ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল-শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিত করুন

সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল তা এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শুনানি শেষে ২০১১ সালের ১০ মে বাতিল করে দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। ১৬ মাস পাঁচ দিন পর আপিল বিভাগের দেওয়া সেই পূর্ণাঙ্গ রায়ে রবিবার সাবেক প্রধান বিচারপতি ও বর্তমান প্রধান বিচারপতিসহ সাত বিচারপতি স্বাক্ষর করার পর তা প্রকাশ করা হয়েছে।


তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন বর্তমান প্রধান বিচারপতিসহ তিন বিচারপতি, বিপক্ষে মত দিয়েছেন দুজন। তবে একজন বিচারপতি আপিল নিষ্পত্তি করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্তের দায়িত্ব জাতীয় সংসদের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পক্ষে মত দেন। এ রায়ে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল হওয়ার ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আপাত দৃষ্টিতে চূড়ান্তভাবে বিলুপ্ত হয়ে গেল। এ রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অবৈধ, বেআইনি ও বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। উল্লেখ্য, গণতান্ত্রিক আন্দোলনে এরশাদ সরকারের পতনের পর পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয় নির্দলীয় সরকারের অধীনে। সে নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে বর্তমান প্রধান বিরোধী দল বিএনপি তখন সরকার গঠন করে। কিন্তু একটি উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন করে। পরে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে সংবিধান সংশোধন করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। সেটাই ছিল সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী।
এ রায়ের সঙ্গে স্বভাবতই বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর এবং সেই সঙ্গে জনগণের স্বার্থ ও দাবি-দাওয়া জড়িয়ে আছে। বাস্তবতা হলো, এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রশ্নে দেশের দুটি রাজনৈতিক জোট সম্পূর্ণরূপে পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিয়েছে। জনমনে আতঙ্ক রয়েছে, বিষয়টির একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান না হলে দেশে অস্বাভাবিক রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে বিজ্ঞ আদালতের রায়ের মধ্যেই শান্তিপূর্ণ সমাধানের সুযোগ রয়ে গেছে। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের বাংলায় লিখিত রায়ের একটি পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, 'সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধন) আইন, ১৯৯৬, অসাংবিধানিক ও অবৈধ হইলেও জাতীয় সংসদ ইহার বিবেচনা (Discretion) ও সিদ্ধান্ত অনুসারে ওপরে বর্ণিত নির্দেশাবলি সাপেক্ষে দশম ও একাদশ সাধারণ নির্বাচনের সময় প্রয়োজনমতো নতুনভাবে ও আঙ্গিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে পারিবে।' সুতরাং দেশে একটি শান্তিপূূর্ণ পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার ও সুযোগ এখনো জাতীয় সংসদের রয়েছে। এ ছাড়া ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলসংক্রান্ত সুপ্রিম কোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন করার সুযোগ রয়েছে। এই পুনর্বিবেচনা আপিল বিভাগে গৃহীত হলে বর্তমান প্রধান বিচারপতি উপযুক্ত বেঞ্চ গঠনে তাঁর এখতিয়ার প্রয়োগ করবেন।
নিঃসন্দেহে দেশকে গণতান্ত্রিকভাবেই চলতে হবে, দেশের নির্বাচন হতে হবে সংবিধানের আলোকে। রাজনৈতিক হানাহানির মধ্য দিয়ে এর ব্যত্যয় ঘটলে অপরাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটার আশঙ্কা থাকে। বাংলাদেশের মানুষের একাধিকবার অরাজনৈতিক শক্তির সুযোগ গ্রহণ দেখার তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। সুতরাং গণতন্ত্রে বিশ্বাসী সব রাজনৈতিক দলকে এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। যেকোনো মূল্যে এ দেশের জনগণ অবাধ, শান্তিপূর্ণ ও সর্বজনগ্রাহ্য একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চায়। তবে সেই সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস স্থাপনের প্রয়োজন রয়েছে। যদি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নূ্যনতম আস্থা ও বিশ্বাস গড়ে না ওঠে তাহলে যেকোনো পদ্ধতির নির্বাচন ও দেশ পরিচালনা নিয়ে সহিংস বিরোধিতা চলতে থাকবে। নূ্যনতম আস্থা ও বিশ্বাস তৈরি না হওয়ায় বাংলাদেশের ইতিহাসে সব নির্বাচনের ফলাফল পরাজিত পক্ষ মেনে নেয়নি। এ সংস্কৃতি থেকেও জাতির বেরিয়ে আসা প্রয়োজন।

No comments

Powered by Blogger.