আরোগ্য কামনা-ফিরে আসুন বনভান্তে by হরি কিশোর চাকমা

মাত্র কিছুদিন আগে ৮ জানুয়ারি উদ্যাপন করা হয়েছে বনভান্তেখ্যাত বৌদ্ধ ধর্মীয় সাধক সাধনানন্দ মহাস্থবিরের ৯৩তম জন্মদিন। গৌতম বুদ্ধের অহিংস নীতির প্রচারক এ মহান পুরুষের জন্মদিন উদ্যাপন উপলক্ষে বিশ্বের অন্যতম বৌদ্ধ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থাইল্যান্ডের ধম্মকায়া থেকে এসেছিলেন বৌদ্ধ ভিক্ষু ও পুণ্যার্থী মানুষ। এরপর এসেছিলেন মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর প্রধান।


শুধু তাই নয়, বিশ্বের যেকোনো বৌদ্ধ ধর্মপ্রধান দেশ থেকে কোনো রাষ্ট্র নেতা, ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা বাংলাদেশে এলে পরিদর্শনে আসেন রাঙামাটির রাজবন বিহারে এবং আশীর্বাদ নেন বনভান্তের। এভাবে শুধু পার্বত্য চট্টগ্রাম বা দেশের অভ্যন্তরে নন, বিশ্বের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী দেশে বনভান্তের অহিংস নীতি এবং বুদ্ধ দর্শন প্রচারের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে।
কয়েক দিন আগে হঠাৎ বার্ধক্যজনিত রোগের নানা উপসর্গ দেখা দিতে শুরু করে বনভান্তের শরীরে। গত শুক্রবার দুপুরে অজ্ঞান অবস্থায় হেলিকপ্টারে করে রাঙামাটি থেকে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় বনভান্তেকে। এ সময় রাঙামাটি শহরের বিভিন্ন সড়কে দাঁড়িয়ে হাজার হাজার মানুষ হাত জোড় করে সাধুবাদ ধ্বনি তুলে তাঁর আরোগ্য কামনা করেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর পাশাপাশি বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ের অসাম্প্রদায়িক মানুষ বনভান্তের বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন। বর্তমান সময়ে তাঁর প্রয়োজন সবাই অনুভব করছেন। তাই বনভান্তের আরোগ্য লাভে আদিবাসীদের রাজা-প্রজা, নেতা-জনগণ, ধনী-দরিদ্র, নানা মত-পথের মানুষ প্রার্থনায় রত। তিনি আরোগ্য লাভ করে আমাদের মধ্যে ফিরে আসুন এটাই সবার কামনা।
ধর্মীয় দেশনায় (ধর্মীয় অনুসারী বা দর্শনার্থীদের উদ্দেশে দেওয়া বক্তব্য) আড়াই হাজার বছর আগের বুদ্ধযুগের ঘটনাবলির সঙ্গে তুলনা করে সমসাময়িক ঘটনাগুলোকে সহজ-সরলভাবে উপস্থাপনায় বনভান্তে অতুলনীয়। তিনি শুধু ধর্মীয় আধ্যাত্মিক বিষয় নয়, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বাস্তবতায় অত্যাধুনিক জীবনাচার এবং লোভ-মোহ, হিংসা-বিদ্বেষ, মাদক সেবন, ব্যাভিচার, হানাহানি, ভ্রাতৃঘাতের পরিণাম নিয়ে মানুষকে বোঝানোর কারণে অগণিত কিশোর, তরুণ, বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ অপকর্ম থেকে বিরত থাকেন। এতে সামাজিক শৃঙ্খলার পাশাপাশি সামগ্রিক পরিবেশও বজায় থাকে। অনেকের ধারণা, বনভান্তে না থাকলে ভ্রাতৃঘাতে জর্জরিত পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি আরও বেশি ভয়াবহ রূপ ধারণ করত। আদিবাসীদের মধ্যে একমাত্র তিনিই ভ্রাতৃঘাতে লিপ্ত নেতা-কর্মী ও দলগুলোকে নাম ধরে ভ্রাতৃঘাত বন্ধের কথা নির্দ্বিধায়, নির্ভয়ে বলতে পারেন।
গত শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময় থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা বলিদান, নানা প্রকৃতিপূজাসহ এক ধরনের মিশ্রধর্ম পালন করতেন। বনভান্তের আর্বিভাব এবং বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশুদ্ধ বৌদ্ধ ধর্মীয় সংস্কৃতি গড়ে ওঠে।
বনভান্তে প্রথম প্রব্রজ্যা (বৌদ্ধ ধর্মীয় সাধক হওয়া) গ্রহণ করেন চট্টগ্রামের নন্দনকানন বৌদ্ধ বিহারে। পরে ধ্যান সাধনার লক্ষ্যে চলে আসেন রাঙামাটির ধনপাতা এলাকায়। সেখানে গভীর বনে দীর্ঘকাল লোকোত্তর সাধনায় নিয়োজিত থাকেন। কিন্তু কাপ্তাই বাঁধের পানিতে সে এলাকা ডুবে গেলে খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালায় যান। সেখানে দীর্ঘ সময় সাধনার পর ১৯৭১ সালে আসেন লংগদু উপজেলার তিনটিলায়। দীর্ঘদিন গভীর বনজঙ্গলে সাধনা, জ্ঞান, প্রজ্ঞা এবং বৌদ্ধ ধর্মের বাণী সহজ ভাষায় অনর্গলভাবে বলতে পারায় সাধনানন্দ ভিক্ষু ‘বনভান্তে’ নামে খ্যাতি লাভ করেন। লংগদু তিনটিলায় তাঁর উপদেশ আর আগ্রহে গৌতম বুদ্ধের সময় মহা উপাসিকা বিশাখার প্রবর্তিত নিয়মে প্রবর্তন হয় কঠিন চীবর দান উৎসব। এ উৎসব বৌদ্ধ যুগের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম সংস্কৃতির সেতুবন্ধ রচনা করে। ১৯৭৬ সালে বনভান্তে চলে আসেন রাঙামাটি রাজবন বিহারে। তখন থেকে বনভান্তের বাণী পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারা দেশ এবং বিশ্বের বিভিন্ন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কাছে প্রচার লাভ করে।
অপরাজনীতি, অপসংস্কৃতি, মাদক, ব্যাভিচার, হিংসা, হানাহানির মতো অপকর্মগুলোকে ধর্মীয় দর্শন ও বাস্তবতার নিরিখে যুক্তিপূর্ণভাবে তুলে ধরার মতো ব্যক্তি আদিবাসী সমাজে বনভান্তে ছাড়া দ্বিতীয়টি নেই। তাঁর দেখানো আদর্শ আর নীতির কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী সমাজ থেকে মাদক সেবন ও বিভিন্ন মধ্যযুগীয় পূজা-পার্বনের রীতি প্রায় বিলুপ্ত হয়েছে। ব্যাভিচারের দিকে ধাবিত হয়নি আদিবাসী সমাজ। সে জন্য তাঁর অসুস্থতায় আজ লাখো লাখো মানুষের মুখে মলিনতার ছাপ।
হরি কিশোর চাকমা, সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.