বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৫১৫ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন।  শহীদ আফসার আলী, বীর বিক্রম বিক্রমী এক যোদ্ধা সিলেট শহরের উপকণ্ঠে এমসি কলেজের পাশে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্ত প্রতিরক্ষা। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর, আফসার আলীসহ এক দল মুক্তিযোদ্ধা এই প্রতিরক্ষার মুখোমুখি হন।


তাঁরা ছিলেন কয়েকটি দলে বিভক্ত। তিনি ছিলেন ‘ডি’ দলে। আর এই দলটি ছিল একদম সামনে। পাকিস্তানিদের নাকের ডগায় পরিখা (ট্রেঞ্চ) খনন করে তাঁরা অবস্থান নেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের নিজেদেরই লোক ভেবে পাকিস্তানি সেনারা নির্বিকার থাকে। কারণ, মুক্তিযোদ্ধাদের পোশাক ও হেলমেট ছিল পাকিস্তানিদের মতোই। এ ছাড়া পেছনে ও বাঁ দিকে খাদিমনগরে তখন যুদ্ধ চলছিল। এত তাড়াতাড়ি মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে উপস্থিত হবেন, পাকিস্তানিরা কল্পনাও করেনি। তারা কেউ কেউ চিৎকার করে পরিচয় জানতে চায়। আফসার আলীরা জবাব না দিয়ে নীরব থাকেন।
এ সময় সেখানে সামনের রাস্তায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি আর্টিলারি গানবাহী পিকআপ ও দুটি জিপের কনভয় থামে। সেটা দেখে মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের আর নিবৃত্ত করতে পারেননি। সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা মর্টার থেকে গোলাবর্ষণ করেন। একটি জিপে আগুন ধরে যায়। তখন পাকিস্তানি সেনারা সন্দিহান এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ছোটাছুটি করে। এ সুযোগে মুক্তিযোদ্ধারা মেশিনগান, হালকা মেশিনগানসহ অন্যান্য অস্ত্র দিয়ে আক্রমণ শুরু করেন।
এতে তাৎক্ষণিক ২৫ জন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। একটু পর পাকিস্তানিরাও পাল্টা আক্রমণ করে। নিমেষে সেখানে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। পাকিস্তানিরা সর্বশক্তি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আফসার আলীরা বিপুল বিক্রমে পাল্টা আক্রমণ মোকাবিলা করেন। তিনি অসাধারণ সাহসের পরিচয় দেন। মুখোমুখি যুদ্ধের একপর্যায়ে একঝাঁক গুলি ছুটে আসে তাঁর দিকে। কয়েকটি গুলি লাগে তাঁর দেহে। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। নিভে যায় তাঁর প্রাণবায়ু। শহীদ হন তিনি।
সেদিন যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর আফসার আলীসহ ২০ জন শহীদ ও ২১ থেকে ২২ জন আহত হন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রায় ৭০ জন নিহত ও অসংখ্য আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব ও রণনৈপুণ্যের কাছে পাকিস্তানিরা শেষ পর্যন্ত হার মানতে বাধ্য হয়। তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে কিছু আত্মসমর্পণ এবং বাকিরা শহরের দিকে পালিয়ে যায়। যুদ্ধ শেষে শহীদ আফসার আলীর মরদেহ সহযোদ্ধারা সমাহিত করেন শাহজালাল মাজারসংলগ্ন এলাকায়। তাঁর সমাধি চিহ্নিত।
আফসার আলী চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। এর অবস্থান ছিল যশোর সেনানিবাসে। তাঁর পদবি ছিল নায়েক। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে যান। পরে জেড ফোর্সের অধীনে ধলই বিওপি, আটগ্রাম, কানাইঘাটের গৌরীপুরসহ বিভিন্ন স্থানে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে অসীম সাহস ও বীরত্বের জন্য শহীদ আফসার আলীকে মরণোত্তর বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৫৫। গেজেটে ভুলক্রমে শহীদ লেখা হয়নি।
শহীদ আফসার আলীর বাড়ি গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার মহদিপুর ইউনিয়নের জালাগারি গ্রামে। বাবার নাম কবেজ আলী। মা আছিয়া বেওয়া।
কবেজ আলী বলেন, ‘আমার ছেলে যুদ্ধে শহীদ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ১০০ টাকা শুরু করে এখন দেড় হাজার টাকা সম্মানী ভাতা পাচ্ছি। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো মর্যাদা পাইনি। আগে প্রশাসন বিজয় ও স্বাধীনতা দিবসে আমাকে অতিথি করত। এখন আর বলে না। ছেলের নামে কোনো কিছুর নামকরণের জন্য অনেকবার বলেছি, কোনো কাজ হয়নি।’ শহীদ আফসার আলীর ছবি পাওয়া যায়নি।
সূত্র: প্রথম আলোর গাইবান্ধা প্রতিনিধি শাহাবুল শাহীন, মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ব্রিগেডভিত্তিক ইতিহাস।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
rashedtr@prothom-alo.info

No comments

Powered by Blogger.