অর্থাৎ ভবিষ্যতে রফতানি বাজারের বৈচিত্র্য এবং একই সঙ্গে নতুন গন্তব্য নিয়ে ভাবতে হবে। অতএব যা দাঁড়াচ্ছে তা হলো, একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপে চাহিদা সংকোচনের অভিঘাত নিয়ে ভাবতে হবে, আবার একই সঙ্গে আমাদের দেশের ১৬ কোটি মানুষের অভ্যন্তরীণ বাজার কীভাবে আরও বিকশিত করা যায়_ সেটাও ভাবতে হবে।
বৈশ্বিক অর্থনীতির আর্থিক সংকট , মন্থরগতি, আর ইউরোপের ঋণ সংকট_ সব মিলিয়ে বৈশ্বিক বাণিজ্যের গতি মন্থর হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের প্রক্ষেপণ অনুযায়ী আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রবৃদ্ধির হার ২০১১ সালের ৫.৯% থেকে ২০১২ সালে কমে দাঁড়াবে ৩.৮%-এ।
অন্যদিকে অগ্রসর উদীয়মান অর্থনীতি অর্থাৎ ইজওঈঝ_ ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা_ যারা কয়েক বছর সজোরে ছুটছিল তাদের ছোটার গতি কমে যাচ্ছে। সবারই প্রবৃদ্ধির হার কমে গেছে। এপ্রিল-জুন (২০১২) কোয়ার্টারে চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল গত ৩ বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে। অর্থাৎ আপাতত ইজওঈঝ-এর বাজার ধরা কঠিন।
বিশ্ববাজারে বিভিন্ন কঁাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্যের দামে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। দেখা দিয়েছে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়া নিয়ে নতুন উদ্বেগ। যুক্তরাষ্ট্রের খরা খাদ্য মূল্যস্টম্ফীতি বাড়াবে। অনেকের মতে, বিশ্ব এ বছর ২০০৭-০৮-এর মতো একটা খাদ্য সংকটের দিকে এগোচ্ছে।
জনশক্তি রফতানির সুযোগ ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হচ্ছে। 'মধ্যপ্রাচ্যের বসন্ত' এখন অনেকের জন্যই মরা কার্তিক। লিবিয়া ও সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ_ জনশক্তি রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ইরানের নিউক্লিয়ার সংকট উদ্ভূত অর্থনৈতিক অবরোধের প্রভাবও নেতিবাচক।
সব মিলিয়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে বড়মাপের অনিশ্চয়তা, অস্থিতিশীলতা, টানাপড়েন অবস্থা প্রক্ষেপণ করা যায়। বৈশ্বিক অর্থনীতির মন্দা, অস্থিতিশীলতা ও সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ চিত্র_ আপাতত আশা সঞ্চারকারী কোনো বার্তা দেয় না। এদিকে আমাদের দেশে প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থের প্রবৃদ্ধি কমছে। লিবিয়া থেকে ফেরত এসেছে ৫০ হাজার শ্রমিক; সৌদি আরব নতুন শ্রমশক্তি নিচ্ছে না আর পুরনোদের নবায়নও করছে না; মালয়েশিয়া ইস্যু এখনও সমাধান হয়নি; শ্রমশক্তি রফতানির নতুন গন্তব্যস্থল এখনও মেলেনি। ২০১২ অর্থবছরে প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি ছিল ১০.২৪%।
বিশ্বপণ্য বাজারে দামের অস্থিরতার কারণে আমাদের খাদ্য আমদানি ব্যয় বাড়বে; খাদ্য মূল্যস্টম্ফীতি বাড়বে। আর বিশ্ববাজারে শিল্পের কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্যের দাম বাড়ছে_ যার ফলে আমাদের সংশিল্গষ্ট উৎপাদন ব্যয় বাড়বে এবং প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমবে।
এই-ই যখন বৈশ্বিক অর্থনীতির দৃশ্যপট তখন আমাদের যা করতে হবে তা হলো, বুঝতে হবে চিরাচরিত-প্রচলিত চিন্তা দিয়ে হবে না; ওই পথে হেঁটে লাভ হবে না। আমাদের নতুন ভাবনা ভাবতে হবে।
আমাদের ভাবতে হবে সম্পদের নতুন ব্যবস্থাপনা নিয়ে; সম্পদ সৃষ্টি, পুনর্সৃষ্টি ও ব্যবহারের নতুন ভাবনা ভাবতে হবে। সম্পদ বলতে আমি বোঝাচ্ছি মানবসম্পদ (১৬ কোটি মানুষ), প্রাকৃতিক সম্পদ (অর্থাৎ মাটির ওপরের ও তলার সম্পদ, পানির মধ্যে এবং পানির নিচের সম্পদ, আকাশ-বাতাস-মহাকাশ সম্পদ), ভৌত সম্পদ।
মানুষ যেহেতু খাদ্য খাবার খাবেই, যেহেতু খাদ্য চাহিদা বিশ্বের জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে-বাড়বে এবং যেহেতু কৃষিতে আমাদের নিরঙ্কুশ তুলনামূলক সুবিধা আছে, সেহেতু নতুন ভাবনা দরকার কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প বিকাশ নিয়ে_ যাতে দেশের মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি আমরা যেন খাদ্য নিয়ে বিশ্ববাজারে প্রবেশ করতে পারি। এ ক্ষেত্রে নতুন ভাবনা ভাবতে হবে আমাদের জমি-জলা-জঙ্গল-জনমানুষ নিয়ে আর সেই সঙ্গে সংশিল্গষ্ট বিজ্ঞান-প্রযুক্তি নিয়ে।
নতুন করে ভাবতে হবে অন্যদের তুলনামূলক অসুবিধাগুলো বিবেচনায় এনে আমাদের তুলনামূলক সুবিধাগুলো কীভাবে সর্বোচ্চ মাত্রায় নেওয়া যায় সে সম্পর্কে।
ভাবতে হবে শ্রমশক্তির দক্ষতা ও উৎকর্ষতা বৃদ্ধির পথ-পদ্ধতি নিয়ে!
ভাবতে হবে প্রাকৃতিক তন্তু_ পাট অর্থনীতির বিকাশ নিয়ে!
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির অষ্টাদশ দ্বিবার্ষিক সম্মেলন ২০১২-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতির ভাষণ

ড. আবুল বারকাত : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.