মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণ ॥ জনপ্রত্যাশা পূরণ হবে তো? by ড. হারুন রশীদ
মহাজোট সরকারের মন্ত্রিসভায় আরেক দফা পরিবর্তন করা হয়েছে। যোগ দিয়েছেন নতুন আরও ৫ মন্ত্রী এবং ২ জন প্রতিমন্ত্রী। শুধু তাই নয়, মন্ত্রীদের দফতরও পুনর্বণ্টন করা হয়েছে। এই মন্ত্রিসভায় আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা তোফায়েল আহমেদ এবং মহাজোটের শরিক দল ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি মন্ত্রী হিসেবে
শপথ নেয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা শেষ পর্যন্ত মন্ত্রিসভায় যোগদান করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। মন্ত্রিসভার সম্প্রসারণ নিয়ে যতটা না আলোচনা হয়েছে তার চেয়েছে মন্ত্রিসভায় যোগ না দেয়ায় তোফায়েল আহমেদ এবং রাশেদ খান মেনন মিডিয়ায় উঠে এসেছেন বেশি করে। সে প্রসঙ্গ পরে, আগে দেখা যাক কেমন হলো মন্ত্রিসভার এই সম্প্রসারণ। এবং নবনিযুক্ত মন্ত্রীরা কতটাই বা সাফল্য দেখাতে সক্ষম হবেন। বিশেষ করে সরকারের মেয়াদ আছে আর প্রায় ১৫ মাস। এই সময়কে বিশ্লেষকরা অতি অল্প সময় হিসেবে অভিহিত করছেন। এবং এই সময়ে নতুন কোন মন্ত্রীর পক্ষেই আমূল পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে না এমনটিই বলা হচ্ছে। তবে ভিন্ন মত আছে।
যাই হোক, বৃহস্পতিবার পূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে রাষ্ট্রপতির কাছে শপথ নিয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু, জাতীয় সংসদের হুইপ মুজিবুল হক এবং দুটি সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করা আবুল হাসান মোহাম্মদ আলী ও মোস্তফা ফারুক মোহাম্মদ। প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন রাজশাহীর সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী ও ঝিনাইদহের আবদুল হাই। তোফায়েল আহমেদ এবং রাশেদ খান মেনন অপারগতা প্রকাশ করার কারণে দিনাজপুরের সংসদ সদস্য এএইচ মাহমুদ আলী ও যশোরের মোস্তফা ফারুখ মোহাম্মদকে মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়। মন্ত্রী সভার সম্প্রসারণ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শপথ গ্রহণ শেষে বঙ্গভবনে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে সাংবাদিকদের কাছে বলেন, এলাকাবাসীকে চমক দেয়ার জন্যই মন্ত্রী হিসেবে নতুন সাত জনকে শপথ করানো হলো। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই এতদূর এসেছে, ভবিষ্যতেও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই এগিয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রীর এই চেতনাদীপ্ত দৃঢ় প্রত্যয় যদি শপথ নেয়া নতুন মন্ত্রীদের মধ্যে সঞ্চারিত হয় তাহলে তারা যে সফল হবেন এমনটি আশা করা যেতে পারে।
গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় মন্ত্রিসভায় রদবদল একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। যে কোন সময় মন্ত্রিসভায় যে কোন ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে। এটা নিয়ে খুব বেশি আহ্লাদিত হওয়া কিংবা সমালোচনা করারও প্রয়োজন নেই। কিন্তু দেখা যাচ্ছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নেতারা যত না মন্ত্রিসভার সম্প্রসারণ নিয়ে আলোচনা করছেন তার চেয়ে বেশি মন্ত্রিসভায় আমন্ত্রণ পেয়েও কে যোগদান করল না সেটাই তাদের কাছে একটি মুখ্য আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা এটাকে সরকারের রাজনৈতিক পরাজয় বলে প্রচার করছে। অবশ্য যে দলের এমপিরা ফ্লোর ক্রসিং করে ৯৬-এর আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিল তাদের কাছে আমন্ত্রণ পেয়েও মন্ত্রিসভায় যোগদান না করার বিষয়টি আশ্চর্যজনক ঠেকতে পারে। জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করে দলের হাল ধরেছিলেন। তাই আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছে মন্ত্রিত্ব বড় নয়, আদর্শ বড়। মন্ত্রিসভায় যোগদান না করা তোফায়েল আহমেদ বার বার এই কথাটি বলছেন। মিডিয়ার কাছে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘এই মুহূর্তে আমি রাজনৈতিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার জন্য প্রস্তুত নই। আমি আমার দলকে ভালবাসি, আমার দলেরই সরকার। আমি মনে করেছি যে এ মুহূর্তে মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়ে আমি কিছুই করতে পারব না। আমার মতো একজন তোফায়েল আহমেদ মন্ত্রিসভায় যোগদান না করলে তাতে কিছুই যায় আসে না।’
অপরদিকে রাশেদ খান মেননের মন্ত্রিত্ব গ্রহণ না করার বিষয়ে তাঁর দলের পক্ষ থেকে সাবেক সাধারণ সম্পাদক বিমল বিশ্বাস সাংবাদিকদের জানান, আমরা দলীয়ভাবে মন্ত্রিত্বের এ আমন্ত্রণ গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তিনি বলেন, ১৪ দলের অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক চেতনাকে এগিয়ে নিতে আমরা কাজ করে যাব এবং সরকারের ভাল কাজকে সংসদে ও সংসদের বাইরে সমর্থন দিয়ে যাব। আগেই আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল যে আমরা ১৪ দলে থাকব, তবে মন্ত্রিসভায় যোগ নয়।’
দেখা যাচ্ছে মন্ত্রিসভায় যোগ না দেয়া নেতারা তাঁদের অপারগতার পেছনে ব্যক্তিগত এবং দলগত অবস্থানের কথা বলছেন। কিন্তু বিএনপি নেতারা এটাকে লুফে নিয়ে সরগরম পরিস্থিতি সৃষ্টি করার অপপ্রয়াসে লিপ্ত রয়েছেন। তোফায়েল আহমেদ যথার্থই বলেছেন, ‘বিএনপির হাতে কোন ইস্যু না থাকায় তারা আমার মন্ত্রিসভায় যোগদান করার বিষয়টিকেই ইস্যু বানাতে চাইছে।’ একেই বলে মার চেয়ে মাসির দরদ বেশি।
মন্ত্রিসভায় নতুন যোগ দেয়া মন্ত্রীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে মহীউদ্দীন খান আলমগীর এবং হাসানুল হক ইনুকে নিয়ে। বিশেষ করে সাহারা খাতুনকে অন্য মন্ত্রণালয়ে সরিয়ে দিয়ে সাবেক ঝানু এবং দক্ষ আমলা মহীউদ্দীন খান আলমগীরকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়ায় বিষয়টি সুধী মহলের দৃষ্টি কেড়েছে। সাহারা খাতুনকে নানা কারণে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেয়ার দাবি উঠেছিল অনেক আগেই। এমনকি ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকেও এই দাবি জানানো হয়। দেরিতে হলেও সেই পরিবর্তন হওয়ায় জনমনে নতুন করে আশার সঞ্চার হয়েছে। বিশেষ করে মহীউদ্দীন খান আলমগীর-এর মতো একজন পোড়খাওয়া ঝানু এবং দক্ষ আমলা এই দায়িত্ব পাওয়ায় এটি নিয়ে জনমনে যথেষ্ট আশা উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছে। মহীউদ্দীন খান আলমগীর শুধু একজন অভিজ্ঞ আমলায়ই নন, তিনি এর আগের সরকারে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি একজন সুলেখকও। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তাঁকে জেলে নেয়া হয়। এর আগে বিএনপি সরকারের সময়ও তাঁকে জেল-জুলুম করতে হয়। সেই জেল জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি দু’টি বই লিখেছেন। এই বই দু’টি যাঁরা পড়েছেন তাঁরা জানেন আইন-কানুন বিধিবিধান সম্পর্কে তাঁর পা-িত্য কতটা উঁচুতে। দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সেই অভিজ্ঞতা যে তিনি কাজে লাগাবেন সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। দায়িত্ব নেয়ার পর সাংবাদিকদের কাছে দেয়া প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী তাঁকে যে দায়িত্ব দিয়েছেন তা তিনি চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নিয়েছেন।
অপরদিকে তথ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়া হাসানুল হক ইনুকে নিয়েও যথেষ্ট আশাবাদের কারণ আছে। বলা হয়ে থাকে বর্তমান সরকারের সঙ্গে যে কারণেই হোক মিডিয়ার একটি দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। হাসানুল হক ইনু একজন মিডিয়াবান্ধব ব্যক্তিত্ব হিসেবেই পরিচিত। তিনি এই দূরত্ব ঘোচাতে সচেষ্ট হবেন বলে আশা করা যায়। নতুন মন্ত্রীদের মধ্যে ইনুর কথাবার্তায় তাকে যথেষ্ট প্রাণবন্ত এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রস্তুতÑ এমনটিই মনে হয়েছে। শপথ গ্রহণের পর বঙ্গভবনে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘রাজনৈতিক কারণে আমরা জোট করেছি, ঐক্যবদ্ধ নির্বাচন শেষে সরকার গঠন করেছি। আজ রাজনৈতিক কারণেই মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছি। সেই রাজনৈতিক কারণ হচ্ছে জঙ্গীবাদ থেকে দেশকে মুক্ত করা ও যুদ্ধাপরাধীদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করা। বিপদ এখনও কাটেনি। তাই যতদিন রাজনৈতিক এসব কারণ সমাধান করতে লাগবে ততদিন আমরা জোটে থাকব।’ হাসানুল হক ইনু মন্ত্রী হওয়ার আগেও জোটের নানা কর্মকা-ের গঠনমূলক সমালোচনা করেছেন। মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি তাঁর এই সরব উপস্থিতি তিনি বজায় রাখবেনÑএমটিই দেশের মানুষ প্রত্যাশা করে।
নতুন মন্ত্রী হিসেবে অন্য যাঁরা শপথ নিয়েছেন তারাও দায়িত্ব পালনে যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাবেন বলে গণমাধ্যমের কাছে বলেছেন। কোন কোন সমালোচক বলছেন ১৫ মাস আগে মন্ত্রিসভায় পরিবর্তন এনে খুব একটা ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। এর উত্তরে নতুন এক মন্ত্রী বলেছেন, ফুটবল খেলায় ১৫ মিনিট আগে নেমেও যদি কেউ গোল করতে পারে তাহলে কখন কে খেলতে নামল সেটা মানুষ মনে রাখে না। তার সাফল্যটাই বিচার করে। সরকার পরিচালনা কোন খেলার বিষয় নয়। তবে সরকারের কর্মকা- কিংবা আরও সুনির্দিষ্ট করে বলা যায় মন্ত্রীদের কর্মকা- একটি রিলে রেসের মতন। একজন অনেকদূর এগিয়ে দিয়ে যান বাকি জন হাল ধরেন। এটা একটি ধারাবাহিকতা। নতুন মন্ত্রীদের প্রথম থেকে শুরু করতে হবে বিষয়টি এমন নয়। তাঁরা সরকারের উন্নয়ন কর্মকা-ের ধারাবাহিকতা রক্ষা করবেন। মন্ত্রণালয়ের কাজকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। একটি মন্ত্রণালয়ে শুধু একজন মন্ত্রীই থাকেন না। সিনিয়র সচিব, উপ-সচিব, যুগ্ম-সচিব, অতিরিক্ত সচিব এবং সচিবদের নিয়ে চলে মন্ত্রণালয়। কাজেই এখানে কাজের একটি চেন অব কমান্ড আছে। অবশ্য ব্যক্তির কারণেও অনেক সময় পারফরমেন্সের তারতম্য ঘটে। কিন্তু সেটা খুব বেশি নয়। যেহেতু সরকার চলে একটি নির্দিষ্ট নিয়মে। আইন-কানুন বিধি বিধান রক্ষা করে।
দেখা যাচ্ছে মন্ত্রীরা যত বেশি তাঁর কাজের জন্য আলোচিত-সমালোচিত হন তার চেয়ে বেশি হন কথার জন্য। সাহারা খাতুনের ‘তালা দিয়ে বাড়ি যাবেন’ কিংবা ফারুক খানের ‘কম খাবেন, কম কম বাজারে যাবেন’ অথবা শাজাহান খানের ‘গরু ছাগল চিনলেই হলো’ জাতীয় কথাবার্তা তাঁদের নিয়ে যথেষ্ট আলোচনার খোরাক জুগিয়েছে। এবার ঈদ-উল ফিতরে দেশ প্রায় দুই সপ্তাহের ছুটির ফাঁদে পড়ে। এতে রাজধানী ত্যাগ করে প্রায় ৭০ লাখ মানুষ। রাজধানী ফাঁকা হয়ে গেলেও এই কয়দিনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ছিল খুবই স্বাভাবিক। অথচ মন্ত্রী এই ক্রেডিট নিতে পারলেন না শুধু তাঁর কথার জন্য। নতুন মন্ত্রীদের এই বিষয়টি মনে রাখতে হবে। তাঁদের কথায় বড় না হয়ে কাজে বড় হতে হবে। তাহলেই তাঁরা জনপ্রত্যাশা পূরণে সক্ষম হবেন।
harun_press@yahoo.com
No comments