এম আবদুল আউয়াল, সাজাদ হোসেন, ড. আশরাফুল আমীন, আবদুল্লাহ আল মাহমুদ-একটি নিরাপদ ও গ্রহণযোগ্য ই-ভোটিং পদ্ধতি

নির্বাচন একটি দেশের জনগণকে তাদের প্রতিনিধি মনোনীত করার এবং তারা কিভাবে পরিচালিত হবে, তা প্রকাশ করার অধিকার প্রদান করে। একটি ভালো নির্বাচনব্যবস্থা গণতন্ত্রচর্চার অন্যতম পূর্বশর্ত। নির্বাচনব্যবস্থা অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ হওয়া অপরিহার্য, যাতে ভোটার ও প্রার্থী ফল মেনে নিতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ তথা পৃথিবীর ইতিহাস ঘাঁটলে আমরা খুব স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমই দেখতে পাই। বরং নির্বাচনের ফলকে কেন্দ্র করে এ দেশে নৈরাজ্য, সহিংসতা, এমনকি খুন পর্যন্ত হয়ে থাকে।

আর এখন পর্যন্ত এ দেশে সর্বজনগ্রাহ্য কোনো নির্বাচনপদ্ধতি প্রবর্তিত হয়নি। যার ফলে নির্বাচনে দুর্নীতির আশঙ্কা সব সময়ই ছিল এবং তা রাজনৈতিক দলগুলোকে বিভিন্ন সময় নির্বাচনের ফল না মানতে প্রভাবিত করেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন ইলেকট্রনিক ভোটিং (ই-ভোটিং) চালু করার প্রস্তাব দিয়েছে। আগামী সংসদ নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার করা উচিত কি না, তা এখন দেশজুড়ে একটি আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও এ নিয়ে চরম মতপার্থক্য বিরাজ করছে। সাধারণ লোকজনও এ নিয়ে নানা রকম মন্তব্য করছে, যদিও বেশির ভাগ মানুষের এই প্রযুক্তির বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট ধারণা নেই। এখানে আমরা ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে আরো নিরাপদ ও যুগোপযোগী একটি ইলেকট্রনিক ভোটিং পদ্ধতির ওপর আলোকপাত করছি। এটি ভালো ভোটিং পদ্ধতি, সেটা ইলেকট্রনিক, মেকানিক্যাল কিংবা প্রচলিত ব্যালট পেপার ব্যবহার_যা-ই হোক না কেন, কিছু সুনির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে_প্রত্যেক ভোটারের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা, ভোটারের নিরাপত্তাবিধান, ভোটার কোন প্রার্থীকে ভোট দিচ্ছে তা কোনোভাবেই প্রকাশ না পাওয়া, ভোট প্রদান ও গণনায় কোনো রকম কারচুপির সুযোগ না থাকা এবং সর্বোপরি ভোটের ফল দলমত-নির্বিশেষে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়া। এ ক্ষেত্রে প্রচলিত ব্যালট পদ্ধতির চেয়ে ইলেকট্রনিক ভোটিং বেশ কার্যকর ও ফলপ্রসূ হিসেবে পরিগণিত হতে পারে, যদি অন্যান্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়। ই-ভোটিং বলতে ভোট গ্রহণ ও ভোট গণনার ইলেকট্রনিক পদ্ধতিকে বোঝায়। প্রচলিত ই-ভোটিং পদ্ধতির স্বচ্ছতা ও নিরাপত্তা নিয়ে একটু বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। বর্তমানে প্রচলিত ইভিএমের হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার পরিবর্তন করার মাধ্যমে কারচুপি করা যায়। হার্ডওয়্যার পরিবর্তনের মধ্যে রয়েছে আসল ডিসপ্লে, এর পরিবর্তে সব ডিসপ্লে ব্যবহার এবং তথ্য সংরক্ষণকারী মেমোরি চিপসে ক্লিপ ব্যবহার। সম্প্রতি ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলি এবং ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ায় ইভিএমের নিরাপত্তা বাড়ানো নিয়ে গবেষণা হয়েছে। তার আলোকে আমরা এখানে একটি পূর্ণ নিরাপত্তাবিশিষ্ট আধুনিক ইলেকট্রনিক ভোটিং পদ্ধতি ডিজাইন করেছি।
স্বচ্ছ ও নিরাপদ ভোট গ্রহণের জন্য আমরা একটি আধুনিক ইলেকট্রনিক ভোটিং পদ্ধতির প্রস্তাব করছি, যাতে প্রচলিত ই-ভোটিংয়ের চেয়ে অনেক বেশি নিরাপত্তামূলক বৈশিষ্ট্য সনি্নবেশিত হয়েছে। এ ব্যবস্থায় বাংলাদেশের ৬৪টি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে একটি করে সার্ভার থাকবে, যা সরাসরি ঢাকায় নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে যুক্ত হবে। একটি জেলার সব ভোটকেন্দ্র জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সঙ্গে ইন্টারনেট নেটওয়ার্কের মাধ্যমে যুক্ত হবে। ভোটার তালিকা হালনাগাদ করে ডেটাবেইসে রাখা হবে, যেন উপযুক্ত ও প্রাপ্তবয়স্ক কোনো ভোটার তালিকা থেকে বাদ না পড়ে। যখন একজন ভোটার ভোটকেন্দ্রে যাবে, তখন সে সেই কেন্দ্রে ভোটদানের যোগ্য কি না তা যাচাই করা হবে ভোটার পরিচয়পত্র নম্বর এবং আঙুলের ছাপ যাচাইয়ের মাধ্যমে। কোনো ভোটারের একবার এসব মিলে যাওয়ার পর এই তথ্যগুলোতে আর নির্বাচনের দিন প্রবেশ করা যাবে না। এই পদ্ধতিতে একজন আরেকজনের ভোট দিতে পারবে না বা একজন দুইবার ভোট দিতে পারবে না। যাচাইয়ের পর সব তথ্য মিলে গেলে ভোটার ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে। এই ভোট সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সার্ভার এবং ঢাকায় নির্বাচন কমিশনের সার্ভারে হালনাগাদ হয়ে যাবে।
ভোট গ্রহণ শেষে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সার্ভার সেই জেলার প্রতিটি কেন্দ্র, আসন ও প্রার্থীর সমন্বয়ে ফল প্রকাশ করবে, যা সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়েও পাওয়া যাবে। যদি কোনো এলাকায় ইন্টারনেট সংযোগ না থাকে তাহলে সেখানে ভোটার যাচাইকরণ প্রক্রিয়া বর্তমানে প্রচলিত নিয়মেই হবে। তার নাম ভোটার তালিকার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হবে এবং ভোট গ্রহণের পর হাতে অমোচনীয় কালি লাগিয়ে দেওয়া হবে। নির্বাচনে ভোট গ্রহণ শেষ হলে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সার্ভার সেই জেলার প্রতিটি কেন্দ্র, আসন ও প্রার্থীর সমন্বয়ে ফল প্রকাশ করবে, যা সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়েও পাওয়া যাবে। যদি কোনো এলাকায় ইন্টারনেট সংযোগ না থাকে তাহলে সেখানে ভোটার যাচাইকরণ প্রক্রিয়া বর্তমানে প্রচলিত নিয়মেই হবে। তার নাম ভোটার তালিকার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হবে এবং ভোট গ্রহণের পর হাতে অমোচনীয় কালি লাগিয়ে দেওয়া হবে। নির্বাচনে ভোট গ্রহণ শেষ হলে ইভিএমগুলো সংগ্রহ করা হবে এবং ভোট প্রতিস্থাপন যোগ্য মেমোরির মাধ্যমে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সার্ভারে স্থানান্তর করা হবে। ফল পূর্বোলি্লখিত নিয়মেই প্রকাশিত হবে। এই পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়া দুই ধাপে সম্পন্ন হবে। প্রথমত, ভোটার একজন প্রার্থী পছন্দ করবে, যেটা সে প্রচলিত ইন্ডিএমে করে থাকে। কিন্তু তৎক্ষণাৎ ভোট দেওয়ার পরিবর্তে সে ইন্ডিএমে একটি বোতাম টিপে তার পছন্দসই প্রার্থী ঠিক করবে, তারপর আরেকটি বোতাম টিপে তাকে ভোট প্রদান নিশ্চিত করবে। দ্বিতীয়বার বোতাম টেপার পর একটি ব্যালট স্বয়ংক্রিয়ভাবে ছাপা হবে এবং তা নিরাপদ ও স্বচ্ছ পথে একটি সুরক্ষিত ও স্বচ্ছ বাঙ্ েজমা হবে। একই সঙ্গে ইন্ডিএম একটি রসিদ ছাপাবে, যেখানে ভোটারের জন্য তালিকা নম্বর দেওয়া থাকবে। ভোটার সেই রসিদটি নিজের কাছে সংরক্ষণ করবে। এভাবে ভোট ইলেকট্রনিক ও ব্যালট_দুই মাধ্যমেই সংরক্ষিত হবে। যদি নির্বাচনে দুর্নীতির কোনো অভিযোগ ওঠে তাহলে এই ব্যালটগুলো গণনা করা হবে। যেহেতু ভোট ইলেকট্রনিক ও ব্যালট_দুই মাধ্যমেই সংরক্ষিত হবে, তাই দুর্নীতির কোনো সুযোগ থাকবে না। জেলা প্রশাসকের সার্ভার কক্ষে একটি বড় মনিটর থাকবে, যেখানে প্রতিটি কেন্দ্রের সংগৃহীত ভোটের সংখ্যা প্রদর্শন করা হবে এবং যখনই কোনো কেন্দ্রে কোনো ভোট দেওয়া হবে, তৎক্ষণাৎ তা হালনাগাদ করা হবে। প্রত্যেক প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট সেখানে কোন কেন্দ্রে কত ভোট গৃহীত হচ্ছে তা দেখতে পারবে এবং তারা যেকোনো ধরনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম দুর্নীতির চেষ্টাও ধরতে পারবে খুব সহজে।
পূর্বোলি্লখিত বৈশিষ্টগুলো থেকে আমরা অনুধাবন করতে পারি, এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হলে ১. কোনো ভোটার একবারের বেশি ভোট দিতে পারবে না। ২. ভোটের ব্যালট পেপার কপি সংরক্ষিত থাকবে, তাই কোনো ইলেট্রনিক বিপর্যয় ঘটলে ভোট গ্রহণ বাতিল হবে না। ৩. এমনকি যদি ইন্ডিএম ভোটকেন্দ্র থেকে সরিয়ে ফেলা হয় তা নির্বাচনের ফলে কোনো প্রভাব ফেলবে না, ফলে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সার্ভারও সংরক্ষিত থাকবে। ৪. কেউ সার্ভার থেকে কোনো ভোট কমাতে বা বাড়াতে পারবে না, যেহেতু সেটি জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তাসহ সংরক্ষিত থাকবে। ৫. একই সময়ে একাধিক পর্যবেক্ষণকেন্দ্র থাকায় কোনো ব্যক্তি বা সংগঠন ভোটসংখ্যার গরমিল করতে পারবে না।
তাই এটা বলা নিরাপদ, যদি প্রস্তাবিত ই-ভোটিং পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয় তাহলে একটি স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, যা সব রাজনৈতিক দল, দেশের মানুষ ও বিদেশি পর্যবেক্ষকদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। এটি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও প্রশাসনিক পরিকল্পনার নিরবচ্ছিন্নতা নিশ্চিত করবে, যা বাংলাদেশে উন্নয়নের ধারা বজায় রাখার জন্য অত্যাবশ্যক। এখন প্রশ্ন হলো, ই-ভোটিংয়ে তো আমাদের যেতে হবে, কিন্তু কোন সময় এবং কী পটভূমির পরিপ্রেক্ষিতে? আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কি প্রস্তাবিত পূর্ণ নিরাপত্তামূলক ই-ভোটিং পদ্ধতি প্রবর্তন করা সম্ভব? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে এই প্রযুক্তি নিয়ে কিছু গবেষণা ও অনুসন্ধান করতে হবে প্রকল্পের মাধ্যমে। এই প্রকল্পগুলো হতে পারে ১. পদ্ধতি উন্নয়ন, ২. ছোট পরিসরের নির্বাচনে তা পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার, ৩. সেখানে সফল হলে বড় পরিসরের নির্বাচনে ব্যবহার। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দু-তিন লাখ ইভিএম লাগবে, যা সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে দেশেই তৈরি করা সম্ভব। তা ছাড়া ছোট পরিসরে ইভিএম ব্যবহার করে কোনো ত্রুটি পাওয়া গেলে তা দূর করার জন্য কিছু প্রযুক্তিগত উন্নয়ন দরকার হবে। সর্বোপরি এসবের জন্য একটি আধুনিক অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে, যা ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে সম্ভব নয়। যদি এই প্রযুক্তি ব্যবহারে তাড়াহুড়া করা হয় তাহলে তা কোনোভাবেই পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে না। তাই আমাদের মতামত হচ্ছে, ২০১৪ সালের নির্বাচনে প্রস্তাবিত ই-ভোটিং পদ্ধতি ৫-১০ শতাংশ ব্যবহার করা হোক। আর ২০১৯-এর নির্বাচন থেকে তা পুরেপুরি ব্যবহার করাই যুক্তিসংগত হবে। তত দিনে আমাদের দেশের জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর এই প্রযুক্তি সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা গড়ে উঠবে এবং তারা নির্বাচনের ফল মেনে নিতেও সক্ষম হবে কোনো ধরনের কারচুপির অভিযোগ উত্থাপন ছাড়াই। ই-সরকার, ই-ব্যবসা, ই-ব্যাংকিং, টেলি চিকিৎসা, অনলাইন টাকা পরিশোধের মতো ইন্টারনেট বিপ্লবের চাহিদা হচ্ছে, জাতিকে আজ অথবা কাল ই-ভোটিং প্রবর্তন করতে হবে। আমাদের জাতীয় নেত্রীত্বের দায়িত্ব হচ্ছে একে অন্যের প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস রেখে ই-ভোটিং আজ না কাল প্রবর্তন করা হবে, তা নিয়ে আলোচনা করা।
লেখকবৃন্দ : যথাক্রমে অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, সহকারী অধ্যাপক, ছাত্র, তড়িৎ প্রকৌশলী ও কম্পিউটার বিজ্ঞান অনুষদ, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, সহকারী অধ্যাপক, প্রকৌশল ও কম্পিউটার বিজ্ঞান অনুষদ, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি
abdulawal@northsouth.edu

No comments

Powered by Blogger.