চট্টগ্রামে দুদকের ১৩ মামলা, জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত হলমার্ক নিয়ে সোনালী -ব্যাংকের বৈদেশিক শাখা ম্যানেজারের দাবি তিনি মোদাচ্ছের আলীকে চেনেন না

বিআরটিএ, চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মকর্তা ও যমুনা অয়েল কোম্পানিরসহ কয়েকটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের ১৯ জনের বিরুদ্ধে ১৩টি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। কর ফাঁকি, বিদেশে অর্থ পাচার ও প্রতারণার মাধ্যমে টাকা আত্মসাতের অভিযোগে সোমবার দুদকের কর্মকর্তারা বাদী হয়ে ঢাকা এবং চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানায় এসব মামলা দায়ের করে।


হলমার্কের অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনায় এদিন সোনালী ব্যাংকের বৈদেশিক বাণিজ্য শাখার ৭ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক। একই সঙ্গে সোনালী ব্যাংকের আগারগাঁও ও গুলশান শাখা থেকে নিয়মবহির্ভূত ৪৭ কোটি টাকা ঋণ দেয়ার ঘটনা অনুসন্ধান করা সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন। এ জন্য চার সদস্যের একটি অনুসন্ধান টিম গঠন করেছে সোমবার।
জানা যায়, বিভিন্ন দাতা সংস্থার অর্থায়নকৃত প্রকল্পের কর্মকর্তাদের কাজে ব্যবহারের জন্য গাড়িগুলো নিজেরা শুল্কমুক্ত সুবিধায় এদেশে গাড়ি আমদানি করে। এসব গাড়ি উন্নয়ন সহযোগীদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। এর ফলে প্রকল্প শেষ হওয়ার পর সেটি নিজেরা রেখে দেয়। কেউ কেউ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বিক্রি করে থাকে। নতুন প্রকল্প শুরু হলে আবার গাড়ি আমদানি করা হয়।
দুদকের অনুসন্ধানে দেখা যায়, জাতিসংঘের একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠানের নামে ২১টি গাড়ি আমদানি করা হয়। তার মধ্যে চারটি ল্যান্ড ক্রুজার ও দুটি দামী প্রাইভেট কার পরবর্তীতে টেন্ডারের মাধ্যমে বিক্রি করে দেয়া হয়। টেন্ডারে অংশগ্রহণ করেন মাহবুব উর রহমান (উজ্জ্বল) নামের এক ব্যক্তি। সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে গাড়িগুলো ক্রয় করেন তিনি। চারটি গাড়ির বিপরীতে কাস্টমস শুল্ক বাবদ ৪২ লাখ ৯৭ হাজার টাকা থেকে বঞ্চিত হয় রাষ্ট্র। কিন্তু নিজেকে রক্ষা করতে গাড়িগুলোর ওপর প্রযোজ্য শুল্ক করাদি পরিশোধসংক্রান্ত কাস্টমস হাউস ঢাকার জাল অনাপত্তিপত্র তৈরি করেন তিনি। আর ভুয়া কাগজপত্র বিআরটিএ ঢাকা সার্কেল (উত্তর) কর্মকর্তা সরওয়ার খান সঠিক বলে সনদ প্রদান করেন। পরবর্তীতে বিআরটিএ ঢাকা সার্কেল (উত্তর) সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ দাখিলী কাগজপত্রের সত্যতা যাচাই না করে গাড়িগুলোর বিপরীতে ডি-রেজিস্ট্রেশন নম্বর প্রদান করেন। এ কর্মকর্তা রেজিস্ট্রেশন নম্বর প্রদানের আগে শুল্ক করাদি পরিশোধসংক্রান্ত কাগজপত্রের সঠিকতা যাচাই না করেই অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে গ্রাহককর্তৃক আবেদনের তারিখেই রেজিস্ট্রেশন নম্বরগুলো প্রদান করেছেন। মামলার আসামিরা হচ্ছেন গাড়ি ক্রয়কারী মাহবুব উর রহমান, বিআরটিএ পুলিশ পরিদর্শক এএফএম ফখরুল আমিন এবং সানওয়ার খান। মামলা নং ৩৭ ও ৩৮। গাড়ির আমদানিকারক মাহমুদুর রহমান উজ্জ্বলকেও ওই দু’টি মামলায় আসামি করা হয়েছে। দুদক অনুসন্ধানে এ তিনজনের বিরুদ্ধে জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়ায় মামলা করে দুদক।
পণ্য আমদানির নামে বিদেশে টাকা পাচার করার অভিযোগে চট্টগ্রাম বন্দর থানায় বন্দরের জেটি সরকারসহ তিনজনের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেছে দুদক। মামলার অভিযোগে বলা হয়, সিএ্যান্ডএফ মেসার্স শিমুল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ সাইফুল ইসলাম, তার ওতয়ার্কি পার্টনার ফকির আব্দুল মান্নান এবং কাস্টমস জেটি সরকার হাবিবুর রহমান একে অপরের সহযোগিতায় জাল-জালিয়াতির আশ্রয়ে এইচএসবিসি ব্যাংকে ভুয়া এলসি খোলে। এর পর বিদেশ থেকে দুটি গাড়ি, টিভি ও আমদানি নিষিদ্ধ ফটোকপি আমদানির নামে এক কোটি ৩৬ লাখ ৪৩ হাজার ১১৬ টাকা বিদেশে পাচার করা হয়। এমন অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের উপপরিচালক এসএমএম আখতার হামিদ ভ্ঞূা বাদী হয়ে সোমবার চট্টগ্রামের বন্দর থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলায় আসামি করা হয় মোঃ সাইফুল ইসলাম, ফকির আব্দুল মান্নান এবং জেটি সরকার হাবিবুর রহমানকে।
বন্দরনগরীতে যমুনা অয়েল কোম্পানির বিটুমিন বরাদ্দে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে ৬ কর্মকর্তাসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে ১০টি মামলা করেছে দুদক। সোমবার দুপুরে নগরীর ডবলমুরিং থানায় দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মোহাম্মদ মোরশেদ আলম, উপ-সহকারী পরিচালক সাইফুল্লাহ মোঃ ইমরান, মোঃ খলিলুর রহমান, মোঃ ফকরুল ইসলাম বাদী হয়ে এ মামলা করেন।
আসামিরা হলোÑ যমুনা অয়েল কোম্পানির ডিজিএম (ইঞ্জিন) মাহিদুর রহমান (সাবেক ডিজিএম-সেলস), ডিজিএম (পিআর) মোঃ মাসুদ করিম (সাবেক এজিএম, ডিবি), এজিএম (অডিট) মোঃ খসরু আজাদ, এজিএম (টিএস) সবুর খান, ডিএম (সেলস) মোঃ আমজাদ হোসেন এবং ডিএম (সেলস) মোঃ ইউসুফ খন্দকার। মামলার অন্য আসামিরা হলোÑ নগরের মাঝিরঘাটের মেসার্স মোয়াজ এন্টারপ্রাইজের মালিক মোঃ মোশাররফ হোসেন, কদমতলী ডিটি রোডের জামান এন্টারপ্রাইজের মোঃ নুরজ্জামান, মেসার্স মাহবুব এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স বিক্রমপুর পরিবহন সংস্থা ও এমআর ট্রেডের মোঃ মাহবুব হোসেন, কদমতলী আশরাফ মার্কেটের মেসার্স জেড আর এন্টারপ্রাইজের মোঃ সেলিম হোসেন, একই মার্কেটের এসএ এন্টারপ্রাইজের আলী আশরাফ, কদমতলী জাহাঙ্গীর মার্কেটের মেসার্স মোঃ ইকবাল এ্যান্ড ব্রাদার্সের ইকবাল হোসেন এবং ওই এলাকার ডিটি রোডের মেসার্স হাসান এন্টারপ্রাইজের মোঃ হাসান। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, আসামিরা স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল অধিদফতর এবং সড়ক ও জনপদ বিভাগের বিভিন্ন কার্যালয়ের ভুয়া ও জাল কার্যাদেশ ব্যবহার করে যমুনা অয়েল কোম্পানির বিটুমিন বরাদ্দ কমিটির (৬ কর্মকর্তা) সদস্যরা পরস্পর যোগসাজশে কোম্পানির নীতিমালা ভঙ্গ এবং বিভিন্ন সরকারী অফিসের নাম ব্যবহার করে দুর্নীতি করেছেন। এতে আরও বলা হয়, অসৎ উদ্দেশ্যে বিশ্বাস ভঙ্গ করে ৯৮০৩ ড্রাম ও ৫৫.১৫০ মেট্রিক টন বিটুমিন (৭ কোটি ৯৪ লাখ ৭ হাজার টাকা) সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কম দামে কিনে বেশি দরে বিক্রি করে অবৈধভাবে নিজেরা লাভবান হওয়ার অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
দুদক প্রধান কার্যালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রণব কুমার ভট্টাচার্য জনকণ্ঠকে বলেন, প্রাথমিক তদন্তে যমুনা অয়েল কোম্পানির ৬ কর্মকর্তা ও ৭ ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ এর ২ ধারায় তাদের বিরুদ্ধে ১০টি মামলা করা হয়েছে।
এদিকে একইদিন হলমার্কের সোনালী ব্যাংকের প্রধান বৈদেশিক বাণিজ্যিক শাখার জিএম মোস্তাফিজুর রহমানসহ ছয় কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদকের এ-সংক্রান্ত কর্মকর্তারা। বেলা ১১টা থেকে বিকেল ৫টার পর্যন্ত পৃথক পৃথকভাবে তাদের ৭ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। অন্যরা হলেনÑ উপ-মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) এজাজ আহমেদ, উপ-মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) মোঃ আলী হোসেন খান, জ্যেষ্ঠ নির্বাহী কর্মকর্তা সোহরাব হোসেন ও মোখলেসুর রহমান, সিনিয়র কর্মকর্তা জেসমিন নাহার এবং জুনিয়র কর্মকর্তা মোঃ জিল্লুর রহমান।
দুদকের জ্যেষ্ঠ উপ-পরিচালক মীর জয়নুল আবেদিন শিবলীর নেতৃত্বে ছয় সদস্যের তদন্ত দল তাদের পর্যায়ক্রমে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে মোদাচ্ছের আলীর সঙ্গে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতার কথা শোনা গেলেও তা অস্বীকার করেছেন সোনালী ব্যাংকের প্রধান বৈদেশিক বাণিজ্যিক শাখার জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) মোস্তাফিজুর রহমান। স্বাস্থ্য উপদেষ্টার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের বিষয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্বাস্থ্য উপদেষ্টাকে আমি কখনই দেখিনি। সোনালী ব্যাংকেও আসতে দেখিনি। আপনার সঙ্গে কি যোগাযোগ আছে?- এ প্রশ্নের উত্তরে বলেন, কখনই না। তিনি বলেন, আমি যা জানি তা দুদককে বলেছি। প্রকৃত দোষীরা বের হবেন বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

No comments

Powered by Blogger.