চরাচর-ঢাকা শহরের মাঝি by শরাফত হোসেন

বাংলাদেশের সর্বত্রই দেখা যায় অনিয়মের ছায়া। কোনো নিয়ম-শৃঙ্খলার বালাই নেই। ব্যতিক্রম দেখা গেল গুলশান ১ নম্বরে প্রবেশমুখের সেতুসংলগ্ন নৌকাঘাটের মাঝিদের বেলায়। এই ঘাটে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকে নৌকা, একটি যাত্রী বোঝাই হয়ে ছেড়ে গেলে অন্যটি যাত্রী বোঝাইয়ের জন্য প্রস্তুত হয়।


কোনো নৌকায় ছয়জনের বেশি যাত্রী ওঠানো হয় না। দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেও এ নিয়মের ব্যত্যয় চোখে পড়েনি। গুলশান সেতুসংলগ্ন ঘাট থেকে কড়াইল বস্তি ঘাট পর্যন্ত যাত্রী পারাপার চলছে নিয়ম মেনে। মাথাপিছু দুই টাকা ভাড়া, শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে পারাপার, এক দিন অন্তর নৌকা চালানো ইত্যাদি নিয়ম মেনে চলেন এ ঘাটের মাঝিরা। এই ঘাটের প্রায় সব মাঝিই নৌকা চালানোর পাশাপাশি অন্যান্য কাজ করেন। কারণ এ ঘাটে পর পর দুদিন নৌকা চালানোর নিয়ম নেই। এ নিয়ে কারো আক্ষেপও নেই, নিয়মটাই তাঁদের কাছে সহজাত। জীবনের টানাপড়েন, নানা ঘাত-প্রতিঘাত, সংগ্রামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই ঘাট। অনেকের আবার জীবনধারণের অবলম্বন শুধু এই ঘাট ও নৌকা। কথা হয় মো. দেলোয়ার মাঝির সঙ্গে। তাঁর বয়স ৫০ বছর। প্রায় ২০ বছর ধরে বাস করছেন কড়াইল বস্তিতে। এই ঘাটে মাঝি হিসেবে যাত্রী পারাপর করছেন ১০ বছরের বেশি সময় ধরে। আগে গুলশান, বনানী, মহাখালী এলাকায় মুড়ি বিক্রি করতেন। এখনো এক দিন পর পর মুড়ি বিক্রি করেন। তবে আনন্দ পান নৌকায় যাত্রী পারাপার করে। এখানে মোট ৮৮টি নৌকা আছে। প্রতিটিতে নম্বর দেওয়া আছে। প্রতিদিন ৪৪টি করে নৌকা চলে।
মো. দেলোয়ার প্রায় ২৫ বছর আগে অনেক স্বপ্ন নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন গ্রামের এক বড় ভাইয়ের সঙ্গে। প্রথমে এসে ওঠেন মহাখালী কলেরা হাসপাতালের পাশে একটি বস্তিতে, শুরু করেন রিকশা চালানো। বছর পাঁচেক পর শুরু করেন মুড়ি বিক্রি, এখন পাশাপাশি করছেন গুদারা মাঝির কাজ। প্রথমে কিছুদিন নৌকা ভাড়া করে যাত্রী পারাপার করেছেন। প্রতিদিন ভাড়া বাবদ দিতে হতো ১২০ টাকা। দুই বছর আগে সদরঘাট থেকে ১৬ হাজার টাকায় একটি নৌকা কেনেন। এই নৌকাই তাঁর একমাত্র সম্বল বলে জানান তিনি। মুড়ি বিক্রি ও যাত্রী পারাপারের টাকার কিছু অংশ সঞ্চয় করে জোগান নৌকার দাম। এই ঘাটে যাঁরা নৌকা চালান, তাঁদের সবারই নৌকা নেই, অনেকে নৌকা ভাড়া নিয়ে যাত্রী পারাপার করেন। তবে তাঁদের সবার জীবনের গল্প প্রায় একই রকম। নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও জীবনসংগ্রামে টিকে আছেন একে অপরের সহযোগী হয়ে। প্রতিদিন আট টাকা হারে 'নৌকা-ঘাট মালিক সমিতি'তে জমা দেন। এই টাকা ব্যয় হয় মসজিদ পরিচালনা ও অন্যান্য উন্নয়ন কাজে। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তাঁরা সব বাধা মোকাবিলা করেন, আর সব কিছুই করেন নিয়মের মধ্যে।
শরাফত হোসেন

No comments

Powered by Blogger.