বুয়েট ও সব বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের প্রতি by মমতাজ লতিফ
শুরুতে বুয়েট-শিক্ষার্থীদের বলছি। তোমাদের একটি রক্ত হিম করা প্রতিবাদ কৌশল টেলিভিশনে দেখে সেদিন আমার বুকের হৃদস্পন্দন স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছিল, দু’ হাতের লোম খাড়া হয়ে গিয়েছিল এবং মনের মধ্যে সেই ‘৭১-এর নবেম্বর, ডিসেম্বরে বিজয়ের আগ মুহূর্তে খুনী আলবদরদের রক্তাক্ত ও হিংস্র নানা ধরনের নির্যাতন, হত্যা, গুমের কথা মনে পড়ে
গিয়েছিল! আমি মনে করেছিলাম তোমাদের এই অ-মানবিক ‘রক্তাক্ত’ প্রতিবাদটি নিয়ে প্রিন্ট মিডিয়ায় সম্পাদকীয়তে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় টক শো’তে সুশীল সমাজ সমালোচনায় মুখর হবে। কিন্তু তা হয়নি। তোমাদের মনে হতে পারে ‘আমরা তো মারামারি করিনি, কাউকে খুন বা রক্তাক্ত করিনি, আপনার আমাদের ঐ কাজটি এতটা ঘৃণ্য মনে হলো কেন।’ এই প্রেক্ষিতে তোমাদের আমার প্রজন্ম, যারা মুক্তিযুদ্ধ পূর্বের আন্দোলন করেছিল, যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিল, সেই প্রজন্মের একজন হিসেবে কিছু বলার আছে।
১. প্রথমেই বলি, ‘৭১-কে, এর ইতিহাসকে ধারণ করা, এতে যোগ দান করা অসংখ্য চে-গুয়েভারার মতন বীর বাঙালীর কীর্তিতে গৌরব বোধ এবং একই সঙ্গে ‘৭১-এর বাঙালীর ঘাতক, খুনীদের ঘৃণা করা স্বাধীন দেশের প্রত্যেক নাগরিকের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। জেনে রাখ, পৃথিবীর কোন দেশে ঘাতক ও ঘাতক দল নাগরিক অধিকার ভোগ করে না। রাজনীতি করা যেমন তাদের জন্য নিষিদ্ধ, তেমনি তাদের ভোটাধিকারও থাকে না। প্রশাসন বা নিরাপত্তা বাহিনীতে তাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। এ নিয়ম ন্যায় বিচার ও সুশাসনকে নিশ্চিত করে নিরপরাধ ও এদের হাতে নির্যাতিত মানুষকে রক্ষার জন্য প্রণীত হয়েছে। এভাবেই দেশে দেশে স্বাধীনতাবিরোধীরা বিচারে দ-িত হয়েছে এবং সমাজ ন্যায় বিচার ভিত্তিক সুস্থ স্বাভাবিক রাষ্ট্রের জন্ম দিতে সক্ষম হয়েছে। এর একমাত্র ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। শত শত প্রয়োজনীয় কার্যক্রম সম্পন্ন ও পরিচালনা করার সময় ‘৭১ থেকেই চলতে থাকা জামায়াত, সিআইএ ও পাকিস্তানের যোগসাজশে স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় ঐ ‘৭১-এর আলবদরদের লক্ষ্য পূরণে ঐ একই মনোভাবাপন্ন সেনাদের হাতে নিহত হন বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সরকারের প্রধান চার মন্ত্রী এবং মুক্তিযুদ্ধের সফল প্রধান পরিচালক তাজউদ্দিন আহমদসহ চার জাতীয় নেতা। মনে কর, ‘৭১-এর পরাজয়ের প্রতিশোধ জামায়াত ও পাকিস্তান ’৭৫-এ নিয়েছিল। এর পর ‘৭৬/৭৭ থেকে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বধীনতা আন্দোলনের নেতাদের নাম ও এঁদের অবদান মুছে ফেলা হলো, বিশ-এর বেশি ‘ক্যু’-এর নামে সেনা মুক্তিযোদ্ধা প্রায় ৪০০০ জনকে ফাঁসি ও গুলি করে হত্যা করা হয়! সেনাবাহিনীতে জিয়া কর্তৃক যে ‘মুক্তিযোদ্ধা ক্লিনজিং’ চলছিল তা বন্ধ করতে সে সময়ের শ্বাসরুদ্ধকর বদ্ধ পরিবেশে আশ্চর্য হলেও সত্য যে, কোন দেশী নয়, বিদেশী সাংবাদিক লরেন্স লিফ্শুল্জ, যিনি কর্নেল তাহের হত্যার বিচারে সাক্ষ্য দেন, তিনিই যুক্তরাজ্যের মানবাধিকার সংস্থার বিখ্যাত জ্যেষ্ঠ মানবাধিকার কর্মকর্তাকে (নামটি মনে পড়ছেনা) এ দেশে এসে প্রেসিডেন্ট জিয়াকে মুক্তিযোদ্ধা হত্যা বন্ধ করতে একরকম হুমকি দিতে সম্মত করান। এ বিনা বিচারে গুপ্ত হত্যা বন্ধ না করলে এ বিষয়ে সংগৃহীত সব তথ্য বিশ্বময় প্রকাশ করে দেবার কথাও তাঁকে বলার কথা হয়। ঐ মানবাধিকার কর্মকর্তা বহু কষ্টে জিয়ার সঙ্গে একটি এ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে সক্ষম হন এবং এ দেশে এসে প্রেসিডেন্ট জিয়াকে সরাসরি এ মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে কথা বলে ঐ হুমাকি দেন। এভাবে মুক্তিযোদ্ধা ক্লিনজিং বন্ধ হয়! মনে রাখতে হবে ‘৭১-এ জামায়াতের আলবদর, রাজাকাররা যেমন বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে আমাদের বাঙালী বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক চিকিৎসক, আইনজীবী, প্রশাসক, রাজনীতিক, সাংবাদিকদের হত্যা করে, তেমনি ‘৭৫-এও ঐ দলের অনুসারীরাই বাঙালীর প্রধান নেতাদের হত্যা করে, ‘৭৭-এও কীর্তিমান সেনা মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করা হয় এবং ৭৭ থেকে ৮০ পর্যন্ত প্রায় চার হাজার সেনা মুক্তিযোদ্ধাকে সেনা নিবাসে গোপন ‘ক্যু’র নামে জিয়াউর রহমান হত্যা করে, ‘৮৩ সালে জিয়া হত্যার নামে তেরো জন নিরপরাধ কীর্তিমান সেনা অফিসারকে সেনাবাহিনীর ‘শৃঙ্খলা ভঙ্গের’ অজুহাতে কোর্ট মার্শালে ফাঁসি দেয় প্রেসিডেন্ট এরশাদ! জিয়া হত্যার বিচার কিন্তু করেননি তিনি।
তাহলে দেখা যাচ্ছে সংঘটিত সব গুম, খুন, ফাঁসি, গোপন বিচার, বিচারের রায় বদলে কর্নেল তাহের হত্যা ক্যু’র নামে ৭ই নবেম্বর ’৭৭, ’৮১ সালে জিয়া হত্যার পর মঞ্জুর হত্যা, এরপর ‘৮৩ সালে তেরো মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুদ- সব ঘটনাতেই প্রাণ হারিয়েছে মুক্তিযুদ্ধে অমূল্য অবদান রাখা বীর মুক্তিযোদ্ধারা! এমন কি বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তারাও নিহত হয়েছেন ’৭৭ সালে!
সুতরাং প্রতিবাদের ভাষায় যখন বুয়েট শিক্ষার্থীদের সিরিঞ্জে কোন শিক্ষার্থীর শরীর থেকে রক্ত বের করে সে রক্ত সিঁড়িতে ছড়িয়ে দিতে দেখি তখন ’৭১ থেকে ’৮৩ পর্যন্ত বাংলাদেশের শত্রুদের হাতে তৈরি উপরোক্ত দীর্ঘ রক্তপাতের ইতিহাস স্মরণে এসে আমাকে স্তম্ভিত করে দেয়। প্রথমত এ ধরনের নিষ্ঠুর রক্তাক্ত ‘প্রতিবাদ’ উচ্চ শিক্ষাক্ষেত্রের শিক্ষার্থীদের বা নিরক্ষর, অল্প শিক্ষিতদের মধ্যেও এর আগে কখনও দেখা যায়নি। দ্বিতীয়ত এ ‘কাজটি’র ধারণার মধ্যে নিহিত আছে ‘রক্তপাতের’ সূক্ষ্ম ঈঙ্গিত, যা যে কোন সাধারণ, স্বাভাবিক ও সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের প্রতিবাদের কৌশল বা ভাষা নয়। কোন সুস্থ মানসিকতার শিক্ষার্থী এ ধরনের অস্বাভাবিক প্রতিবাদের কথা ভাবতে পারে না বলেই সবাই, যাদের সঙ্গে কথা হয়েছে, মনে করেন।
উপরে যে সব গুম, খুন ও হত্যার যে সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বলা হয়েছে, তাতে সব উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের নিজস্ব আদর্শ ও বিশ্বাস তৈরির উপদান রয়েছে যা গরিব কৃষক শ্রমিকের উৎপাদন, শ্রম, ঘাম দিয়ে তৈরি সেবা ও জনগণের করের অর্থে অনেক কম মূল্যে এ শিক্ষাগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের স্মরণে রাখতে হবে।
উচ্চ শিক্ষার শিক্ষার্থীদের মনে রাখতে হবেÑ যে কোন দেশের রাজনীতির সুস্থ স্বাভাবিক ধারায় যত দলই থাকুক না কেন, সব দলের মূল আনুগত্য থাকে স্বদেশের স্বাধীনতার বীরদের অবদান ও স্বদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের প্রতি। পৃথিবীর দেশে দেশে উচ্চ শিক্ষার শিক্ষার্থীদের মধ্যে যুদ্ধাপরাধী বা স্বদেশের স্বাধীনতার বিরোধী পক্ষের প্রতি সমর্থন নেই, একমাত্র সীমিত কিছু সংখ্যক জঙ্গী, নাশকতাকারী এরা ছাড়া বিপুল অর্থের বিনিময়ে ভাড়াটে অপরাধমূলক কাজ করে যে ধারাটি অসুস্থ এবং অস্বাভাবিক, উচ্চ শিক্ষার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যুদ্ধাপরাধীদের দলের অস্তিত্ব যেমন থাকার কথা নয়, তেমনি যুদ্ধাপরাধী সমর্থক দলেরও অস্তিত্ব থাকার কথা নয়Ñ এটি মনে রাখতে হবে ।
উচ্চ শিক্ষা গ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত হবে মুক্তিযদ্ধের মূল চেতনাÑ ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, বাঙালী জাতীয়তাবাদ ও অসাম্প্রদায়িকতা এবং সমাজতন্ত্র। তারা স্বদেশের স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক মুক্তিযুদ্ধের নেতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দেশের সর্বোচ্চ সম্মানিত নাগরিক হিসেবে মান্য করবে। তাদের সব কাজের মূলে থাকবে দেশপ্রেম। তারা শাসক হিসেবে অন্য সব দেশের নাগরিকদের মতোই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দলকে সুরক্ষিত রাখার পক্ষে নাগরিক দায়িত্ব পালন করবে, পক্ষান্তরে স্বদেশের স্বাধীনতা মুক্তিযদ্ধের চেতনা বিরোধীদের রাজনীতি করার সুযোগ বন্ধে কাজ করবে। সমগ্র ইউরোপে নাজি দল ২য় মহাযুদ্ধের পর থেকে নিষিদ্ধ আছে। এ কথা স্মরণ রাখতে হবে। শোনা যায় উচ্চশিক্ষাঙ্গনে হিযবুত তাহ্রীর ও জামায়াতের অবস্থান রয়েছে, যা উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারীদের জন্য অসম্মান ও অপমানজনক। এ অসম্মান ও অপমানের কালিমা তোমাদেরই দূর করতে হবে। উচ্চ শিক্ষা তোমাদের বোমা, গ্রেনেড বানাতে বা নিজ রাষ্ট্র ধ্বংসে যেন টেনে নিতে না পারে বরং স্বদেশের বিদ্যুত, রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ বানানো, পরিবেশকে দূষণমুক্ত করা, উচ্চ ফলনশীল শস্য, ফল, শাক-সবজি ফলানো, প্রাকৃতিক সার তৈরি, সহজে গণিত, বিজ্ঞান ও ভাষা শিক্ষার পদ্ধতি আবিষ্কারসহ রাষ্ট্রের উন্নয়নের সব ক্ষেত্রে অবদান রাখতে হবে, নেতিবাচক নয় ইতিবাচক কাজ করে দেশ ও জাতির সেবা করবে এবং নিজ কীর্তিতে গৌরবান্বিত হবে। তোমরা নিশ্চয় লক্ষ্য করেছ, আমাদের তরুণ প্রজন্ম চে গুয়েভাবার ছবিসহ টি-শাট পছন্দ করে, হিটলারের নয়। এর অর্থ, পৃথিবীর ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ ভিন্ন দেশের গণতন্ত্রকামী ফ্যাস্টিসবিরোধী, বিপ্লবীকেও মান্য করে, সম্মান করে। তারা আলেন্দেকে সম্মান করে, পিনোচেটকে ঘৃণা করে। নিশ্চয় তোমারাও সভ্যতার পথ ধরে স্বদেশের নেতা বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দিন, সৈয়দ নজরুল, মনসুর আলী, কামরুজ্জামানদের সম্মান করবে। গোলাম আযম, নিজামী, মুজাহিদদের ঘৃণা করবে।
১. প্রথমেই বলি, ‘৭১-কে, এর ইতিহাসকে ধারণ করা, এতে যোগ দান করা অসংখ্য চে-গুয়েভারার মতন বীর বাঙালীর কীর্তিতে গৌরব বোধ এবং একই সঙ্গে ‘৭১-এর বাঙালীর ঘাতক, খুনীদের ঘৃণা করা স্বাধীন দেশের প্রত্যেক নাগরিকের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। জেনে রাখ, পৃথিবীর কোন দেশে ঘাতক ও ঘাতক দল নাগরিক অধিকার ভোগ করে না। রাজনীতি করা যেমন তাদের জন্য নিষিদ্ধ, তেমনি তাদের ভোটাধিকারও থাকে না। প্রশাসন বা নিরাপত্তা বাহিনীতে তাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। এ নিয়ম ন্যায় বিচার ও সুশাসনকে নিশ্চিত করে নিরপরাধ ও এদের হাতে নির্যাতিত মানুষকে রক্ষার জন্য প্রণীত হয়েছে। এভাবেই দেশে দেশে স্বাধীনতাবিরোধীরা বিচারে দ-িত হয়েছে এবং সমাজ ন্যায় বিচার ভিত্তিক সুস্থ স্বাভাবিক রাষ্ট্রের জন্ম দিতে সক্ষম হয়েছে। এর একমাত্র ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। শত শত প্রয়োজনীয় কার্যক্রম সম্পন্ন ও পরিচালনা করার সময় ‘৭১ থেকেই চলতে থাকা জামায়াত, সিআইএ ও পাকিস্তানের যোগসাজশে স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় ঐ ‘৭১-এর আলবদরদের লক্ষ্য পূরণে ঐ একই মনোভাবাপন্ন সেনাদের হাতে নিহত হন বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সরকারের প্রধান চার মন্ত্রী এবং মুক্তিযুদ্ধের সফল প্রধান পরিচালক তাজউদ্দিন আহমদসহ চার জাতীয় নেতা। মনে কর, ‘৭১-এর পরাজয়ের প্রতিশোধ জামায়াত ও পাকিস্তান ’৭৫-এ নিয়েছিল। এর পর ‘৭৬/৭৭ থেকে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বধীনতা আন্দোলনের নেতাদের নাম ও এঁদের অবদান মুছে ফেলা হলো, বিশ-এর বেশি ‘ক্যু’-এর নামে সেনা মুক্তিযোদ্ধা প্রায় ৪০০০ জনকে ফাঁসি ও গুলি করে হত্যা করা হয়! সেনাবাহিনীতে জিয়া কর্তৃক যে ‘মুক্তিযোদ্ধা ক্লিনজিং’ চলছিল তা বন্ধ করতে সে সময়ের শ্বাসরুদ্ধকর বদ্ধ পরিবেশে আশ্চর্য হলেও সত্য যে, কোন দেশী নয়, বিদেশী সাংবাদিক লরেন্স লিফ্শুল্জ, যিনি কর্নেল তাহের হত্যার বিচারে সাক্ষ্য দেন, তিনিই যুক্তরাজ্যের মানবাধিকার সংস্থার বিখ্যাত জ্যেষ্ঠ মানবাধিকার কর্মকর্তাকে (নামটি মনে পড়ছেনা) এ দেশে এসে প্রেসিডেন্ট জিয়াকে মুক্তিযোদ্ধা হত্যা বন্ধ করতে একরকম হুমকি দিতে সম্মত করান। এ বিনা বিচারে গুপ্ত হত্যা বন্ধ না করলে এ বিষয়ে সংগৃহীত সব তথ্য বিশ্বময় প্রকাশ করে দেবার কথাও তাঁকে বলার কথা হয়। ঐ মানবাধিকার কর্মকর্তা বহু কষ্টে জিয়ার সঙ্গে একটি এ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে সক্ষম হন এবং এ দেশে এসে প্রেসিডেন্ট জিয়াকে সরাসরি এ মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে কথা বলে ঐ হুমাকি দেন। এভাবে মুক্তিযোদ্ধা ক্লিনজিং বন্ধ হয়! মনে রাখতে হবে ‘৭১-এ জামায়াতের আলবদর, রাজাকাররা যেমন বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে আমাদের বাঙালী বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক চিকিৎসক, আইনজীবী, প্রশাসক, রাজনীতিক, সাংবাদিকদের হত্যা করে, তেমনি ‘৭৫-এও ঐ দলের অনুসারীরাই বাঙালীর প্রধান নেতাদের হত্যা করে, ‘৭৭-এও কীর্তিমান সেনা মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করা হয় এবং ৭৭ থেকে ৮০ পর্যন্ত প্রায় চার হাজার সেনা মুক্তিযোদ্ধাকে সেনা নিবাসে গোপন ‘ক্যু’র নামে জিয়াউর রহমান হত্যা করে, ‘৮৩ সালে জিয়া হত্যার নামে তেরো জন নিরপরাধ কীর্তিমান সেনা অফিসারকে সেনাবাহিনীর ‘শৃঙ্খলা ভঙ্গের’ অজুহাতে কোর্ট মার্শালে ফাঁসি দেয় প্রেসিডেন্ট এরশাদ! জিয়া হত্যার বিচার কিন্তু করেননি তিনি।
তাহলে দেখা যাচ্ছে সংঘটিত সব গুম, খুন, ফাঁসি, গোপন বিচার, বিচারের রায় বদলে কর্নেল তাহের হত্যা ক্যু’র নামে ৭ই নবেম্বর ’৭৭, ’৮১ সালে জিয়া হত্যার পর মঞ্জুর হত্যা, এরপর ‘৮৩ সালে তেরো মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুদ- সব ঘটনাতেই প্রাণ হারিয়েছে মুক্তিযুদ্ধে অমূল্য অবদান রাখা বীর মুক্তিযোদ্ধারা! এমন কি বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তারাও নিহত হয়েছেন ’৭৭ সালে!
সুতরাং প্রতিবাদের ভাষায় যখন বুয়েট শিক্ষার্থীদের সিরিঞ্জে কোন শিক্ষার্থীর শরীর থেকে রক্ত বের করে সে রক্ত সিঁড়িতে ছড়িয়ে দিতে দেখি তখন ’৭১ থেকে ’৮৩ পর্যন্ত বাংলাদেশের শত্রুদের হাতে তৈরি উপরোক্ত দীর্ঘ রক্তপাতের ইতিহাস স্মরণে এসে আমাকে স্তম্ভিত করে দেয়। প্রথমত এ ধরনের নিষ্ঠুর রক্তাক্ত ‘প্রতিবাদ’ উচ্চ শিক্ষাক্ষেত্রের শিক্ষার্থীদের বা নিরক্ষর, অল্প শিক্ষিতদের মধ্যেও এর আগে কখনও দেখা যায়নি। দ্বিতীয়ত এ ‘কাজটি’র ধারণার মধ্যে নিহিত আছে ‘রক্তপাতের’ সূক্ষ্ম ঈঙ্গিত, যা যে কোন সাধারণ, স্বাভাবিক ও সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের প্রতিবাদের কৌশল বা ভাষা নয়। কোন সুস্থ মানসিকতার শিক্ষার্থী এ ধরনের অস্বাভাবিক প্রতিবাদের কথা ভাবতে পারে না বলেই সবাই, যাদের সঙ্গে কথা হয়েছে, মনে করেন।
উপরে যে সব গুম, খুন ও হত্যার যে সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বলা হয়েছে, তাতে সব উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের নিজস্ব আদর্শ ও বিশ্বাস তৈরির উপদান রয়েছে যা গরিব কৃষক শ্রমিকের উৎপাদন, শ্রম, ঘাম দিয়ে তৈরি সেবা ও জনগণের করের অর্থে অনেক কম মূল্যে এ শিক্ষাগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের স্মরণে রাখতে হবে।
উচ্চ শিক্ষার শিক্ষার্থীদের মনে রাখতে হবেÑ যে কোন দেশের রাজনীতির সুস্থ স্বাভাবিক ধারায় যত দলই থাকুক না কেন, সব দলের মূল আনুগত্য থাকে স্বদেশের স্বাধীনতার বীরদের অবদান ও স্বদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের প্রতি। পৃথিবীর দেশে দেশে উচ্চ শিক্ষার শিক্ষার্থীদের মধ্যে যুদ্ধাপরাধী বা স্বদেশের স্বাধীনতার বিরোধী পক্ষের প্রতি সমর্থন নেই, একমাত্র সীমিত কিছু সংখ্যক জঙ্গী, নাশকতাকারী এরা ছাড়া বিপুল অর্থের বিনিময়ে ভাড়াটে অপরাধমূলক কাজ করে যে ধারাটি অসুস্থ এবং অস্বাভাবিক, উচ্চ শিক্ষার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যুদ্ধাপরাধীদের দলের অস্তিত্ব যেমন থাকার কথা নয়, তেমনি যুদ্ধাপরাধী সমর্থক দলেরও অস্তিত্ব থাকার কথা নয়Ñ এটি মনে রাখতে হবে ।
উচ্চ শিক্ষা গ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত হবে মুক্তিযদ্ধের মূল চেতনাÑ ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, বাঙালী জাতীয়তাবাদ ও অসাম্প্রদায়িকতা এবং সমাজতন্ত্র। তারা স্বদেশের স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক মুক্তিযুদ্ধের নেতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দেশের সর্বোচ্চ সম্মানিত নাগরিক হিসেবে মান্য করবে। তাদের সব কাজের মূলে থাকবে দেশপ্রেম। তারা শাসক হিসেবে অন্য সব দেশের নাগরিকদের মতোই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দলকে সুরক্ষিত রাখার পক্ষে নাগরিক দায়িত্ব পালন করবে, পক্ষান্তরে স্বদেশের স্বাধীনতা মুক্তিযদ্ধের চেতনা বিরোধীদের রাজনীতি করার সুযোগ বন্ধে কাজ করবে। সমগ্র ইউরোপে নাজি দল ২য় মহাযুদ্ধের পর থেকে নিষিদ্ধ আছে। এ কথা স্মরণ রাখতে হবে। শোনা যায় উচ্চশিক্ষাঙ্গনে হিযবুত তাহ্রীর ও জামায়াতের অবস্থান রয়েছে, যা উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারীদের জন্য অসম্মান ও অপমানজনক। এ অসম্মান ও অপমানের কালিমা তোমাদেরই দূর করতে হবে। উচ্চ শিক্ষা তোমাদের বোমা, গ্রেনেড বানাতে বা নিজ রাষ্ট্র ধ্বংসে যেন টেনে নিতে না পারে বরং স্বদেশের বিদ্যুত, রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ বানানো, পরিবেশকে দূষণমুক্ত করা, উচ্চ ফলনশীল শস্য, ফল, শাক-সবজি ফলানো, প্রাকৃতিক সার তৈরি, সহজে গণিত, বিজ্ঞান ও ভাষা শিক্ষার পদ্ধতি আবিষ্কারসহ রাষ্ট্রের উন্নয়নের সব ক্ষেত্রে অবদান রাখতে হবে, নেতিবাচক নয় ইতিবাচক কাজ করে দেশ ও জাতির সেবা করবে এবং নিজ কীর্তিতে গৌরবান্বিত হবে। তোমরা নিশ্চয় লক্ষ্য করেছ, আমাদের তরুণ প্রজন্ম চে গুয়েভাবার ছবিসহ টি-শাট পছন্দ করে, হিটলারের নয়। এর অর্থ, পৃথিবীর ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ ভিন্ন দেশের গণতন্ত্রকামী ফ্যাস্টিসবিরোধী, বিপ্লবীকেও মান্য করে, সম্মান করে। তারা আলেন্দেকে সম্মান করে, পিনোচেটকে ঘৃণা করে। নিশ্চয় তোমারাও সভ্যতার পথ ধরে স্বদেশের নেতা বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দিন, সৈয়দ নজরুল, মনসুর আলী, কামরুজ্জামানদের সম্মান করবে। গোলাম আযম, নিজামী, মুজাহিদদের ঘৃণা করবে।
No comments