মাহির জন্মদিনে by পাভেল মহিতুল আলম

কল রিসিভ করতেই লিসান ধরা গলায় বলল, ‘ভাইয়া, মাহি কাঁদছে!’ ‘মাহি কাঁদছে কই, কাঁদছিস তো তুই!’ ‘ভাইয়া, মাহিও কাঁদছে। আমি ওর কান্না সইতে পারি না বলে আমিও কাঁদছি!’ আহা! এমন প্রেম দেখে আমার মুগ্ধ হওয়া উচিত। কিন্তু আমি হতাশ হলাম। বললাম, ‘মাহি কাঁদছে কেন?’


‘ওদের কাজের মেয়েটা কাল চলে যাচ্ছে। মাহি ওকে অনেক পছন্দ করত...।’ এটুকু বলেই লিসান আরও কাঁদতে শুরু করে, ‘মাহিকে এখন আমি কী বলে সান্ত্বনা দেব?’
‘সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা আমারও জানা নেই রে। বছরের শুরুতে আমাদের কাজের লোক চলে গিয়েছিল, বছর শেষ, এখনো নতুন একটা পেলাম না।’
‘হুম। যা হোক, ২৮ তারিখ মাহির জন্মদিন, মনে আছে তো? ওই দিন ওর সঙ্গে তোমার পরিচয় করিয়ে দেব...।’
লিসানের জন্মদিন কবে সেটাই ভুলে গেছি, ওর গার্লফ্রেন্ডেরটা মনে থাকবে কীভাবে? আমি অবশ্য বললাম, ‘মনে থাকবে না কেন? আমি সময়মতো চলে আসব।’
লিসান খুশিতে বাকবাকুম হয়ে গেল।

জন্মদিনের কথা অবশ্য আমি ভুলে গেলাম না। কিন্তু বিপত্তি বাধাল বজলু ভাই। সকালবেলা তার ফোন, ‘পাভেল, মাস তো শেষের দিকে। আমাদের শীতবস্ত্র কালেকশন তো আরও জোরদার করা উচিত। বিকেলে চলে আসো, রবিনদের এলাকায় অভিযান চালাই। প্রতিটি বাসা থেকে শীতবস্ত্র আদায় করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ!’
‘কিন্তু ভাই, আজ বিকেলে আমি একজনের জন্মদিনে যাব।’
‘তুমি মানুষ, না পাথর? শীতের তীব্রতায় কষ্ট পাচ্ছে হাজারো অসহায় মানুষ। আর এই সময় তুমি যাবে জন্মদিন করতে?’
বজলু ভাইয়ের কথা শুনে আমিও আবেগপ্রবণ হয়ে গেলাম। বললাম, ‘সরি ভাই! বিকেল কেন, আমি দুপুরের মধ্যেই চলে আসব।’

সিঁড়ি দিয়ে দুইতলায় আসতেই রাশিনের সঙ্গে দেখা। হাসিমুখে জানতে চাইল, ‘অফিস যাননি?’
‘না। ছুটি কাটাচ্ছি।’
‘যাক, ভালোই হলো। বিকেলে আমাকে একটু ধানমন্ডি পৌঁছে দেবেন। একটা দাওয়াত আছে।’
‘অসম্ভব। অসহায় শীতার্তদের জন্য শীতবস্ত্র সংগ্রহ করছি। বিকেলে অনেক কাজ।’
রাশিন মিষ্টি করে হেসে বলল, ‘আমাকে দিয়ে কাজিনটার সঙ্গে দেখা করে খেয়ে আসবেন। কতক্ষণ আর লাগবে?’
অমন হাসি দেখার পরও শীতার্ত মানুষের কথা ভেবে আমি সরাসরি ‘না’ বলে দিলাম। বজলু ভাইয়ের মতো করে বললাম, ‘শীতের তীব্রতায় কষ্ট পাচ্ছে হাজারো মানুষ আর এই সময় আপনি যাবেন কাজিনের দাওয়াতে? আমি হলে তো গার্লফ্রেন্ডের দাওয়াতেও যেতাম না।’
রাশিন মুখ বাঁকিয়ে বলল, ‘জীবনে কোনো মেয়ের কাছ থেকেই তো বোধহয় দাওয়াত পাননি। আর গার্লফ্রেন্ড?’
আমি তীব্র প্রতিবাদ করে বললাম, ‘হাহ্! আজই একটা মেয়ের জন্মদিনের দাওয়াত আছে। শুধু অসহায় মানুষের মুখের দিকে চেয়ে যাচ্ছি না।’

রবিনদের এলাকার দিকে রওনা দেব, ঠিক তখনি বজলু ভাইয়ের ফোন, ‘পাভেল, আজ এসো না! গত রাতে রাস্তার পিঠা খাওয়ার ফল শুরু হয়েছে! পেটের অবস্থা শোচনীয়। আজ আর বেরুতে পারব না।’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘অসহায় মানুষের চেয়ে আপনার কাছে পেটের সমস্যা বড় মনে হলো?’
‘এই মুহূর্তে আমার চেয়ে অসহায় আর কে আছে!’ কথাটা বলেই বজলু ভাই অদ্ভুত একটা শব্দ করলেন, ‘আউউ! এখন রাখি, আবার যেতে হবে।’
ফোনটা রাখতেই বুকটা কেমন খা খা করতে লাগল। শুধু শুধু রাশিনকে ‘না’ করলাম। তা-ও ভালো, লিসানকে এখনো ‘না’ বলিনি। যাই, বিকেলে ওর আর মাহির সঙ্গেই দেখা করে আসি।

ধানমন্ডির এই রেস্টুরেন্টটাতে আমি আগে আসিনি। ভেতরে এসে লিসানকে কল দিতে যাব, অমনি একটা মেয়ে এসে বলল, ‘ভাইয়া, আমি মাহি! আপনাকে দেখেই চিনে ফেলেছি। লিসানের সঙ্গে কিছু ছবিতে দেখেছিলাম তো।’
‘লিসান কোথায়?’
‘জ্যামে আটকা পড়ে আছে। আপুনির আসার কথা, সেও দেরি করছে। আসুন, আমরা বসি।’
মাহি মেয়েটা বেশ। দেশ নিয়ে তার ব্যাপক চিন্তাভাবনা। শীত, শেয়ারবাজার, ভূমিকম্প, বিশ্বকাপ ক্রিকেট, যুদ্ধাপরাধীর বিচার থেকে শুরু করে লিবিয়া-সোমালিয়া— বছরের আলোচিত সব বিষয় নিয়ে আমাদের কথা ফুরিয়ে এলেও লিসান এখনো এসে পৌঁছাতে পারল না। আমি যেই না লিসানের সমালোচনা শুরু করতে যাব, ঠিক তখনি শুনতে পেলাম একটি হুংকার, ‘আপনি এখানে?’
ডানে তাকাতেই চমকে উঠলাম। রাশিন দাঁড়িয়ে! মাহি আহ্লাদি গলায় বলে উঠল, ‘আপুনি।’ কিন্তু রাশিনের সেদিকে ভ্রুক্ষেপও নেই। আমার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে একনাগাড়ে বলতে শুরু করল, ‘এই আপনার সমাজসেবা? শীতবস্ত্র সংগ্রহ? মিথ্যুক কোথাকার! এখানে এসে আমার বাচ্চা বোনটার মাথা খাচ্ছেন? ছি ছি ছি, কোনো মেয়ের কাছে পাত্তা না পেয়ে এইটুকুন ছোট মেয়ের সঙ্গে ডেট? ওর কথাই তাহলে আজ আমাকে বলে এসেছিলেন।’
মাহি রাশিনের কথা কিছুই বুঝল না। আমি আমতা আমতা করে কিছু বলতে চাচ্ছিলাম, কিন্তু রাশিন মাহির দিকে ফিরে বলল, ‘এই তোর বয়ফ্রেন্ড? তোর বয়ফ্রেন্ড হবে তোর বয়সী কোনো ছেলে, এই বুড়ো কেন? মিষ্টি মিষ্টি কথা বলল আর পটে গেলি? দাঁড়া, আমি আসছি কাল তোর বাসায়।’ বলা শেষ হতেই রাশিন হাঁটা ধরল।
পুরোপুরি বাংলা সিনেমা টাইপ অবস্থা! আমি হতাশায় মাথা নাড়লাম। আর তখনি হুংকার করে উঠল মাহি, ‘আপুনি আপনাকে দেখে এত রেগে গেল কেন? আমার সম্পর্কেই বা কী বলে এসেছিলেন তাকে?’
‘আর বোলো না, এমন ভয়ংকর মেয়ে!’ বলেই বুঝলাম ভুল করে ফেলেছি। মাহি আরও রেগে গেল, ‘আমার আপুনি ভয়ংকর মেয়ে? আমার আপুনি? আজ লিসানের একদিন কি আপনার একদিন!’ রাশিনের মতো মাহিও হাঁটা ধরল।

মিনিট খানেক না যেতেই লিসান এসে পৌঁছল। বেচারার কপালে আমি স্পষ্ট শনির রেখা দেখতে পেলাম!

No comments

Powered by Blogger.