সমকালীন প্রসঙ্গ-দেশে দেশে মার্কিন ঔদ্ধত্য by বদরুদ্দীন উমর

আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে বিশেষ মার্কিন দূত মার্ক গ্রসম্যানের সঙ্গে ১৬ সেপ্টেম্বর কথাবার্তার পর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জারদারি জানান, পাকিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ড্রোন বা চালকবিহীন বিমান হামলা বন্ধের জন্য তিনি তাদের কাছে দাবি জানিয়েছেন (ডেইলি স্টার, ১৭.৯.২০১২)।


এই দাবি পাকিস্তান অনেক দিন থেকেই জানিয়ে আসছে কিন্তু তার দ্বারা কোনো কাজ হয়নি। পাকিস্তান সরকারের কোনো অনুমতি ছাড়া অর্থাৎ পাকিস্তানের ভূখণ্ড এবং আকাশে চড়াও হয়ে তারা এই বিমান হামলা নিয়মিতভাবেই পাকিস্তানের অভ্যন্তরে চালিয়ে যাচ্ছে। গণতন্ত্রের মুখোশধারী ও ইচ্ছামতো পরদেশ আক্রমণকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই হামলা যে পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বের ওপরই হামলা এতে সন্দেহ নেই। গণতন্ত্র রক্ষার নামে দেশের পর দেশে তারা হামলা চালায় নিজেদের প্রয়োজনে। এই সাম্রাজ্যবাদী হামলা আফগানিস্তান, ইরাক, পাকিস্তান, লিবিয়া ইত্যাদি দেশে সাম্প্রতিক সময়ে তারা চালিয়ে এসেছে, এখনও চালিয়ে যাচ্ছে এবং ইরানে হামলা করার হুমকিও দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে অন্য দেশের স্বার্থ এবং সার্বভৌমত্বকে হিসাবের মধ্যে গণ্য করার প্রয়োজন তাদের হয় না। জোর যার মুলুক তার এই ভিত্তিতেই তারা নিজেদের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নির্ধারণ ও কার্যকর করতেই নিযুক্ত থাকে।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট 'বিনীতভাবেই' মার্কিন বিশেষ দূতের কাছে ড্রোন হামলা বন্ধে দাবি জানিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে এই ধরনের হামলা একটি দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণারই শামিল। কিন্তু পাকিস্তান এমনই দেশ যে, একে যুদ্ধ ঘোষণা মনে না করে তারা বন্ধুমূলক দাবি মার্কিন সরকারের কাছে জানাচ্ছে তাদের সামরিক হামলা বন্ধের জন্য! এই দেশটি নিজেদের কোন অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছে এর থেকেই সেটা বোঝা যায়। ইতিপূর্বে ড্রোন হামলায় ২৪ জন পাকিস্তানি সৈন্য ওয়াজিরিস্তানে নিহত হওয়ার পর তারা দেশের মধ্য দিয়ে আফগানিস্তানে ন্যাটোর সরবরাহ লাইন বন্ধ করেছিল। এই লাইন খুলে দেওয়ার জন্য তারা মার্কিন সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছিল ক্ষমা প্রার্থনার। কিন্তু পরদেশে সামরিক হামলা চালানোর 'তুচ্ছ' কারণে মার্কিন সরকার তাদের ওপর নির্ভরশীল দেশের কাছে ক্ষমা চাইবে এটা তাদের জাতীয় সম্মানের বরখেলাপ বলেই তারা মনে করে। কাজেই সরবরাহ লাইন বন্ধ থাকা সত্ত্বেও তারা ক্ষমা চায়নি। মধ্য এশিয়ার দুই-একটি দেশের মধ্য দিয়ে তারা সরবরাহ চালু রাখলেও তার পরিমাণ কম এবং ব্যয় বেশি হচ্ছিল। সে ক্ষেত্রেও অসুবিধা দেখা দেওয়ায় তারা শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা না করে তাদের পররাষ্ট্র সচিব হিলারি ক্লিনটন এ ব্যাপারে 'দুঃখ প্রকাশ' করে সরবরাহ লাইন তাদের জন্য উন্মুক্ত করতে বলেন! এই 'দুঃখ প্রকাশে' সন্তুষ্ট হয়ে পাকিস্তান সরকার সরবরাহ লাইন আবার ন্যাটো অর্থাৎ দৃশ্যত মার্কিন সরকারের কাছে উন্মুক্ত করে। এ ক্ষেত্রে লক্ষ্য করার বিষয় যে, সীমান্ত এলাকায় শত শত শিশু, বৃদ্ধ, নারীসহ সাধারণ নাগরিক নিহত হতে থাকলেও তারা ন্যাটোর সরবরাহ লাইন বন্ধ করেনি। সেটা বন্ধ করেছিল মাত্র ২৪ জন সৈন্য নিহত হওয়ার পর। আবার এভাবে সরবরাহ লাইন খুলে দেওয়ার শর্ত হিসেবে তারা ড্রোন হামলা একেবারে বন্ধ করার দাবি না জানিয়ে শুধু ২৪ জন সৈন্য হত্যার জন্য ক্ষমা প্রার্থনার দাবি করেছিল! এর থেকেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের চরিত্র এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর তাদের নির্ভরশীলতার মাত্রা ভালোভাবেই বোঝা যায়। এর থেকে বোঝা যায় যে, দেশের সার্বভৌমত্ব নিয়েও তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। অন্য কোনো দেশ তাদের ওপর এই ধরনের সামান্য হামলা করলে তারা শোরগোল তুলে ফাটাফাটি করতে পারে; কিন্তু মার্কিন হামলার বিরুদ্ধে তাদের সে রকম প্রতিক্রিয়া নেই! এই হামলার অধিকার তারা নিজেদের দাসত্বের কারণে তাদের দিয়ে রেখেছে! পাকিস্তানের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের কিছু অবনতি সাম্প্রতিককালে হলেও এটা তারা ভালোভাবেই জানে এবং জানে বলেই তারা পাকিস্তান-আফগান সীমান্তে পাকিস্তান এলাকার মধ্যে ঢুকে বেপরোয়াভাবেই তাদের ড্রোন হামলা চালিয়ে যাচ্ছে।
এদিক দিয়েই গাদ্দাফির লিবিয়া, সিরিয়া এবং ইরানের মতো দেশের সঙ্গে পাকিস্তানের পার্থক্য। সামরিক হামলার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং মধ্যপ্রাচ্যে তাদের সর্বপ্রধান ফ্যাসিস্ট সহযোগী রাষ্ট্র ইসরায়েল ইরানকে হুমকি দিয়ে আসছে। কিন্তু তাদের এই হুমকির কাছে বিন্দুমাত্র নতি স্বীকার না করে ইরান সবসময়ই খুব স্পষ্টভাবে উভয় রাষ্ট্রকেই পাল্টা হুমকি দিয়ে বলেছে যে, তাদের দ্বারা ইরান আক্রান্ত হলে তারা ইসরায়েলকে ধূলিসাৎ এবং মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক স্থাপনাগুলোতে মিসাইল আক্রমণ পরিচালনা করবে। ইসরায়েল ইরান আক্রমণের জন্য অস্থির চুলকানি সত্ত্ব্বেও এ কারণেই বাস্তবত ইরান আক্রমণ করতে সক্ষম হচ্ছে না। তাছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সারা উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে জনগণের ব্যাপক বিক্ষোভ এবং নানা পরিবর্তনের কারণে তাদের সাম্রাজ্যবাদী থাবা ক্রমশ ও দ্রুত আলগা হয়ে আসছে। এই অবস্থায় ইরান আক্রমণ করলে তাদের বিরুদ্ধে যে দাবানল সমগ্র অঞ্চলজুড়ে সৃষ্টি হবে তাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আমূলভাবে পরিবর্তিত হওয়ার ষোলআনা সম্ভাবনা।
এসব ইরান সরকারের ভালোভাবেই জানা আছে। কাজেই প্রকাশ্যেই একথা বলতে তাদের অসুবিধা নেই যে, সিরিয়া ও লেবাননে তাদের সামরিক উপস্থিতি আছে। এই মর্মে তাদের গার্ডস কমান্ডার জেনারেল মাহমুদ আলী জাফারি ১৬ সেপ্টেম্বর এক ব্যতিক্রমী সংবাদ সম্মেলনে জানান যে, কুদস বাহিনী নামে গার্ডস বাহিনীর এক বিশেষ বাহিনী লেবানন ও সিরিয়ায় সক্রিয় আছে (ডেইলি স্টার, ১৭.৯.২১২)। তাদের কাজ হচ্ছে সিরিয়ায় বিরোধী সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত সিরীয় বাহিনীকে 'পরামর্শ' দেওয়া। কিন্তু 'পরামর্শ' দেওয়ার কথা বলা হলেও লেবানন ও সিরিয়ায় ইরানের সামরিক উপস্থিতি যে আছে এটা প্রকাশ্যে সংবাদ সম্মেলনে বলা সম্ভব হতো না, যদি ইরান মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিনসহ ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী এবং সৌদি আরব ও কুয়েতের মতো দেশের দুর্বল হতে থাকা বিষয়টি উপলব্ধি না করত।
গার্ডস কমান্ডার জেনারেল জাফারি সংবাদ সম্মেলনে বেশ স্পষ্ট ভাষাতেই বলেন যে, সিরিয়াকে সাহায্য করতে পারায় তারা গর্বিত। তিনি আরও বলেন, ইরানের ওপর কোনো আক্রমণ হলে তার পাল্টা হিসেবে তেলসমৃদ্ধ উপসাগরে হরমুজ প্রণালি, মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলো এবং ইসরায়েল আক্রান্ত হবে। এর ফলে বিশ্বজুড়ে বিশাল আকারে তেল সংকট দেখা দেবে। এই সঙ্গে তিনি বলেন, সেই অবস্থায় বাহরাইন, কুয়েত ও সৌদি আরবে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটিগুলোও ইরানের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে। ফলে ইসরায়েলের অস্তিত্ব বলেও আর কিছু থাকবে না।
ইরান আক্রান্ত হলে ইসরায়েল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কী ক্ষতি হবে তার এই হিসাবকে বাইরে রেখে এ কথা বলা যায় যে, এর পরিণতিতে ইতিমধ্যেই উত্তপ্ত মধ্যপ্রাচ্যের দেশে দেশে অগি্নকাণ্ড হবে। শুধু এর দ্বারা যে ইসরায়েল ব্যাপকভাবে অস্তিত্বের সংকটে নিক্ষিপ্ত হবে তাই নয়, মার্কিনসহ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো মধ্যপ্রাচ্য থেকে উৎখাত হওয়ার শর্তও তৈরি হবে।
১৭.৯.২০১২

বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি
জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
 

No comments

Powered by Blogger.