দুঃসংবাদের চাপে উপেক্ষিত সুখবর by মৌমাছি
কালের কণ্ঠে ১২ সেপ্টেম্বর প্রথম পৃষ্ঠায় তৌফিক মারুফের একটি রিপোর্ট ছাপা হয়। শিরোনাম: ‘কাজে আসছে না টাইফয়েডের ওষুধ, উদ্বিগ্ন চিকিৎসকরা’। উদ্বেগজনক ব্যাপার নিঃসন্দেহে। তবে এর চাইতেও উদ্বেগজনক ছবি ও খবর ছাপায় ওই দিন সব পত্রিকা।
আগের দিনের পত্রিকায় ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে যাওয়ার ‘অপরাধে’ ছাত্রদলকর্মীদেরকে ছাত্রলীগের বেধড়ক পিটুনির খবর ও ছবি। পরদিনের সব পত্রিকায় খবর ও ছবি ছাপা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলকর্মীদেরকে ছাত্রলীগের বেধড়ক পিটুনি। টাইফয়েডের ক্ষেত্রে ওষুধ প্রয়োগ করেও তা কাজে আসছে না, আর ছাত্রলীগের ক্ষেত্রে কোনো ওষুধ প্রয়োগ করা হচ্ছে, এমন খবরও দিতে পারছে না পত্রপত্রিকা। বরং পরদিন কালের কণ্ঠের শীর্ষ সংবাদটি ছিল আরো ভীতিকর: ‘ছাত্রলীগ টেনশন ভিসিদের।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা একদল ছাত্রনামধারীর ভয়ে কম্পমান। কী সুন্দর দেশ!
তবে ছাত্রলীগকে ‘ওষুধ’ না দিলেও সরকার নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে এমনটি ভাবার যে আদৌ অবকাশ নেই, তা জানা যায় ১২ সেপ্টেম্বর নয়া দিগন্তে তৌহিদুল ইসলামের রিপোর্ট ‘নির্বাচন সামনে রেখে ঢেলে সাজানো হচ্ছে পুলিশ’। উপশিরোনাম: ‘দলীয় পরিচয়ে ৩২ হাজার নিয়োগ’। একই দিন নয়া দিগন্তের শীর্ষ সংবাদ ছিল ‘শেয়ারবাজারে খেলোয়াড়দের আনাগোনা’। এছাড়া আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খবর ‘এলসি জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংকিং খাত থেকে শত কোটি টাকা লোপাট’। এছাড়া এদিন আমার দেশ-এর দ্বিতীয় শীর্ষ সংবাদ ছিল ‘স্বাস্থ্যখাতে হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি’। সব মিলিয়ে বলা চলে, অপশক্তি বসে নেই। তারা সতত আগুয়ান।
১৩ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিসভায় রদবদল সংক্রান্ত খবরটি সব পত্রিকায় গুরুত্ব পায়। প্রথম আলো এটিকে শীর্ষ সংবাদ করে। তবে এদিন তার চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ খবর ছিল লিবিয়ার বেনগাজিতে আমেরিকান দূতাবাসে জনতার হামলায় রাষ্ট্রদূতসহ চার জন নিহত এবং পাকিস্তানে অগ্নিকাণ্ডে তিন শতাধিক মানুষের প্রাণহানি। দুয়ের মধ্যে হামলার খবরটিকে পত্রিকাগুলো কিছুটা গুরুত্ব দিলেও পাকিস্তানের খবরটি অর্থাৎ তিন শ’র বেশি মানুষের পুড়ে মারা যাওয়ার খবরটিকে অনেক পত্রিকা গুরুত্ব দেয়নি। ব্যতিক্রম ছিল ইত্তেফাক ও নিউ এজ। তারা উভয় খবরকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে ছেপেছে।
একই দিন ইত্তেফাক প্রথম পৃষ্ঠায় ডাবল কলাম বক্স করে ছাপায় আরেকটি চাঞ্চল্যকর খবর ‘হাসিনা-খালেদাকে হত্যার ষড়যন্ত্র?’ বিদেশী নিউজ পোর্টাল সালেম-নিউজ ডটকমের বরাত দিয়ে প্রকাশিত খবরটিতে বলা হয়, ‘একটি বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় খালেদা জিয়াকে হত্যার ষড়যন্ত্র হচ্ছে’। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছে জঙ্গিরা।
বাংলা সাহিত্যের বরেণ্য লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর জন্মদিন ছিল ১৩ সেপ্টেম্বর। কিন্তু সংবাদপত্রগুলো দেখে তা’ বোঝার উপায় ছিল না। ব্যতিক্রম ছিল ঐতিহ্যবাহী দৈনিক সংবাদ। তারা সম্পাদকীয় পৃষ্ঠায় তাঁকে স্মরণ করে প্রশংসনীয় কাজটি করে।
একই দিন সংবাদের শীর্ষ সংবাদ ছিল ‘অস্থিতিশীল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়’। এর উপশিরোনাম ‘ছাত্রলীগের সন্ত্রাস, অভ্যন্তরীণ কোন্দল: সুযোগ নিচ্ছে ছাত্রদল-শিবির’। রাকিব উদ্দিন ও আলী আজমের করা রিপোর্টটির উপশিরোনামের যৌক্তিকতা সারা রিপোর্টের কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। এতে বলা হয়েছে, ‘ঢাকা এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ ক্যাডারদের কাছে মার খেয়েছে ছাত্রদলের কিছু অছাত্র নেতা। এ সুযোগে সক্রিয় হচ্ছে মৌলবাদী ছাত্রসংগঠনগুলো। তারা যেকোনো মূল্যে ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তারে মরিয়া’। এ-ই হচ্ছে খবরটির উপশিরোনামের (সুযোগ নিচ্ছে ছাত্রদল-শিবির) যৌক্তিকতার ‘প্রমাণ’। এছাড়া আর কোথাও ‘সুযোগ নেয়ার’ বিষয়ে একটি লাইনও নেই খবরটিতে। পাঠক প্রশ্ন করতে পারেন, ছাত্রদলের নেতারা যদি ‘অছাত্র’ হয়েও থাকেন, তাদেরকে মারপিট করার অধিকার ছাত্রলীগকে কে দিয়েছে? মৌলবাদী ছাত্রসংগঠনগুলো বলতে কী বোঝানো হয়েছে, ছাত্রদল কি মৌলবাদী সংগঠন? আর কোনো ছাত্রসংগঠন যদি সন্ত্রাস ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলে লিপ্ত হয়, তবে প্রতিপক্ষ তার সুযোগ নেবে না? যেকোনো বৈধ ছাত্রসংগঠন বৈধ পন্থায় ক্যাম্পাসে প্রাধান্য বিস্তার করতে চাওয়া কী অপরাধ? -এসব প্রশ্নের কোনো জবাব নেই রিপোর্টটিতে। সংবাদ-এর মতো একটি ঐতিহ্যবাহী পত্রিকা, যার বয়স এখন ৬২, তার শীর্ষ সংবাদ হতে পারলো এটি! বিস্ময়করই বটে।
তবে বাংলাদেশে কি কিছুতেই বিস্মিত হতে আছে? না, নেই। একেবারেই নেই। তার প্রমাণ ১৩ সেপ্টেম্বর আমার দেশ-এর শীর্ষ সংবাদ। আবদুল্লাহিল গালিবের করা রিপোর্টটি থেকে জানা যায়, কুখ্যাত হলমার্ক কেলেঙ্কারির অন্যতম হোতা হচ্ছে সোনালী ব্যাংকের ডিএমডি মইনুল হক। সদ্য ওএসডি হওয়া এই হক সায়েব আবার বিতর্কিত সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের ভাই। রিপোর্ট পড়ে জানা যায়, ডিএমডি মহোদয়ের বিরুদ্ধে রূপালী ও কৃষি ব্যাংক থেকে অর্থ আত্মসাৎ ও জালিয়াতির একাধিক মামলা হয়েছে। ১/১১ সময়ে গঠিত ট্রুথ কমিশনে তিনি নিজের দুর্নীতির কথা স্বীকারও করেছিলেন। তারপরও পরবর্তী মহাজোট সরকার তাকে সোনালী ব্যাংকের ডিএমডি বানায়।
পর দিন ১৪ সেপ্টেম্বর জানা যায় আরো ‘মজার’ এক খবর। আমার দেশ এদিন দ্বিতীয় শীর্ষ সংবাদ করে এম. আবদুল্লাহর রিপোর্ট ‘আবুল হোসেনেরই জয় হলো: পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারিতে জড়িত সাকোর এমডি হলেন মন্ত্রী’। এই এমডি মহোদয়ের নাম মোস্তফা ফারুক মোহাম্মদ। পরদিন আমার দেশ নবনিযুক্তি দুই মন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও আবদুল হাইকে নিয়ে দ্বিতীয় শীর্ষ সংবাদ করে। অলিউল্লাহ নোমান ও আহসান কবীরের রিপোর্টে বলা হয়, মখা আলমগীর সুপ্রিম কোর্টের রায়ে এমপি হিসেবে অযোগ্য আর আবদুল হাইয়ের বিরুদ্ধে রয়েছে পাসপোর্ট কেলেঙ্কারিসহ নানা অভিযোগ।
এত অভিযোগ সত্ত্বেও তাদের ঠেকানো যায়নি ‘সব সম্ভবের’ এই দেশে। তবে মাঝে-মধ্যে সব সম্ভবও সম্ভব হয় না। যেমন, সম্ভব হয়নি আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা তোফায়েল আহমদ ও মহাজোটের বামপন্থী নেতা রাশেদ খান মেননকে মন্ত্রিসভায় টানা। মন্ত্রিসভায় যোগদানে তাদের অস্বীকৃতির খবরটি পরদিন এবং তারও পরদিন নানাভাবে ছাপায় পত্রিকাগুলো। বিশেষ করে মেননের মন্তব্য ‘কোনো সভ্য দেশে কাউকে এভাবে মন্ত্রী করা হয় না’ ফলাও প্রচার পায়। তবে মন্ত্রিসভার সম্প্রসারণের খবরটির সবচাইতে চমকপ্রদ শিরোনামটি দিয়েছে আমার দেশ ‘শেষ বেলায় ৭ মন্ত্রী’। অবশ্য তাদের উপশিরোনাম ‘মন্ত্রিত্ব প্রত্যাখ্যান করে ইতিহাস সৃষ্টি তোফায়েল-মেননের’ পড়ে পাঠক প্রশ্ন করতেই পারেন, মন্ত্রিত্ব গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যানে কী এমন ‘ইতিহাস’ সৃষ্টি হয়!
বরং ওই দিন ‘ইতিহাস’ সৃষ্টি করেছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক। আমার দেশ সিঙ্গল কলামে খবরটি পরিবেশন করে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু: দ্বিতীয় বারের মতেহা রায় লিখে জমা দিলেন বিচারপতি খায়রুল হক’ শিরোনামে। এতে বলা হয়, ‘রায় ঘোষণার ১৩ মাস পর সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক গত জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে জানিয়েছিলেন, তিনি রায় লিখে জমা দিয়েছেন। জমা দেয়ার পর কেন রায়টি প্রকাশ হচ্ছে না- এ নিয়ে তিনি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন। তখন বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে সংবাদও প্রকাশিত হয়েছিল বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক রায় লিখে জমা দিয়েছেন বলে। এখন আবার তিনি রায়ে গতকাল স্বাক্ষর করে সুপ্রিম কোর্টে জমা দিয়েছেন বলে জানা গেছে। বেলা আড়াইটার দিকে তার স্বাক্ষরিত রায়টি সুপ্রিম কোর্টে পাঠান বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। গতকাল রায় জমা দেয়ার বিষয়টি সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রার সাংবাদিকদের কাছে স্বীকার করেছেন।’
একই দিন অর্থাৎ ১৪ সেপ্টেম্বর কালের কণ্ঠে মন্ত্রিসভার সম্প্রসারণ নিয়ে আশরাফুল হক রাজীব রিপোর্ট করেন ‘আরো নাটকীয়তার অপেক্ষা! পরে ১৬ সেপ্টেম্বর সেই নাটকীয়তার খবর ছাপায় সবগুলো পত্রিকা। স্বারাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হারান সাহারা খাতুন, তথ্য হাতছাড়া হয় আবুল কালাম আজাদের, ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব চলে যায় ড. আবদুর রাজ্জাকের কাছ থেকে, রেল নিয়ে তৎপর ওবায়দুল কাদেরের হাতে থাকে না রেলপথ মন্ত্রণালয়। কালের কণ্ঠ এদিন শীর্ষ সংবাদের শিরোনাম দেয় ‘পাঁচ মন্ত্রীর ক্ষমতা খর্ব’। এছাড়াও নাটকীয়তা বা চমকের খবর আগেভাগে দিতে পেরে এগিয়ে গেছে কালের কণ্ঠ।
একই দিন ‘লিবিয়ার পথে মার্কিন রণতরী’ খবরটিকে যথাযথ গুরুত্বসহকারে পরিবেশন করে এগিয়ে যায় নয়া দিগন্ত ও ইত্তেফাকও। ব্যাপারটি শুধু লিবিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের নয়, বরং গ্লোবাল ভিলেজ যুগে আমরা কেউ এই বাস্তবতার বাইরে নই। কাজেই এ খবরটি বাংলাদেশের জন্যও সমান গুরুত্বপূর্ণ- এ সত্যটি পত্রিকাগুলো বোঝেনি বা বুঝতে চায়নি।
১৫ সেপ্টেম্বরে একই বিষয় নিয়ে শীর্ষ সংবাদ করে দু’টি পত্রিকা- প্রথম আলো ও নয়া দিগন্ত। প্রথম আলোর শিরোনাম ছিল ‘সরকার ও জোটে অস্বস্তি’ এবং নয়া দিগন্ত শিরোনাম করে ‘সরকারে অস্থিরতা’।
একই দিন কালের কণ্ঠ লিখে ‘মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণের উদ্দেশ্য ভেস্তে গেছে!’ রিপোর্টটি করেছেন পাভেল হায়দার চৌধুরী। ওই দিন প্রথম আলোতে আনোয়ার হোসেনের রিপোর্ট ছিল ‘একের পর এক কেলেঙ্কারিতে সরকার’।
১৬ সেপ্টেম্বর একটি উদ্বেগজনক এবং আরেকটি হাস্যোদ্দীপক খবর ছাপায় আমার দেশ। উদ্বেগজনক হলো ড. কামালের একটি বক্তব্য। তিনি বলেছেন, ‘আমি গুম হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে আছি’। হাস্যকর খবরটি হলো, চার হাজার কোটি টাকা ঋণ কেলেঙ্কারির হোতা হলমার্ক পাঁচ লাখ টাকা ফেরৎ দিয়েছে সোনালী ব্যাংককে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ঘোষণা (১৫ দিনের মধ্যে দুই হাজার কোটি টাকা ফেরৎ দেবে হলমার্ক গ্রুপ) অনুযায়ী সোনালী ব্যাংক ওই পরিমাণ অর্থ ফেরৎ দেয়ার জন্য হলমার্ককে সময় বেঁধে দেয়। নির্ধারিত সময় শেষ হবার দু’দিন আগে তাই পাঁচ লাখ টাকা ফেরৎ দিয়ে অর্থমন্ত্রী ও সোনালী ব্যাংকের ইজ্জত বাঁচালো হলমার্ক। সংবাদটি প্রকাশ করে ধন্যবাদাই হয়েছে আমার দেশ।
‘নতুন’ পত্রিকা মানবকণ্ঠ বাজারে আসে ১৬ সেপ্টেম্বর। এদিনের সংখ্যাটি ছিল পত্রিকার ১২ বর্ষ ১৯৩ সংখ্যা। সম্পাদক শাহজাহান সরদার। প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয় বিশেষ সম্পাদকীয় ‘সুস্থ ধারার সাংবাদিকতা আমাদের অঙ্গীকার’। তবে প্রথম দিনেই ‘হোঁচট’ খায় মানবকণ্ঠ। পঞ্চম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত তিনটি লেখার দু’টিরই শেষ কোথায় খুঁজে পাওয়া যায়নি। দ্বিতীয় দিন ‘খেলা’ বিভাগের শীর্ষ সংবাদের প্রথম লাইনেই লেখা হয় ‘ঈশা খাঁর আমলে বাংলায় আট মণ ধান পাওয়া যেত’। আসলে ঈশা খাঁ নন, হবে শায়েস্তা খাঁ। ধান নয়, টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত। একই দিন পত্রিকাটির প্রথম পৃষ্ঠায় একটি ডাবল কলাম রিপোর্টের শিরোনাম ‘নিষিদ্ধ ছাত্রসংগঠনগুলোর সুযোগ নেয়ার অপেক্ষা’। পাঠক প্রশ্ন করতে পারে, সরকার তো কোনো ছাত্রসংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেনি। তাহলে কে করলো? সরকার ছাড়া কারো কি এই এখতিয়ার আছে? রিপোর্টটি প্রকাশের জন্য ছাড়ার আগে এসব সম্ভাব্য প্রশ্নের জবাব আছে কি না, দেখে নেয়াই কাম্য ছিল। যাহোক, আগামী দিনগুলোতে মানবকণ্ঠ এসব ব্যাপারে আরো সতর্ক হবে, এ কামনা রেখেই তাদের নবযাত্রায় অভিনন্দন রইল।
ইত্তেফাক ১৭ সেপ্টেম্বর একটি জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট রিপোর্ট ছাপা হয়। আবুল খায়েরের করা রিপোর্টটির শিরোনাম ‘ফল-সবজি কেমিক্যালমুক্ত হবে সহজেই’ এবং উপশিরোনাম ‘নতুন রাসায়নিক উদ্ভাবন করলেন বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা’। দেশের কোটি কোটি মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত অসাধারণ উদ্ভাবনার এই রিপোর্টটি যেকোনো বিচারেই শীর্ষ সংবাদ হওয়ার দবি রাখে। ইত্তেফাক কেন এটিকে শেষ পৃষ্ঠায় দুই কলাম শিরোনামে ছাপল, বোঝা দুষ্কর। পাঠক প্রশ্ন করতে পারেন, সুখবর কি তাহলে ‘খবর’ না?
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেয়া পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয় ১৬ সেপ্টেম্বর। পর দিন ১৭ সেপ্টেম্বর সব দৈনিকই একে শীর্ষ সংবাদ করে। তবে শিরোনামে ব্যতিক্রম ছিল নিউ এজ ও ইত্তেফাক। নিউ এজ শিরোনাম করে: ‘কেয়ারটেকার গবর্নমেন্ট মে বি এন প্লেস ইন নিউ ফর্ম ফর নেক্সট টু পৌল্স্’ এবং ইত্তেফাক লিখে ‘ছোট মন্ত্রিসভা, ৪২ দিন আগে সংসদ বাতিল’।
রায়টি এবং এর বিভিন্ন দিক সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত নিয়ে মুখর হয়ে ওঠে আজ ১৮ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবারের পত্রপত্রিকা। বিশিষ্ট আইনজীবীদের অভিমত ছাপায় নয়া দিগন্ত; ‘গায়ের জোরে রায়, এর কার্যকারিতা নেই’ শিরোনামে। ইত্তেফাক লেখে ‘পূর্ণাঙ্গ রায়ে পাল্টে গেছে সংক্ষিপ্ত রায়’। আমার দেশ-এর শিরোনাম ‘ওপেন কোর্টে ঘোষিত রায়ের সঙ্গে মিল না থাকা মিসকন্ডাক্ট’। নিউ এজ-এর আগের দিনের শিরোনামের সঙ্গে খানিকটা মিলে যায় এদিন প্রথম আলোর শিরোনাম ‘দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়কের অধীনে হতে বাধা নেই’। রায়ে অপ্রাসঙ্গিকভাবে ১/১১ সরকারকে বৈধতা দেয়ার বিষয়টি তুলে ধরে আমার দেশ-এ এদিন রিপোর্ট করেছেন অলিউল্লাহ নোমান। এছাড়া রায় প্রসঙ্গে বিএনপির প্রতিক্রিয়া ‘প্রধানমন্ত্রীর কথার সাথে রায়ের যোগসূত্র রয়েছে’ ছাপিয়েছে নয়া দিগন্ত।
আগের দিনের মতো আজ মঙ্গলবারও একটি সুখবর ছাপিয়েছে ইত্তেফাক। পিনাকি দাস গুপ্তের রিপোর্টটির শিরোনাম ‘২২ বছর পর ভাগ্য ফিরলো থানা হাজতিদের!’ এতে বলা হয়েছে, থানা হাজতিদের দৈনিক খাবার বরাদ্দ ১০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৫ টাকা করা হয়েছে। প্রশংসনীয় পদক্ষেপ এবং ভালো রিপোর্ট, সন্দেহ নেই। তবে শিরোনামে আশ্চর্যবোধক চিহ্নটি দেখে কেউ অবাক হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে কী?
তবে ছাত্রলীগকে ‘ওষুধ’ না দিলেও সরকার নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে এমনটি ভাবার যে আদৌ অবকাশ নেই, তা জানা যায় ১২ সেপ্টেম্বর নয়া দিগন্তে তৌহিদুল ইসলামের রিপোর্ট ‘নির্বাচন সামনে রেখে ঢেলে সাজানো হচ্ছে পুলিশ’। উপশিরোনাম: ‘দলীয় পরিচয়ে ৩২ হাজার নিয়োগ’। একই দিন নয়া দিগন্তের শীর্ষ সংবাদ ছিল ‘শেয়ারবাজারে খেলোয়াড়দের আনাগোনা’। এছাড়া আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খবর ‘এলসি জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংকিং খাত থেকে শত কোটি টাকা লোপাট’। এছাড়া এদিন আমার দেশ-এর দ্বিতীয় শীর্ষ সংবাদ ছিল ‘স্বাস্থ্যখাতে হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি’। সব মিলিয়ে বলা চলে, অপশক্তি বসে নেই। তারা সতত আগুয়ান।
১৩ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিসভায় রদবদল সংক্রান্ত খবরটি সব পত্রিকায় গুরুত্ব পায়। প্রথম আলো এটিকে শীর্ষ সংবাদ করে। তবে এদিন তার চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ খবর ছিল লিবিয়ার বেনগাজিতে আমেরিকান দূতাবাসে জনতার হামলায় রাষ্ট্রদূতসহ চার জন নিহত এবং পাকিস্তানে অগ্নিকাণ্ডে তিন শতাধিক মানুষের প্রাণহানি। দুয়ের মধ্যে হামলার খবরটিকে পত্রিকাগুলো কিছুটা গুরুত্ব দিলেও পাকিস্তানের খবরটি অর্থাৎ তিন শ’র বেশি মানুষের পুড়ে মারা যাওয়ার খবরটিকে অনেক পত্রিকা গুরুত্ব দেয়নি। ব্যতিক্রম ছিল ইত্তেফাক ও নিউ এজ। তারা উভয় খবরকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে ছেপেছে।
একই দিন ইত্তেফাক প্রথম পৃষ্ঠায় ডাবল কলাম বক্স করে ছাপায় আরেকটি চাঞ্চল্যকর খবর ‘হাসিনা-খালেদাকে হত্যার ষড়যন্ত্র?’ বিদেশী নিউজ পোর্টাল সালেম-নিউজ ডটকমের বরাত দিয়ে প্রকাশিত খবরটিতে বলা হয়, ‘একটি বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় খালেদা জিয়াকে হত্যার ষড়যন্ত্র হচ্ছে’। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছে জঙ্গিরা।
বাংলা সাহিত্যের বরেণ্য লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর জন্মদিন ছিল ১৩ সেপ্টেম্বর। কিন্তু সংবাদপত্রগুলো দেখে তা’ বোঝার উপায় ছিল না। ব্যতিক্রম ছিল ঐতিহ্যবাহী দৈনিক সংবাদ। তারা সম্পাদকীয় পৃষ্ঠায় তাঁকে স্মরণ করে প্রশংসনীয় কাজটি করে।
একই দিন সংবাদের শীর্ষ সংবাদ ছিল ‘অস্থিতিশীল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়’। এর উপশিরোনাম ‘ছাত্রলীগের সন্ত্রাস, অভ্যন্তরীণ কোন্দল: সুযোগ নিচ্ছে ছাত্রদল-শিবির’। রাকিব উদ্দিন ও আলী আজমের করা রিপোর্টটির উপশিরোনামের যৌক্তিকতা সারা রিপোর্টের কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। এতে বলা হয়েছে, ‘ঢাকা এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ ক্যাডারদের কাছে মার খেয়েছে ছাত্রদলের কিছু অছাত্র নেতা। এ সুযোগে সক্রিয় হচ্ছে মৌলবাদী ছাত্রসংগঠনগুলো। তারা যেকোনো মূল্যে ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তারে মরিয়া’। এ-ই হচ্ছে খবরটির উপশিরোনামের (সুযোগ নিচ্ছে ছাত্রদল-শিবির) যৌক্তিকতার ‘প্রমাণ’। এছাড়া আর কোথাও ‘সুযোগ নেয়ার’ বিষয়ে একটি লাইনও নেই খবরটিতে। পাঠক প্রশ্ন করতে পারেন, ছাত্রদলের নেতারা যদি ‘অছাত্র’ হয়েও থাকেন, তাদেরকে মারপিট করার অধিকার ছাত্রলীগকে কে দিয়েছে? মৌলবাদী ছাত্রসংগঠনগুলো বলতে কী বোঝানো হয়েছে, ছাত্রদল কি মৌলবাদী সংগঠন? আর কোনো ছাত্রসংগঠন যদি সন্ত্রাস ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলে লিপ্ত হয়, তবে প্রতিপক্ষ তার সুযোগ নেবে না? যেকোনো বৈধ ছাত্রসংগঠন বৈধ পন্থায় ক্যাম্পাসে প্রাধান্য বিস্তার করতে চাওয়া কী অপরাধ? -এসব প্রশ্নের কোনো জবাব নেই রিপোর্টটিতে। সংবাদ-এর মতো একটি ঐতিহ্যবাহী পত্রিকা, যার বয়স এখন ৬২, তার শীর্ষ সংবাদ হতে পারলো এটি! বিস্ময়করই বটে।
তবে বাংলাদেশে কি কিছুতেই বিস্মিত হতে আছে? না, নেই। একেবারেই নেই। তার প্রমাণ ১৩ সেপ্টেম্বর আমার দেশ-এর শীর্ষ সংবাদ। আবদুল্লাহিল গালিবের করা রিপোর্টটি থেকে জানা যায়, কুখ্যাত হলমার্ক কেলেঙ্কারির অন্যতম হোতা হচ্ছে সোনালী ব্যাংকের ডিএমডি মইনুল হক। সদ্য ওএসডি হওয়া এই হক সায়েব আবার বিতর্কিত সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের ভাই। রিপোর্ট পড়ে জানা যায়, ডিএমডি মহোদয়ের বিরুদ্ধে রূপালী ও কৃষি ব্যাংক থেকে অর্থ আত্মসাৎ ও জালিয়াতির একাধিক মামলা হয়েছে। ১/১১ সময়ে গঠিত ট্রুথ কমিশনে তিনি নিজের দুর্নীতির কথা স্বীকারও করেছিলেন। তারপরও পরবর্তী মহাজোট সরকার তাকে সোনালী ব্যাংকের ডিএমডি বানায়।
পর দিন ১৪ সেপ্টেম্বর জানা যায় আরো ‘মজার’ এক খবর। আমার দেশ এদিন দ্বিতীয় শীর্ষ সংবাদ করে এম. আবদুল্লাহর রিপোর্ট ‘আবুল হোসেনেরই জয় হলো: পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারিতে জড়িত সাকোর এমডি হলেন মন্ত্রী’। এই এমডি মহোদয়ের নাম মোস্তফা ফারুক মোহাম্মদ। পরদিন আমার দেশ নবনিযুক্তি দুই মন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও আবদুল হাইকে নিয়ে দ্বিতীয় শীর্ষ সংবাদ করে। অলিউল্লাহ নোমান ও আহসান কবীরের রিপোর্টে বলা হয়, মখা আলমগীর সুপ্রিম কোর্টের রায়ে এমপি হিসেবে অযোগ্য আর আবদুল হাইয়ের বিরুদ্ধে রয়েছে পাসপোর্ট কেলেঙ্কারিসহ নানা অভিযোগ।
এত অভিযোগ সত্ত্বেও তাদের ঠেকানো যায়নি ‘সব সম্ভবের’ এই দেশে। তবে মাঝে-মধ্যে সব সম্ভবও সম্ভব হয় না। যেমন, সম্ভব হয়নি আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা তোফায়েল আহমদ ও মহাজোটের বামপন্থী নেতা রাশেদ খান মেননকে মন্ত্রিসভায় টানা। মন্ত্রিসভায় যোগদানে তাদের অস্বীকৃতির খবরটি পরদিন এবং তারও পরদিন নানাভাবে ছাপায় পত্রিকাগুলো। বিশেষ করে মেননের মন্তব্য ‘কোনো সভ্য দেশে কাউকে এভাবে মন্ত্রী করা হয় না’ ফলাও প্রচার পায়। তবে মন্ত্রিসভার সম্প্রসারণের খবরটির সবচাইতে চমকপ্রদ শিরোনামটি দিয়েছে আমার দেশ ‘শেষ বেলায় ৭ মন্ত্রী’। অবশ্য তাদের উপশিরোনাম ‘মন্ত্রিত্ব প্রত্যাখ্যান করে ইতিহাস সৃষ্টি তোফায়েল-মেননের’ পড়ে পাঠক প্রশ্ন করতেই পারেন, মন্ত্রিত্ব গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যানে কী এমন ‘ইতিহাস’ সৃষ্টি হয়!
বরং ওই দিন ‘ইতিহাস’ সৃষ্টি করেছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক। আমার দেশ সিঙ্গল কলামে খবরটি পরিবেশন করে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু: দ্বিতীয় বারের মতেহা রায় লিখে জমা দিলেন বিচারপতি খায়রুল হক’ শিরোনামে। এতে বলা হয়, ‘রায় ঘোষণার ১৩ মাস পর সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক গত জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে জানিয়েছিলেন, তিনি রায় লিখে জমা দিয়েছেন। জমা দেয়ার পর কেন রায়টি প্রকাশ হচ্ছে না- এ নিয়ে তিনি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন। তখন বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে সংবাদও প্রকাশিত হয়েছিল বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক রায় লিখে জমা দিয়েছেন বলে। এখন আবার তিনি রায়ে গতকাল স্বাক্ষর করে সুপ্রিম কোর্টে জমা দিয়েছেন বলে জানা গেছে। বেলা আড়াইটার দিকে তার স্বাক্ষরিত রায়টি সুপ্রিম কোর্টে পাঠান বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। গতকাল রায় জমা দেয়ার বিষয়টি সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রার সাংবাদিকদের কাছে স্বীকার করেছেন।’
একই দিন অর্থাৎ ১৪ সেপ্টেম্বর কালের কণ্ঠে মন্ত্রিসভার সম্প্রসারণ নিয়ে আশরাফুল হক রাজীব রিপোর্ট করেন ‘আরো নাটকীয়তার অপেক্ষা! পরে ১৬ সেপ্টেম্বর সেই নাটকীয়তার খবর ছাপায় সবগুলো পত্রিকা। স্বারাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হারান সাহারা খাতুন, তথ্য হাতছাড়া হয় আবুল কালাম আজাদের, ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব চলে যায় ড. আবদুর রাজ্জাকের কাছ থেকে, রেল নিয়ে তৎপর ওবায়দুল কাদেরের হাতে থাকে না রেলপথ মন্ত্রণালয়। কালের কণ্ঠ এদিন শীর্ষ সংবাদের শিরোনাম দেয় ‘পাঁচ মন্ত্রীর ক্ষমতা খর্ব’। এছাড়াও নাটকীয়তা বা চমকের খবর আগেভাগে দিতে পেরে এগিয়ে গেছে কালের কণ্ঠ।
একই দিন ‘লিবিয়ার পথে মার্কিন রণতরী’ খবরটিকে যথাযথ গুরুত্বসহকারে পরিবেশন করে এগিয়ে যায় নয়া দিগন্ত ও ইত্তেফাকও। ব্যাপারটি শুধু লিবিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের নয়, বরং গ্লোবাল ভিলেজ যুগে আমরা কেউ এই বাস্তবতার বাইরে নই। কাজেই এ খবরটি বাংলাদেশের জন্যও সমান গুরুত্বপূর্ণ- এ সত্যটি পত্রিকাগুলো বোঝেনি বা বুঝতে চায়নি।
১৫ সেপ্টেম্বরে একই বিষয় নিয়ে শীর্ষ সংবাদ করে দু’টি পত্রিকা- প্রথম আলো ও নয়া দিগন্ত। প্রথম আলোর শিরোনাম ছিল ‘সরকার ও জোটে অস্বস্তি’ এবং নয়া দিগন্ত শিরোনাম করে ‘সরকারে অস্থিরতা’।
একই দিন কালের কণ্ঠ লিখে ‘মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণের উদ্দেশ্য ভেস্তে গেছে!’ রিপোর্টটি করেছেন পাভেল হায়দার চৌধুরী। ওই দিন প্রথম আলোতে আনোয়ার হোসেনের রিপোর্ট ছিল ‘একের পর এক কেলেঙ্কারিতে সরকার’।
১৬ সেপ্টেম্বর একটি উদ্বেগজনক এবং আরেকটি হাস্যোদ্দীপক খবর ছাপায় আমার দেশ। উদ্বেগজনক হলো ড. কামালের একটি বক্তব্য। তিনি বলেছেন, ‘আমি গুম হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে আছি’। হাস্যকর খবরটি হলো, চার হাজার কোটি টাকা ঋণ কেলেঙ্কারির হোতা হলমার্ক পাঁচ লাখ টাকা ফেরৎ দিয়েছে সোনালী ব্যাংককে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ঘোষণা (১৫ দিনের মধ্যে দুই হাজার কোটি টাকা ফেরৎ দেবে হলমার্ক গ্রুপ) অনুযায়ী সোনালী ব্যাংক ওই পরিমাণ অর্থ ফেরৎ দেয়ার জন্য হলমার্ককে সময় বেঁধে দেয়। নির্ধারিত সময় শেষ হবার দু’দিন আগে তাই পাঁচ লাখ টাকা ফেরৎ দিয়ে অর্থমন্ত্রী ও সোনালী ব্যাংকের ইজ্জত বাঁচালো হলমার্ক। সংবাদটি প্রকাশ করে ধন্যবাদাই হয়েছে আমার দেশ।
‘নতুন’ পত্রিকা মানবকণ্ঠ বাজারে আসে ১৬ সেপ্টেম্বর। এদিনের সংখ্যাটি ছিল পত্রিকার ১২ বর্ষ ১৯৩ সংখ্যা। সম্পাদক শাহজাহান সরদার। প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয় বিশেষ সম্পাদকীয় ‘সুস্থ ধারার সাংবাদিকতা আমাদের অঙ্গীকার’। তবে প্রথম দিনেই ‘হোঁচট’ খায় মানবকণ্ঠ। পঞ্চম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত তিনটি লেখার দু’টিরই শেষ কোথায় খুঁজে পাওয়া যায়নি। দ্বিতীয় দিন ‘খেলা’ বিভাগের শীর্ষ সংবাদের প্রথম লাইনেই লেখা হয় ‘ঈশা খাঁর আমলে বাংলায় আট মণ ধান পাওয়া যেত’। আসলে ঈশা খাঁ নন, হবে শায়েস্তা খাঁ। ধান নয়, টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত। একই দিন পত্রিকাটির প্রথম পৃষ্ঠায় একটি ডাবল কলাম রিপোর্টের শিরোনাম ‘নিষিদ্ধ ছাত্রসংগঠনগুলোর সুযোগ নেয়ার অপেক্ষা’। পাঠক প্রশ্ন করতে পারে, সরকার তো কোনো ছাত্রসংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেনি। তাহলে কে করলো? সরকার ছাড়া কারো কি এই এখতিয়ার আছে? রিপোর্টটি প্রকাশের জন্য ছাড়ার আগে এসব সম্ভাব্য প্রশ্নের জবাব আছে কি না, দেখে নেয়াই কাম্য ছিল। যাহোক, আগামী দিনগুলোতে মানবকণ্ঠ এসব ব্যাপারে আরো সতর্ক হবে, এ কামনা রেখেই তাদের নবযাত্রায় অভিনন্দন রইল।
ইত্তেফাক ১৭ সেপ্টেম্বর একটি জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট রিপোর্ট ছাপা হয়। আবুল খায়েরের করা রিপোর্টটির শিরোনাম ‘ফল-সবজি কেমিক্যালমুক্ত হবে সহজেই’ এবং উপশিরোনাম ‘নতুন রাসায়নিক উদ্ভাবন করলেন বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা’। দেশের কোটি কোটি মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত অসাধারণ উদ্ভাবনার এই রিপোর্টটি যেকোনো বিচারেই শীর্ষ সংবাদ হওয়ার দবি রাখে। ইত্তেফাক কেন এটিকে শেষ পৃষ্ঠায় দুই কলাম শিরোনামে ছাপল, বোঝা দুষ্কর। পাঠক প্রশ্ন করতে পারেন, সুখবর কি তাহলে ‘খবর’ না?
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেয়া পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয় ১৬ সেপ্টেম্বর। পর দিন ১৭ সেপ্টেম্বর সব দৈনিকই একে শীর্ষ সংবাদ করে। তবে শিরোনামে ব্যতিক্রম ছিল নিউ এজ ও ইত্তেফাক। নিউ এজ শিরোনাম করে: ‘কেয়ারটেকার গবর্নমেন্ট মে বি এন প্লেস ইন নিউ ফর্ম ফর নেক্সট টু পৌল্স্’ এবং ইত্তেফাক লিখে ‘ছোট মন্ত্রিসভা, ৪২ দিন আগে সংসদ বাতিল’।
রায়টি এবং এর বিভিন্ন দিক সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত নিয়ে মুখর হয়ে ওঠে আজ ১৮ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবারের পত্রপত্রিকা। বিশিষ্ট আইনজীবীদের অভিমত ছাপায় নয়া দিগন্ত; ‘গায়ের জোরে রায়, এর কার্যকারিতা নেই’ শিরোনামে। ইত্তেফাক লেখে ‘পূর্ণাঙ্গ রায়ে পাল্টে গেছে সংক্ষিপ্ত রায়’। আমার দেশ-এর শিরোনাম ‘ওপেন কোর্টে ঘোষিত রায়ের সঙ্গে মিল না থাকা মিসকন্ডাক্ট’। নিউ এজ-এর আগের দিনের শিরোনামের সঙ্গে খানিকটা মিলে যায় এদিন প্রথম আলোর শিরোনাম ‘দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়কের অধীনে হতে বাধা নেই’। রায়ে অপ্রাসঙ্গিকভাবে ১/১১ সরকারকে বৈধতা দেয়ার বিষয়টি তুলে ধরে আমার দেশ-এ এদিন রিপোর্ট করেছেন অলিউল্লাহ নোমান। এছাড়া রায় প্রসঙ্গে বিএনপির প্রতিক্রিয়া ‘প্রধানমন্ত্রীর কথার সাথে রায়ের যোগসূত্র রয়েছে’ ছাপিয়েছে নয়া দিগন্ত।
আগের দিনের মতো আজ মঙ্গলবারও একটি সুখবর ছাপিয়েছে ইত্তেফাক। পিনাকি দাস গুপ্তের রিপোর্টটির শিরোনাম ‘২২ বছর পর ভাগ্য ফিরলো থানা হাজতিদের!’ এতে বলা হয়েছে, থানা হাজতিদের দৈনিক খাবার বরাদ্দ ১০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৫ টাকা করা হয়েছে। প্রশংসনীয় পদক্ষেপ এবং ভালো রিপোর্ট, সন্দেহ নেই। তবে শিরোনামে আশ্চর্যবোধক চিহ্নটি দেখে কেউ অবাক হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে কী?
No comments