বিশ্বব্যাংকের চার শর্তই পূরণ ॥ ছুটিতে মসিউর- ০ পদ্মা সেতুতে ফিরছে দাতারা- ০ ওয়াশিংটনে গোল্ডস্টেইন ও গওহর রিজভী by হামিদ-উজ-জামান মামুন

সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে এক মাসের ছুটিতে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান। সোমবার তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ছুটি চেয়ে আবেদনপত্র জমা দিয়েছেন। তাঁর এ ছুটিতে যাওয়ার মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাংকের চারটি শর্তই পূরণ হলো।


আশা করা হচ্ছে, শীঘ্রই পদ্মা সেতুতে দাতাদের ফিরে আসার সুখবর পাওয়া যাবে। এখন শুধু অপেক্ষার পালা। এ প্রেক্ষিতে ওয়াশিংটনে অবস্থিত বিশ্বব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে গেছেন প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী এবং সঙ্গে রয়েছেন অপর উপদেষ্টা এইচটি ইমাম। তাঁরাই দেশের জন্য সেই সুখবরটি সরকারকে জানাবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। সূত্র জানায়, পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়নকারী অন্যতম দাতা জাপান আন্তর্জাতিক সংস্থার (জাইকা) বর্ধিত মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ২১ সেপ্টেম্বর। এই ডেডলাইনের চারদিন বাকি থাকতেই ছুটিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন প্রভাবশালী এ উপদেষ্টা। কেননা বিশ্বব্যাংককে ফেরাতে এর কোন বিকল্পই ছিল না সরকারের সামনে। এ সময়ের মধ্যে বিশ্বব্যাংককে সন্তুষ্ট করাতে না পারলে সংস্থাটির প্রতিশ্রুত ৪১ কোটি ৫০ লাখ ডলার ঋণ পাওয়া সম্ভব হতো না। একইভাবে অপর গুরুত্বপূর্ণ দাতাসংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ঋণ চুক্তির মেয়াদও শেষ হচ্ছে চলতি মাসেই। এ দুটি সংস্থা তাকিয়ে আছে বিশ্বব্যাংকের দিকেই। বিশ্বব্যাংক ঋণ চুক্তি পুনর্বিবেচনা না করলে তারাও ঋণ দেবে না বলে ইতোমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশে নিযুক্ত কান্ট্রি ডিরেক্টর এ্যালেন গোল্ডস্টেইনও শনিবার রাতে ওয়াশিংটনের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছেড়েছেন। পদ্মা সেতুর ঋণ চুক্তি পুনর্বিবেচনার বিষয়টি নিয়েছে তিনিও বেশ তৎপর। অন্যান্য কাজ থাকলেও এ বিষয়ে সর্বশেষ প্রচেষ্টা চালাতেই তাঁর এ বিশ্বব্যাংকের কেন্দ্রীয় অফিসে যাওয়া বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
অন্যদিকে রবিবার রাতে ওয়াশিংটনের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন ড. গওহর রিজভী। ওয়াশিংটনে গিয়ে এ্যালেন গোল্ড স্টেইনকে সঙ্গে নিয়ে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাত করবেন তিনি। সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা প্রধানমন্ত্রীকে পদ্মা সেতুতে অর্থ পেতে অর্থ উপদেষ্টার ছুটিতে পাঠানোর পরামর্শ দিয়েছে। এ প্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাংকের অর্থ পেতে শেষ পর্যন্ত তাঁকে ছুটিতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য ২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণচুক্তি স্বাক্ষর করে সরকার। এছাড়া অন্যান্য দাতা সংস্থার মধ্যে ওই বছরের ১৮ মে জাপানের জাইকার সঙ্গে, ২৪ মে ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের সঙ্গে এবং ৬ জুন এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) সঙ্গে ঋণচুক্তি স্বাক্ষর হয়। কিন্তু দুর্নীতির অভিযোগ এনে বিশ্বব্যাংক অর্থ ছাড় স্থগিত করলে অন্য দাতারাও তা স্থগিত করে। এ ঋণ কার্যকারিতার মেয়াদ ছিল চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত। এসময় পার হওয়ার পূর্বেই সরকারের আবেদনের প্রেক্ষিতে তিন মাস সময় বাড়িয়ে দেয় এডিবি ও জাইকা। এডিবি ও জাইকার বাড়ানো সময় শেষ হয়ে যায় ২৭ এপ্রিল। এসময় সরকারের পক্ষ থেকে ফের সময় বাড়ানোর আবেদন করা হয়। এ প্রেক্ষিতে সংস্থা দুটি ৩১ জুলাই পর্যন্ত তিন মাস সময় বাড়িয়ে দেয়। আশা করা হয়েছিল এরই মধ্যে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে একটি সন্তোষজনক সমাধান আসবে। কিন্তু সেটি না হওয়ায় ৩১ আগস্ট পর্যন্ত এক মাস বাড়িয়ে দেয় সংস্থা দুটি। এর মধ্যেও কোন সমাধান না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত আবারও ২১ দিন অর্থাৎ ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়িয়ে দেয় জাইকা। এক মাস অর্থাৎ ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়ায় এডিবি।
সূত্র জানায়, দুর্নীতির অভিযোগ তুলে গত জুন মাসে বিশ্বব্যাংক দেশের সবচেয়ে বড় নির্মাণ প্রকল্প পদ্মা সেতুর ঋণচুক্তি বাতিল করে। এরপর সরকার নিজস্ব অর্থায়নে এই সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিলেও অর্থমন্ত্রী বিশ্বব্যাংককে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালাতে থাকেন।
২৯০ কোটি ডলারে ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের ১২০ কোটি ডলার দেয়ার কথা ছিল। গত বছরের সেপ্টেম্ব^রে দুর্নীতির অভিযোগ তোলার পর চারটি শর্ত সরকারকে দিয়েছিল বিশ্বব্যাংক। তা পালন হয়নি বলে অভিযোগ জানিয়ে গত ২৯ জুন অর্থায়ন বাতিল করে সংস্থাটি।
সরকারকে দেয়া প্রস্তাব এবং সরকারের কার্যক্রম সম্পর্কে সংস্থাটি বলেছে, বিশ্বব্যাংক পরামর্শ দিয়েছিল যে সরকার চারটি পদক্ষেপ নিতে পারে। সেগুলো হচ্ছে, প্রথমত, দুর্নীতি দমন কমিশনকে একটি বিশেষ যৌথ তদন্ত ও বিচারিক টিম গঠনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, একটি বিকল্প প্রকল্প বাস্তবায়ন ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যেখানে সহযোগী অর্থায়নকারীদের জন্য স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় অধিকতর তদারকির সুযোগ থাকবে। তৃতীয়ত, দুদককে বিশ্বব্যাংকের তত্ত্বাবধানে একটি বাইরের প্যানেলের কাছে তথ্য দেয়ার এবং প্যানেলকে তদন্ত প্রক্রিয়ার পর্যাপ্ততা মূল্যায়নের সুযোগ দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। সবশেষে, সরকার বাংলাদেশী আইনের আওতায় থাকা সত্ত্বেও তদন্ত চলাকালে সরকারী দায়িত্ব পালন থেকে সরকারী ব্যক্তিবর্গ (আমলা ও রাজনৈতিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত) ছুটিতে পাঠানো।

No comments

Powered by Blogger.