তারেক ভাই ও মুক্তির কথা by স্মৃতিরেখা বিশ্বাস
অপ্রত্যাশিতভাবেই তারেক ভাইয়ের 'মুক্তির কথা' নামে ডকুমেন্টারি ছবিটির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলাম। তারেক ভাই 'মুক্তির কথা' ছবিটিকে কখনও পুরোপুরি ডকুমেন্টারি বলেননি। কখনও বলেছেন 'অনাধুনিক ছবি', কখনওবা বলেছেন 'ব্রাত্যজনের ইতিহাস'। ১৯৯৫ সালে ছোট বোনকে নিয়ে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে মুক্তির গান দেখতে গেলাম।
প্রদর্শনীর মাঝামাঝি অবস্থায় দেখলাম একটি শিশুর হাত। সে হাত বেতাল তালে গানের সঙ্গে তাল দিচ্ছে, ক্রমে পর্দাজুড়ে একটি শিশুর মুখ ভেসে উঠল। পাশে বসা আমার ছোট বোনটি প্রদর্শনী কক্ষের নীরবতাকে তোয়াক্কা না করে 'বাবু' বলে চিৎকার করে উঠল। একাত্তরে সল্টলেক শরণার্থী শিবিরে এক বিকেলে 'মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থার' শিল্পীদের ভ্রাম্যমাণ মঞ্চ থেমেছিল। গান চলছিল। আমার বাবা ছোট ভাই বাবুকে শিল্পীদের পাশে বসিয়ে দিয়েছিলেন। '৭১-এ ফিরে গেলাম। শরণার্থী শিবির, শরণার্থীর জীবন, এক ট্রাক মৃতদেহ, চারদিকে বালু আর বালু, মাথার ওপর পাতলা তাঁবু, মেঝের জলে ভিজে যাওয়া বস্ত্র_ সবকিছু এক এক করে ভেসে উঠেছিল চোখের সামনে। দু'জনেই আনন্দ, আবেগ আর উত্তেজনায় কেঁদেছিলাম। বোনটির শরীর কাঁপছিল বুঝতে পারছিলাম। তারেক ভাইকে তখনও দেখিনি, চিনি না। শ্রদ্ধায় মাথানত হলো তার উদ্দেশে। পরদিন আবার গেলাম ছবিটি দেখতে, সঙ্গে নিয়েছিলাম তারেক ভাইয়ের জন্য একটি কৃতজ্ঞতা পত্র। চিঠিটিতে শুধু আমার নাম ছিল, ঠিকানা ছিল না। প্রয়োজনও বোধ করিনি।
'মুক্তির গান' আমাকে নিরাশ করেনি। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরও নিরাশ করেনি। আমার ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে গিয়েছিলাম, তখনও একই রকম মনে হয়েছিল_ হয়তো কিছু পাব। পেলাম বাবার ছবি। মিজানুর রহমান চৌধুরী (এক সময়ের প্রধানমন্ত্রী) ও বেগম বদরুন্নেছা আবদুল্লাহর সঙ্গে শরণার্থী শিবিরে। আমি গর্বিত হলাম এ কারণে যে, আমার বাবা চিরকাল মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে বেঁচে থাকবেন।
১৯৯৬ সাল। ফরিদপুরে আমার কাকার বাসায় 'ভোরের কাগজে' দেখলাম তারেক ভাইয়ের একটি চিঠি। যার তারিখ ছিল ১৯৯৬ সালের ১৫ অক্টোবর। তারেক ভাই পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে খুঁজছেন আমাকে। চিঠিটির শিরোনাম ছিল, 'মগবাজারবাসী জনৈকা স্মৃতিরেখা বিশ্বাসের প্রতি'। ১৯৯৫ সালের লেখা ঠিকানাবিহীন চিঠির অপ্রত্যাশিত উত্তর পেলাম। ঢাকায় এসে ৪৮ লেকসার্কাসের বাসায় দেখা করলাম। আমাকে পেয়ে তারেক ভাই এতটা উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন, মনে হয়েছিল শিশুর মতো খুশি হলেন। অনেক কথার পর বললেন_ তার পরবর্তী ছবিতে আমার একটি সাক্ষাৎকার সংযোজন করবেন। ক্যামেরায় প্রায় ৩ ঘণ্টা কথা বললাম। ঘরবাড়ি পোড়ানো, ১৩ দিনের পথচলা শরণার্থী হয়ে, শরণার্থীর জীবন_ সব বললাম। তারেক ভাই হিন্দু আবহে তৈরি এবং গ্রামীণ পরিবেশে একটি বাড়ি চেয়েছিলেন। গাজীপুর বাজারের আশপাশের অলিগলিতে বাড়িটি খুঁজেছেন। অবশেষে বিআইটির পাশ দিয়ে গিয়ে হাতের বাঁ দিকে মাঠের মধ্যে একটি বাড়ি পেলেন, যা পেয়ে তিনি খুশি হয়েছিলেন। তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় লাগল সাক্ষাৎকার গ্রহণ করতে। এরপরও তিনি তার উত্তরার বাসায় মিনি স্টুডিওতে আরও একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। এভাবেই আমার সাক্ষাৎকার গ্রহণ পর্ব শেষ করেছিলেন।
১৯৯৯ সাল। ২০ নভেম্বর 'মুক্তির কথার' প্রিমিয়ার শোতে জাদুঘর মিলনায়তনে। প্রদর্শনী রুমে পর্দায় আমার সেই ঠিকানাবিহীন চিঠিটি ভেসে উঠল প্রথমেই। আমাদের পরিবারের ছবিও সেখানেই ঠাঁই পেল। এভাবেই আমি এই মহৎ সৃষ্টির অংশীদার হয়ে গেলাম। তারেক ভাইয়ের মূল্যায়ন করা আমার মতো একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। সে ক্ষমতাও নেই। একটি শিল্পকর্মকে সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে কতটা আন্তরিকতা, কাজের প্রতি কতটা গুরুত্ব বা শ্রদ্ধাশীল হওয়া যায় আমি কাছে থেকে দেখেছি।
আমি '৭১-এর ভুক্তভোগী পরিবারের একটি মেয়ে। তারেক ভাই এতটাই নরম মনের মানুষ ছিলেন যে, আমাদের পরিবারের কথা তার চোখেও জল এসে গিয়েছিল। কেন যে মানুষ এভাবে চলে যায়_ ভাবলে স্থির থাকা যায় না। তারেক ভাইয়ের ঋণ শোধবার নয়। তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমি আমার শ্রদ্ধা। আমি যেন আমৃত্যু তার ঋণ স্বীকার করে যেতে পারি।
স্মৃতিরেখা বিশ্বাস :শিক্ষিকা
'মুক্তির গান' আমাকে নিরাশ করেনি। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরও নিরাশ করেনি। আমার ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে গিয়েছিলাম, তখনও একই রকম মনে হয়েছিল_ হয়তো কিছু পাব। পেলাম বাবার ছবি। মিজানুর রহমান চৌধুরী (এক সময়ের প্রধানমন্ত্রী) ও বেগম বদরুন্নেছা আবদুল্লাহর সঙ্গে শরণার্থী শিবিরে। আমি গর্বিত হলাম এ কারণে যে, আমার বাবা চিরকাল মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে বেঁচে থাকবেন।
১৯৯৬ সাল। ফরিদপুরে আমার কাকার বাসায় 'ভোরের কাগজে' দেখলাম তারেক ভাইয়ের একটি চিঠি। যার তারিখ ছিল ১৯৯৬ সালের ১৫ অক্টোবর। তারেক ভাই পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে খুঁজছেন আমাকে। চিঠিটির শিরোনাম ছিল, 'মগবাজারবাসী জনৈকা স্মৃতিরেখা বিশ্বাসের প্রতি'। ১৯৯৫ সালের লেখা ঠিকানাবিহীন চিঠির অপ্রত্যাশিত উত্তর পেলাম। ঢাকায় এসে ৪৮ লেকসার্কাসের বাসায় দেখা করলাম। আমাকে পেয়ে তারেক ভাই এতটা উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন, মনে হয়েছিল শিশুর মতো খুশি হলেন। অনেক কথার পর বললেন_ তার পরবর্তী ছবিতে আমার একটি সাক্ষাৎকার সংযোজন করবেন। ক্যামেরায় প্রায় ৩ ঘণ্টা কথা বললাম। ঘরবাড়ি পোড়ানো, ১৩ দিনের পথচলা শরণার্থী হয়ে, শরণার্থীর জীবন_ সব বললাম। তারেক ভাই হিন্দু আবহে তৈরি এবং গ্রামীণ পরিবেশে একটি বাড়ি চেয়েছিলেন। গাজীপুর বাজারের আশপাশের অলিগলিতে বাড়িটি খুঁজেছেন। অবশেষে বিআইটির পাশ দিয়ে গিয়ে হাতের বাঁ দিকে মাঠের মধ্যে একটি বাড়ি পেলেন, যা পেয়ে তিনি খুশি হয়েছিলেন। তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় লাগল সাক্ষাৎকার গ্রহণ করতে। এরপরও তিনি তার উত্তরার বাসায় মিনি স্টুডিওতে আরও একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। এভাবেই আমার সাক্ষাৎকার গ্রহণ পর্ব শেষ করেছিলেন।
১৯৯৯ সাল। ২০ নভেম্বর 'মুক্তির কথার' প্রিমিয়ার শোতে জাদুঘর মিলনায়তনে। প্রদর্শনী রুমে পর্দায় আমার সেই ঠিকানাবিহীন চিঠিটি ভেসে উঠল প্রথমেই। আমাদের পরিবারের ছবিও সেখানেই ঠাঁই পেল। এভাবেই আমি এই মহৎ সৃষ্টির অংশীদার হয়ে গেলাম। তারেক ভাইয়ের মূল্যায়ন করা আমার মতো একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। সে ক্ষমতাও নেই। একটি শিল্পকর্মকে সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে কতটা আন্তরিকতা, কাজের প্রতি কতটা গুরুত্ব বা শ্রদ্ধাশীল হওয়া যায় আমি কাছে থেকে দেখেছি।
আমি '৭১-এর ভুক্তভোগী পরিবারের একটি মেয়ে। তারেক ভাই এতটাই নরম মনের মানুষ ছিলেন যে, আমাদের পরিবারের কথা তার চোখেও জল এসে গিয়েছিল। কেন যে মানুষ এভাবে চলে যায়_ ভাবলে স্থির থাকা যায় না। তারেক ভাইয়ের ঋণ শোধবার নয়। তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমি আমার শ্রদ্ধা। আমি যেন আমৃত্যু তার ঋণ স্বীকার করে যেতে পারি।
স্মৃতিরেখা বিশ্বাস :শিক্ষিকা
No comments