ভিন্নমত-শেয়ার মূল্য কতটুকু নামতে পারে? by আবু আহমেদ
অনেকেই এই প্রশ্নটি আমাকে জিজ্ঞেস করে। আমি বলি নামতে পারে, আবার বাড়তেও পারে। উত্তর শুনে অনেকে বলেন_এটা তো এমন উত্তর হলো, ট্রেন আসতেও পারে, নাও আসতে পারে। আমি বলি হ্যাঁ, অনেকটা সে রকমই। আপনার শেয়ারবাজারে যদি কোনো কারণে অর্থের জোগান বাড়ে, তাহলে শেয়ারের মূল্য বাড়বে, আর একই কারণে যদি অর্থের জোগানের কমতি হয়, তাহলে শেয়ারের মূল্য পড়ে যায়।
২০০৮-২০১০-এ শেয়ারবাজারে যে মূল্য বাড়ল বা বুদ্বুদ তৈরি হয়েছিল তার মূল কারণ ছিল অর্থের বহুগুণে জোগান। এই অর্থ কারা জোগান দিল? ঋণ বিক্রেতারা, ছোট বিনিয়োগকারীরা, ব্যাংকিং কম্পানিগুলো বা আরো অনেকে। একটা ধারণা তৈরি করা হয়েছিল যে শেয়ার কিনলেই লাভ হবে। এর ফলে না বুঝে অনেক লোক শেয়ার ব্যবসায়ী হতে চেষ্টা করেছে। তাদের মধ্যে অতি নগণ্যসংখ্যক লোক জিততে পেরেছে। প্রশ্ন হতে পারে এই লাখ লাখ লোকের অর্থ গেল কই? সেই অর্থ কথিত আইনিভাবে চলে গেছে যারা আইপিও, ডাইরেক্ট লিস্টিং এবং আগে থেকে অধিকারে থাকা লাখ লাখ শেয়ার বাজারে বেচে দিয়েছে, তাদের পকেটে। ওই বুদ্বুদের বাজারে ৩০ টাকার শেয়ারকে ৩০০ টাকায় বেচা হয়েছে। আজকে অনেকে প্রশ্ন তোলেন এবং অতি সংগত কারণেই তোলেন অত চড়া মূল্যে রেগুলেটর এসইসি বড়লোকদের লাখ লাখ শেয়ারকে বেচতে দিল কেন? সেই একই প্রশ্ন আমারও। তাই তো বলি যে রেগুলেটর শুধু বড় খেলোয়াড়দের পক্ষে কাজ করে, সেই রেগুলেটরের কোনো দরকার নেই। যেদিন দেখবেন আপনার অর্থনীতিতে তিনটি লোক জনপ্রিয় হওয়ার জন্য চেষ্টা করছেন, তখন বুঝে নেবেন সামনে সমূহ বিপদ আসছে। ওই তিনটি লোকের মধ্যে এক নম্বর হলো দেশের অর্থমন্ত্রী। তিনি যদি সবাইকে খুশি করার নীতি গ্রহণ করেন, তখন বুঝবেন অর্থনীতি ভালো যাবে না। আর অন্য দুই ব্যক্তি হলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এবং এসইসির চেয়ারম্যান। বাংলাদেশে সিকিউরিটিজ ল'জ বা শেয়ারবাজারের আইন ও রেগুলেশন্স ভঙ্গ করার কারণে এ পর্যন্ত কারো জেল হয়নি। এর কারণ হলো এসইসি শক্ত হতে পারেনি। এসইসি আজও অতি দুর্বল প্রতিষ্ঠান। শত শত কোটি টাকা লোপাট হওয়ার পর এসইসি একটা উদ্ধার প্যাকেজ দিল বটে, তবে সে প্যাকেজ কত দিনে কতটা বাস্তবায়ন হয়, সে নিয়ে শেয়ারবাজারের লোকজনের মধ্যে সন্দেহ আছে। বাজার অর্থনীতি এবং এর মধ্যে শেয়ারবাজারের ক্ষেত্রে Expeclation বা আশাবাদ একটা বিরাট ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এ মুহূর্তে আশাবাদের স্তর অতি নিম্নে। আর শেয়ারবাজারের ক্ষেত্রে আরো তলানিতে। ফলে প্যাকেজ আপাতত কোনো কাজে আসছে না। তবে আমার বিশ্বাস ,বাস্তবায়ন হলে ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। এবার বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যারা ঋণ করে শেয়ার কিনেছে। তাদের মধ্যে অনেকে নিজের পুঁজিটুকুর সম্পূর্ণ হারিয়েছে। এখন ঋণ বিক্রেতা ব্যাংকগুলো তাদের পাওনা ঋণ ফেরত দেওয়ার জন্য ওই সব বিনিয়োগকারীকে তাড়া করছে। শেয়ারবাজারে একটা কলঙ্কময় অধ্যায় ঘটে গেছে। সে কলঙ্কের মোচন কিভাবে হবে, সেটা ইব্রাহিম খালেদের রিপোর্টে কিছুটা বলা হয়েছে। যাক, অন্য এবং আসল প্রসঙ্গে আসি। বলা হচ্ছে শেয়ারবাজার আর কত নামতে পারে। এই প্রশ্নের সরাসরি কোনো উত্তর নেই। তবে একটা উত্তর আছে, বর্তমানের ৫০০০-এর সূচকেও কিছু শেয়ার অতিমূল্যায়িত। বলতে পারেন শেয়ারটির মূল্য তো মাত্র ২৪ টাকা, এটা কিভাবে আবার অতি মূল্যায়িত? হ্যাঁ, এই মূল্যেও একটা শেয়ার অতি মূল্যায়িত হতে পারে। আবার ২৫০ টাকারও একটা শেয়ার অতি মূল্যায়িত নয়। শেয়ারের মূল্য কিভাবে নির্ধারিত হয় বা কত মূল্য হওয়া উচিত, সে নিয়ে অনেক অনেক লেখা ও গবেষণা আছে। অনেক লোকই সেগুলো পড়ে এবং ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জন করে। আমাদের লাখ লাখ শেয়ার বিনিয়োগকারীর কিন্তু আর্থিক বিবরণী এবং অন্য তথ্য পড়তে জানে না। ফলে অনেকে হুজুগে-গুজবে বেশি মূল্যে শেয়ার কিনেছে এবং আজও কিনছে। মনে রাখবেন অর্থের সুযোগ হার বা Opportunity Cost বলতে একটা কথা আছে। অর্থ যদি অন্য খাতে বার্ষিক ১৫ শতাংশ আয় করতে পারে, তাহলে শেয়ারবাজারে ৮-১০ শতাংশ আয় করার জন্য অবশ্যই আসবে না। আপনার অর্থনীতিতে এখন সুদের হার কত? দুই বছর আগে কত ছিল? এ অবস্থায় শেয়ারবাজারে তখনই নতুন অর্থ আসবে, যখন শেয়ারবাজার থেকে রিটার্ন আনুপাতিক বর্ধিত হারে পাওয়া যাবে। আপনাদের শেয়ারবাজারে সেই বর্ধিত হারে রিটার্ন পেতে হলে কত মূল্যে শেয়ার কিনতে হবে? অবশ্যই আগের তুলনায় কম মূল্যে। অর্থের জন্য কোনো কোনো বাজার প্রতিযোগিতা করে? বলতে গেলে সব বাজারই। তবে শেয়ারবাজারের লোকদের জন্য বেশি প্রতিযোগিতা করছে টার্ম ডিপোজিট বা মেয়াদি আমানত। এ অবস্থায় যেকোনো বিবেকবান লোকই অর্থের Opportunity Cost দেখবে। আর কম্পানিগুলো যেসব তথ্য দেয়, তার সবগুলো কি বিশ্বাসযোগ্য? আমরা তো শেয়ারের মূল্যের ক্ষেত্রে EPS বা শেয়ার প্রতি আয়কেই বেশি প্রাধান্য দিই। কিন্তু সব কম্পানির ক্ষেত্রে একই EPS দেখলে একই মূল্যে শেয়ার কেনা কি ঠিক হবে? মোটেই না। এ ক্ষেত্রে সাদামাটা উত্তর হলো কোনো কম্পানির ক্ষেত্রে EPS-এর ১৫ গুণেও শেয়ার কেনা যাবে, আর কোনো কম্পানির ক্ষেত্রে ১০ গুণেও কেনা যাবে না। কেন যাবে না, সে অনেক কথা। সত্যিকার অর্থে যারা প্রফেশনাল, তারা অন্তত জানার কথা কেন যাবে, আর কেন যাবে না। আমার একটা পরামর্শ হলো, শেয়ারবাজারের অত খুঁটিনাটি বিষয় যদি না জানেন তবুও শেয়ারবাজারে থাকতে চান, তারা 'ভালো' শেয়ার কিনে বাজার আপাতত ত্যাগ করতে পারেন। তবে শেয়ার কেনার জন্য ওয়ারেন বাফেটের নীতিই হলো উত্তম। Warren Buffet বলেছেন, সবাই যখন শেয়ার কেনে, তখন আমি শেয়ার বেচি, আর সবাই যখন বিক্রয় করে, তখন আমি কিনি। অন্যভাবে তিনি বলেছেন, সবাই যখন ভীত, তখন আমি সাহসী, আর সবাই যখন অতিসাহসী, তখন আমি ভীত। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারেও অনেক অনেক কেলেঙ্কারি সংঘটিত হয়েছে। তবে তারা কেলেঙ্কারি থেকে যে Fall Outহয়, তা নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করে। অনেকের শাস্তিও হয়। অনেক সংস্থা সেই বাজারেও সংঘটিত হয়েছে। তবুও তাদের অর্থনীতিতে কেলেঙ্কারির শেষ নেই। শেয়ারবাজার মন্দা তাতে কী? তারা কেলেঙ্কারি করছে সাবপ্রাইম বাজারে। আজকে প্রেসিডেন্ট ওবামা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে ঠিক করতে অনেক সময় লাগবে। এখন রিপাবলিকান ধনীদেরও অনেক পছন্দের প্রেসিডেন্ট ওবামা। কারণ তিনি গরিবের স্বার্থকে বিকিয়ে দিয়ে সেখানে ধনী তোষণে ব্যস্ত।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments