হিংস্রতার শিকার নারী-সমাজকে শ্বাপদমুক্ত করতেই হবে

খবরের কাগজের পাতা উল্টালেই বীভৎস সমাচার। নারীর ওপর হিংস্র আক্রমণ। যৌন পীড়ন। তার শারীরিক-মানসিক লাঞ্ছনা। সর্বশেষ বীভৎস ঘটনা ঘটেছে ১২ জুলাই রাজশাহীর শিক্ষা বোর্ড মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং বান্দরবান জেলার লামা উপজেলার নাইক্ষ্যংঝিরিতে। রাজশাহীর শিক্ষা বোর্ড মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে ঢুকে দুর্বৃত্তরা এক ছাত্রীর চোখে নিক্ষেপ করেছে দাহ্য পদার্থ! বান্দরবানের লামা উপজেলার নাইক্ষ্যংঝিরিতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর এক কিশোরীকে ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে তার নানা, মা ও ভাইকে কুপিয়ে হত্যা করেছে এক যুবক।

এই ঘটনাটিও ঘটেছে একটি ঘরের ভেতরে। অন্যদিকে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। ৩১ জুলাইয়ের কালের কণ্ঠে ওই ঘটনাগুলোর চিত্র ফুটে উঠেছে। শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রীরা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এ রকম সংবাদ এখন প্রায়ই পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। এ আরেক ভয়াবহ নতুন উপসর্গ। সামাজিক অবক্ষয়ের মাত্রা কোন বিপৎসীমা স্পর্শ করেছে ঘটনাগুলো এরই একেকটি চরম উদ্বেগজনক দৃষ্টান্ত।
নারী ঘরে-বাইরে-কর্মক্ষেত্রে-শিক্ষাক্ষেত্রে অর্থাৎ প্রায় সর্বত্র চরম নিরাপত্তাহীনতার শিকার। যুবতী, কিশোরী, বালিকা, কন্যাশিশু, পূর্ণবয়স্ক কেউই রেহাই পাচ্ছে না পাশবিকতা থেকে। নারীর ওপর হিংস্র আক্রমণের ইতিহাস অতিশয় প্রাচীন হলেও বর্তমান সভ্য, আধুনিক, অগ্রগামী সমাজে এমনটি মেনে নেওয়া দুরূহ। বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের ক্ষেত্র সুনির্দিষ্ট একটি বা দুটি নয়, প্রায় সর্বত্র। নারী এবং নির্যাতন শব্দ দুটি যেন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। একজন নারীর সামাজিক নিরাপত্তা এখানে পদে পদে বিঘি্নত। নারী বিষয়ে কিছু লিখতে গেলে যেন সাধ্য নেই নির্যাতনের কথা বাদ দিয়ে লেখার। নারী নির্যাতন একটি বহুমাত্রিক প্রকট সামাজিক সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। নারী নির্যাতন রোধে কঠোর আইন কার্যকর থাকা সত্ত্বেও কোনোভাবেই এই বিবর্ণ অধ্যায়ের অবসান ঘটানো যাচ্ছে না।
পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচারিত হয়নি কিংবা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার রেকর্ডভুক্ত হয়নি বা সচেতন মহলের অগোচরে রয়ে গেছে_এমন বহু ঘটনা যে প্রায় নিত্যই ঘটে চলেছে তা সন্দেহাতীতভাবেই বলা যায়। বান্দরবান, রাজশাহী, লামায় এক দিনে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, এ দিয়েই সার্বিক চিত্র নিরূপণ সম্ভব। অনেকেই আইনের আশ্রয় নিতে চান না নানারকম যুক্তিযুক্ত কারণেই। আইনি সংস্থার বিশেষ করে পুলিশের বিরুদ্ধে রয়েছে এ ব্যাপারে বিস্তর অভিযোগ। পুলিশ মামলা নিতে গড়িমসি করে, বলবান প্রতিপক্ষ হলে অভিযোগকারীদের হেনস্তা করে, মামলা সাজাতে স্বেচ্ছাচারিতা চালায়, এ সবই পুরনো অভিযোগ। এমন চিত্র জিইয়ে রেখে নারী নির্যাতন রোধের সব আশা দুরাশা মাত্র। অমানবিক নির্যাতন, যে নির্যাতনের প্রক্রিয়ায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হত্যা অবশেষে পরিণাম হিসেবে উঠে আসে। ভয়াবহতা বন্ধ হওয়া দূরে থাক, গতি একটুও হ্রাস পাচ্ছে না। এমতাবস্থায় প্রশ্ন ওঠে তাহলে দৃশ্যত এতসব কঠোরতা, সরকার ও প্রশাসনের অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতির মূল্য বা সুফলটা কী? সরকার, প্রশাসন ও সামাজিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধভাবে এই অন্ধকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। রাজশাহী, লামা, সাতকানিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত প্রতিটি ঘটনার কঠোর প্রতিকারে যথাযথ আশু পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকার ও প্রশাসনের এ ক্ষেত্রে ব্যর্থতার কোনো অবকাশ নেই, অজুহাত দাঁড় করানোরও সুযোগ নেই। সমাজকে শ্বাপদমুক্ত করতেই হবে।

No comments

Powered by Blogger.