প্যারালিম্পিক ২০১২- মানবের সক্ষমতার মান by শামীম আজাদ

শেষ হলো প্যারালিম্পিক ২০১২। টিকিট বিক্রি হয়েছে ২ দশমিক ৩ মিলিয়ন। বেইজিংয়ের চেয়ে অনেক বেশি। সবচেয়ে বড় কথা, এই প্যারালিম্পিক বিলেতের মানুষকে সুখী হতে শিখিয়েছে। ‘একজন মানুষ হিসেবে না পারার ব্যাপারগুলো এক পাশে ঠেলে কী কী পারা যায় এবং কীভাবে সেই পারাকে আরও উত্তম পর্যায়ে পৌঁছানো যায়, আমরা তার প্রমাণ


রেখেছি।’ কথাগুলো বলেন চলমান হুইলচেয়ার থেকে অলিম্পিক স্বেচ্ছাসেবক ক্রিস কুক। তখন কাছেই এক বন্দুকধারী নেপালি ব্রিটিশ মিলিটারি আমজনতার মধ্য থেকে একটি শিশুকে ধরে পার করে দিলেন পথ। গায়ে-মাথায় পতাকা জড়ানো এক তরুণীকে আরেক পাকিস্তানি সেবক স্কাউট ম্যাপ বুঝিয়ে দিতে লাগলেন আর এক শ্রীলঙ্কান তরুণী ভলান্টিয়ার দিলারা গুনারত্না আমার সঙ্গে কথা বলতে এগিয়ে এলেন। আমি তাঁর দিকে যেতে যেতে আরও দেখি, ঠিক আমার মাথার ওপরে ভাঁজ করা মইয়ের চূড়ায় বসে চোঙা লাগিয়ে এক ব্রিটিশকন্যা হাস্য ও লাস্যময়তায় সবাইকে স্টেডিয়ামের দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। তারই গোড়ায় এক বাংলাদেশি যুবক!
এঁরা সবাই একসঙ্গে এখানে স্বেচ্ছাসেবা দান করছেন। হুইলচেয়ার, সাদা ছড়ি, ইস্পাতের পা এবং সাধারণ গা কোনো ব্যাপারই নয়। যেদিকে তাকাই ভলান্টিয়ারের ভায়োলেট কালার ফুটে আছে। স্বাগত জানাচ্ছেন। সমানভাবে পিঠে ঝোলা নিয়ে সবাই যার যার মতো দর্শকদের সামাল দিচ্ছেন। কোথায় বিগ স্ক্রিন, কোথায় স্ট্রাটফোর্ডে নির্গমন পথ আর কোথায় বা অরবিট টিকিট— জাতপাত, ক্ষমতা-অক্ষমতা সব মিলিয়ে এ এক অনন্য ব্রিটেন।
আমি ঢুকব অ্যাথলেটিকস দেখতে। দিলারা তা দেখিয়ে দিতে দিতে বলেন তাঁর আদরের ১৫ বছরের একমাত্র ভাইয়ের কথা। সে পড়তে, লিখতে ও বলতে পারে কিন্তু শুনতে পারে না। ভাইটির জন্যই এখানে তিনি সাহায্য করতে এসেছেন। আর সে বড় হয়ে ১৯ বছরের হলে রিও অলিম্পিকে ভলান্টিয়ার হবে। আমি স্টেডিয়ামের ভেতরে সেলিব্রিটি খেলোয়াড় কী দেখব, এই চ্যাম্পিয়ানরাই আমাকে ক্রমেই ভাবুক করে তোলে।
ভাবতে ভাবতেই আমি আনীষ কাপুরের অদ্ভুত (ইউ লাভ অর হেইট, ইট ইজ দেয়ার) এক দঙ্গল ইস্পাতের বোঝা অলিম্পিক আইকন অরবিটের নিচে গিয়ে দাঁড়ালাম। এত কাছে থেকে আর এর এই লাল কামানের মতো পাইপের কাছে কি আসতে পারব! ওপরে তাকাতেই আর মাথায় মুগুর...হায় হায়, এ যে মহা এক আইফেল টাওয়ার! অমনই উঁচু। ১৫ পাউন্ডের টিকিট কেটে লিফ্ট দিয়ে লন্ডনের মাথায় ওঠা যায়। প্রতিবন্ধী প্রবেশ ও নির্গমনের দারুণ ব্যবস্থা। আর সেখানেও অন্য সবার মতো সেই ঘন বেগুনি টি-শার্ট আর পিঠে কালো ঝোলা নিয়ে সবার সঙ্গে কাজ করছেন অসাধারণ কম উচ্চতার একজন মানুষ।
যেকোনো দুর্ঘটনা, বৈজ্ঞানিক প্রতিক্রিয়া, কোনো মানবিক বিফলতা বা হয়তো সঠিক সময়ে কোনো নির্দিষ্ট কাজটি করা যায়নি, সেসব এবং আরও অনেক কারণে দেহগত অসুস্থতার উদয় হতেই পারে। আর তার ফলে দেহের কোনো একটা কিছু একটু অলস বা অবশ হয়েও যেতে পারে। যেভাবে দৃশ্যমানতা স্বাভাবিক দেখাচ্ছে, এমন দগদগে একটা মানুষও প্রতিনিয়ত একটা না একটা ক্ষমতা হারাচ্ছে। তারও প্রতিবন্ধিত্ব জাগছে আবার ঘুচছেও। দেখলাম, অন্তরের চক্ষু তাঁদের এমনই আলোকিত যে চক্ষুষ্মান মানুষের চেয়েও তাঁরা ভালো দেখেন। কী সাংঘাতিক ক্ষিপ্রতায় অন্ধ ফুটবল খেলোয়াড়েরা ছুটে গেছেন বল লক্ষ্য করে! কী তীব্র বেগে জল ভেদ করে অন্ধ সাঁতারু পৌঁছে গেছেন পুলের লক্ষ্যে! কীভাবে কচি ডানার মতো এক জোড়া হাত নিয়ে এলি সিমন্ড সাংঘাতিকভাবে সাঁতরে নিজের রেকর্ড ভাঙলেন, এক হাত ছাড়া কি মহা ক্ষিপ্রতায় সাইকেল চালিয়ে মার্ক লিক হোগান ইটির মতো আকাশে উড়ে এলেন, পায়ের ইস্পাতে দৌড়ে সোনা জিতলেন পিস্টরিও আর তাঁকেই আবার ছোটবেলায় পোলিওর জন্য পা হারানো পিকক ১০০ মিটারে হারালেন ব্রিটিশ আরেক তারকা। যাঁরা চোখে দেখেন না তাঁদের ঘিরে কত যে সহস্র শব্দ ছিল, জনতার চিৎকার, হইহই, শিশুর শব্দ, দূরের বাজনা, খেলা নির্দেশকের কথা, বাতাসের বারি, জলের ধাক্কা—এর সব থেকে তাঁর কানের ছাঁকনিতে তুলে নিয়েছেন তাঁর লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য অত্যাবশ্যকীয় যেটা, সেটাই। ছুটে গেছেন ‘অন্ধের মতো’ই।
স্টেডিয়ামের এদিক-সেদিক স্তরে স্তরে, স্তবকে স্তবকে মানুষ। সব সমান বয়সী শিশু লন্ডন প্লেইন বৃক্ষ ক্রমেই উজ্জ্বল জলপাই রং জ্বলজ্বল হয়ে উঠতে লাগল। আর বিগ স্ক্রিনের ধুম প্রতিযোগিতার স্বর্ণপ্রাপ্তি মুহুর্মুহু মানবতার ও বিজ্ঞানের জয় জয় তালি আমাকে ভাবনার আরেক স্তরে নিয়ে গেল।
এই প্যারালিম্পিকের শুরুতে নিউটনের কথা স্মরণ করে প্রাকৃতিক বিশ্বের কথা মনে করিয়ে দিতে একসঙ্গে ৮০ হাজার দর্শক এবং আরও ২০ হাজার স্বেচ্ছাসেবক একসঙ্গে আপেলে কামড় দিয়ে এক অনন্য ইতিহাস রচনা করেছেন। স্মরণ করিয়েছেন এ বিশ্বে সব সুবিধায় সবার সমান অধিকার। তারপর, বর্তমান সময়ের জীবিত বিস্ময় চূড়ান্তভাবে প্রতিবন্ধী কিন্তু স্বয়ংসম্পূর্ণ দেহধারী পৃথিবীর যেকোনো বিজ্ঞানীর সমকক্ষ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিন্স তাঁর বিশেষ হুইলচেয়ারে স্টেডিয়ামে এলেন। আর পুরো অলিম্পিক ভিলেজ আরও এক ধাপ আকাশে উঠে গেল।
এই প্যারালিম্পিক খেলা ও তার আয়োজন আমাকে অনন্য করে দিল। বিস্ময়ে বিস্ময়ে জানলাম, মানুষের ক্ষমতা কখনো দেহে থাকে না। দেহ প্রতিবন্ধক হলে মনের ইচ্ছাকে ঠিক এক শক্তিশালী ইগলের মতো উড়িয়ে দিতে হয়। নৈঃশব্দ্যের শব্দ যেমন শব্দের বহুগুণ। তেমনি প্রত্যঙ্গময়তার চেয়ে প্রত্যঙ্গবিহীনতার ক্ষমতা অনেক বেশি। এঁরা কোনো সাধারণ মানুষই নন। এই অলিম্পিক ও প্যারালিম্পিকের দূত ঠিকই বলেছেন, এ খেলা ও এই প্যারালিম্পিক প্রতিবন্ধিত্বের প্রতি ব্রিটেনের মানুষের চেতনা বদলে দিয়েছে। আমি বলব, বিশ্বেরও।
শামীম আজাদ: কবি ও কলাম লেখক।
shetuli@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.