নির্বাচন কমিশন-অনুসন্ধান কমিটির সামনে চ্যালেঞ্জ by বদিউল আলম মজুমদার
বহুদিন ধরে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) পক্ষ থেকে আমরা নির্বাচন কমিশনসহ সব সাংবিধানিক ও অন্যান্য সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ প্রদানের লক্ষ্যে নিরপেক্ষ অনুসন্ধান কমিটি গঠনের প্রস্তাব করে আসছি। কারণ, এর মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত সৎ, সাহসী ও যোগ্য ব্যক্তিদের এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পাওয়ার পথ সুগম হবে।
কিন্তু সম্প্রতি যেভাবে এবং যাঁদের নিয়ে প্রধান ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য অনুসন্ধান কমিটি গঠিত হয়েছে, তা নিয়ে আমাদের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। একই সঙ্গে কমিটির কার্যপদ্ধতি সম্পর্কেও আমাদের কিছু প্রস্তাব রয়েছে, যা এর সুপারিশের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
আমরা শুনেছি যে ২৩টি দলের সঙ্গে সংলাপের ভিত্তিতে ১২ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি কমিশনে নিয়োগ প্রদানের ক্ষেত্রে অস্পষ্টতা দূরীকরণের লক্ষ্যে একটি প্রজ্ঞাপন জারির সুপারিশ করেন। সম্ভাব্য প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারদের নাম বাছাইয়ের লক্ষ্যে পাঁচ সদস্যের একটি সার্চ বা অনুসন্ধান কমিটি গঠনের প্রস্তাব রাষ্ট্রপতির সুপারিশে অন্তর্ভুক্ত। রাষ্ট্রপতি কমিটিতে প্রধান বিচারপতি মনোনীত আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের একজন করে বিচারপতি, সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান, মহাহিসাবনিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করেন।
এরই ধারাবাহিকতায় ২১ জানুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে চার সদস্যবিশিষ্ট একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠনের ঘোষণা দেয়। পরবর্তী সময়ে ২৪ জানুয়ারি ২০১২ তারিখে জারি করা আরেকটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে কমিটির সদস্যদের নাম প্রকাশ করা হয়, যাঁরা হলেন: আপিল বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মো. নূরুজ্জামান, মহাহিসাবনিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক আহমেদ আতাউল হাকিম এবং সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান এ টি আহমেদুল হক চৌধুরী। কমিটিকে তাদের সুপারিশ পেশ করার জন্য ১০ কার্যদিবস সময় দেওয়া হয়। একই সঙ্গে কমিটিকে তার কার্যপদ্ধতি নির্ধারণেরও ক্ষমতা দেওয়া হয়।
আমাদের প্রথম প্রশ্ন, কেন আইনের পরিবর্তে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হলো? আইনের মাধ্যমে কমিটি করা হলে এতে প্রধান ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারদের যোগ্যতা-অযোগ্যতার মানদণ্ড নির্ধারিত করে দেওয়া যেত। ফলে কমিটি তাদের বাছাইপ্রক্রিয়ায় এসব মানদণ্ড ব্যবহার করে যথাযথ ব্যক্তিদের নাম সুপারিশ করতে পারত। প্রশ্ন, কমিটি কী মানদণ্ডের ভিত্তিতে, কাদের নাম সুপারিশ করবে? আইনের মাধ্যমে নির্ধারিত করে দিলে রাজনৈতিক দল এবং অন্য নাগরিকেরাও এসব ক্রাইটেরিয়ার ভিত্তিতে কমিশনে নিয়োগের জন্য নাম প্রস্তাব করতে পারত। প্রসঙ্গত, সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ প্রদানের লক্ষ্যে একটি আইনপ্রণয়নের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে, যা গত ৪০ বছরেও কোনো সরকার বাস্তবায়ন করেনি।
রাষ্ট্রের সব গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের যোগ্যতা-অযোগ্যতার মাপকাঠি থাকা উচিত। তা না থাকলেই বিতর্কিত ব্যক্তিরা গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পাওয়ার সুযোগ পান। যেমন—গত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য বিএনপির মনোনয়ন চাওয়া এক ব্যক্তিকেও নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তাই কমিশনে নিয়োগ প্রদানের জন্য আইনপ্রণয়নের কোনো বিকল্প নেই।
এ ধরনের আইনপ্রণয়ন খুব কঠিন কাজ নয়। বর্তমান নির্বাচন কমিশন গত বছর দুই পৃষ্ঠার এমন একটি আইনের খসড়া প্রকাশও করেছিল। শোনা যায়, সরকারের কাছে প্রেরিত রাষ্ট্রপতির প্রস্তাবেও একটি আইনের খসড়া অন্তর্ভুক্ত ছিল। সংসদ অধেবেশন ছিল না বলে, অধ্যাদেশ আকারে এটি জারি করা যেত। কিন্তু কেন সরকার তা করতে রাজি হলো না, তা আমাদের বোধগম্য নয়।
এ ছাড়া আইনের মাধ্যমে কমিটি কী অনুসন্ধান করবে তা নির্ধারিত থাকলে অতীতের ভুলত্রুটি ও বিতর্ক এড়ানো যেত। যেমন—বর্তমান সরকারের আমলে অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে তথ্য কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন ও মানবাধিকার কমিশনে যেসব নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাঁদের অনেকের বিরুদ্ধেই দলপ্রীতির অভিযোগ রয়েছে।
আইনের মাধ্যমে অনুসন্ধান কমিটির কার্যপদ্ধতিও নির্ধারিত করা যেত। আইনে স্বচ্ছ পদ্ধতিতে কমিশনের কার্যক্রম পরিচালনা করার নির্দেশনা থাকলেও অনেক বিতর্ক এড়ানো যেত। দ্বিতীয় প্রশ্ন, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কেন নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হলো না? নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাবে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশ সংসদের কার্য উপদেষ্টা কমিটির কাছে এবং কার্য উপদেষ্টা কমিটি নিয়োগের জন্য চূড়ান্ত নামের তালিকা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরণের কথা। যে সরকার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ওপর আস্থা স্থাপনের লক্ষ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করল, সে সরকার কোন যুক্তিতে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের এ কাজে সম্পৃক্ত করা থেকে বিরত থাকল? কার্য উপদেষ্টা কমিটিকে যুক্ত না করা হলেও কেন প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীর অন্তত একজন করে প্রতিনিধিকে অনুসন্ধান কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হলো না? উপযুক্ত ব্যক্তিদের কমিটিতে রাখার সুপারিশ যেহেতু রাষ্ট্রপতির প্রস্তাবে ছিল, তাই এটি সহজেই করা যেত।
আর অনির্বাচিত ব্যক্তিদের নিয়েই যদি অনুসন্ধান কমিটি হবে, তাহলে এতে গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করা হলো না কেন? তা করা হলে কমিটি আরও গ্রহণযোগ্যতা পেত।
তৃতীয় প্রশ্ন, কেন বিচারপতিদের অনুসন্ধান কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হলো? অনেকেরই স্মরণ আছে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে মামলার সংক্ষিপ্ত আদেশে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বিচার বিভাগকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার থেকে দূরে রাখার আকুতি জানিয়েছিলেন। বিচার বিভাগের ওপর বিরূপ প্রভাবের করণেই তা করা হয়েছিল। তাই বর্তমান কমিটিতে দুজন বিচারপতিকে অন্তর্ভুক্ত করার কোনো যুক্তি খুঁজে পাই না।
এ ছাড়া উচ্চ আদালতে অনেক বিচারক থাকতে কেন প্রধান বিচারপতি এই দুজন বিচারপতির নাম অনুসন্ধান কমিটিতে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব করলেন? অত্যন্ত সংকোচের সঙ্গেই বলছি, এই দুজন বিচারপতির একজন বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্যানেলে ঢাকা বারের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এবং জুন মাসে হাইকোর্টের বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান (নিউ এজ, ২৮ জানুয়ারি ২০১২)। এ ছাড়া কমিটির আরেকজন সদস্যের বিরুদ্ধেও দলপ্রীতির অভিযোগ রয়েছে।
আমাদের অন্য আরেকটি প্রশ্ন, কেন সরকার রাষ্ট্রপতির প্রস্তাব উপেক্ষা করে তাঁর প্রতি অমর্যাদা প্রদর্শন করল? কেন দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানকে অনুসন্ধান কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হলো?
সরকার অবশ্য বলতে পারে যে অনুসন্ধান কমিটিতে শুধু সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদেরই অন্তর্ভুক্ত করেছে। তা-ই যদি হয়, তাহলে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে যুক্ত করা হলো না কেন? আমাদের প্রধান ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার তো বহু সময়, শ্রম ও মেধা ব্যয় করে কমিশনকে একটা মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং প্রতিষ্ঠানটির ওপর তাঁদের এক ধরনের ‘মালিকানাবোধ’ সৃষ্টি হয়েছে। ফলে তাঁরা সাধারণত চাইবেন না বিতর্কিত ব্যক্তিরা নিয়োগ পেয়ে এর সুনাম নষ্ট করে—এতে তাঁদের ‘লিগেসি’ বা যোগ্য উত্তরাধিকারের প্রশ্ন জড়িত। এ ছাড়া সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন বলেই কি কমিশনের সচিবালয়ের পরিবর্তে মন্ত্রিপরিষদের ওপর কমিটিকে সাচিবিক সহায়তা প্রদানের দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে?
সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হলেই কোনো ব্যক্তি সৎ ও সাধু হয়ে যান না। আমাদের সংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগপ্রাপ্ত অনেক ব্যক্তির বিরুদ্ধেই দলপ্রীতির অভিযোগ রয়েছে। এসব ব্যক্তি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের ঢালের আড়ালে থেকে দলপ্রীতির চর্চা করেন, যার দীর্ঘমেয়াদি পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। কারণ এর মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর নাগরিকদের আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়।
এটি সুস্পষ্ট যে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্কের মধ্য দিয়ে অনুসন্ধান কমিটি গঠিত এবং এর যাত্রা শুরু হয়েছে। তদুপরি অতীতের অনুসন্ধান কমিটিগুলোর পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ নবগঠিত কমিটির সামনে একটি বড় চ্যালেঞ্জের সৃষ্টি করেছে। চ্যালেঞ্জটি হলো—একটি নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন করা। স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার ভিত্তিতে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমেই কমিটি এ চ্যালেঞ্জে উত্তীর্ণ হতে পারবে।
পশ্চিমের অনেক দেশেই ‘সানশাইন ল’ রয়েছে। এমন আইনের ফলে সীমিত কিছু বিষয় ছাড়া সরকারি প্রতিষ্ঠানের সব সিদ্ধান্তই প্রকাশ্য সভায় গ্রহণ করতে হয়। এর মূল উদ্দেশ্য হলো সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। তাই আমরা প্রস্তাব করছি অনুসন্ধান কমিটির সভাগুলো উন্মুক্ত করার জন্য, যাতে রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা এগুলোতে উপস্থিত থাকতে পারেন।
স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার আরেকটি পন্থা হতে পারে—অনুসন্ধান কমিটির বিবেচনাধীন ও রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করা নামগুলো এবং সুপারিশের পেছনে যুক্তিসহ প্রকাশ করা। তা করা হলে বিবেচনাধীন ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যদি কারও কোনো গুরুতর অভিযোগ থাকে, তা প্রকাশ পাবে এবং যোগ্য ব্যক্তিদের কমিশনে নিয়োগের পথ সুগম হবে। এ লক্ষ্যে কমিটি গণশুনানিরও ব্যবস্থা করতে পারে। কমিটির যেহেতু নিজ কার্যপদ্ধতি নির্ধারণের এখতিয়ার রয়েছে, তাই কমিটি চাইলেই এর কার্যক্রমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে পারবে।
আমরা আশা করি যে অনুসন্ধান কমিটি তার ওপর অর্পিত গুরুদায়িত্বের কথা এবং দায়িত্বটি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতার সঙ্গে পালন না করার পরিণতি সম্পর্কে সজাগ থাকবে। আমরা জানি, আমাদের বিদ্যমান রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির কারণে কমিটি যাঁদের নামই প্রস্তাব করুক না কেন, বিরোধী দল বিনা দ্বিধায় তাঁদেরকে প্রত্যাখ্যান করবে। তবে দলনিরপেক্ষ নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের কাছে যদি অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে কমিশনে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা বিতর্কিত বলে প্রতীয়মান হন, তাহলে আমরা আরও গভীর সংকটের দিকে ধাবিত হব, যা জাতির জন্য কোনোভাবেই মঙ্গল বয়ে আনবে না।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।
আমরা শুনেছি যে ২৩টি দলের সঙ্গে সংলাপের ভিত্তিতে ১২ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি কমিশনে নিয়োগ প্রদানের ক্ষেত্রে অস্পষ্টতা দূরীকরণের লক্ষ্যে একটি প্রজ্ঞাপন জারির সুপারিশ করেন। সম্ভাব্য প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারদের নাম বাছাইয়ের লক্ষ্যে পাঁচ সদস্যের একটি সার্চ বা অনুসন্ধান কমিটি গঠনের প্রস্তাব রাষ্ট্রপতির সুপারিশে অন্তর্ভুক্ত। রাষ্ট্রপতি কমিটিতে প্রধান বিচারপতি মনোনীত আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের একজন করে বিচারপতি, সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান, মহাহিসাবনিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করেন।
এরই ধারাবাহিকতায় ২১ জানুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে চার সদস্যবিশিষ্ট একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠনের ঘোষণা দেয়। পরবর্তী সময়ে ২৪ জানুয়ারি ২০১২ তারিখে জারি করা আরেকটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে কমিটির সদস্যদের নাম প্রকাশ করা হয়, যাঁরা হলেন: আপিল বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মো. নূরুজ্জামান, মহাহিসাবনিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক আহমেদ আতাউল হাকিম এবং সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান এ টি আহমেদুল হক চৌধুরী। কমিটিকে তাদের সুপারিশ পেশ করার জন্য ১০ কার্যদিবস সময় দেওয়া হয়। একই সঙ্গে কমিটিকে তার কার্যপদ্ধতি নির্ধারণেরও ক্ষমতা দেওয়া হয়।
আমাদের প্রথম প্রশ্ন, কেন আইনের পরিবর্তে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হলো? আইনের মাধ্যমে কমিটি করা হলে এতে প্রধান ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারদের যোগ্যতা-অযোগ্যতার মানদণ্ড নির্ধারিত করে দেওয়া যেত। ফলে কমিটি তাদের বাছাইপ্রক্রিয়ায় এসব মানদণ্ড ব্যবহার করে যথাযথ ব্যক্তিদের নাম সুপারিশ করতে পারত। প্রশ্ন, কমিটি কী মানদণ্ডের ভিত্তিতে, কাদের নাম সুপারিশ করবে? আইনের মাধ্যমে নির্ধারিত করে দিলে রাজনৈতিক দল এবং অন্য নাগরিকেরাও এসব ক্রাইটেরিয়ার ভিত্তিতে কমিশনে নিয়োগের জন্য নাম প্রস্তাব করতে পারত। প্রসঙ্গত, সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ প্রদানের লক্ষ্যে একটি আইনপ্রণয়নের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে, যা গত ৪০ বছরেও কোনো সরকার বাস্তবায়ন করেনি।
রাষ্ট্রের সব গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের যোগ্যতা-অযোগ্যতার মাপকাঠি থাকা উচিত। তা না থাকলেই বিতর্কিত ব্যক্তিরা গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পাওয়ার সুযোগ পান। যেমন—গত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য বিএনপির মনোনয়ন চাওয়া এক ব্যক্তিকেও নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তাই কমিশনে নিয়োগ প্রদানের জন্য আইনপ্রণয়নের কোনো বিকল্প নেই।
এ ধরনের আইনপ্রণয়ন খুব কঠিন কাজ নয়। বর্তমান নির্বাচন কমিশন গত বছর দুই পৃষ্ঠার এমন একটি আইনের খসড়া প্রকাশও করেছিল। শোনা যায়, সরকারের কাছে প্রেরিত রাষ্ট্রপতির প্রস্তাবেও একটি আইনের খসড়া অন্তর্ভুক্ত ছিল। সংসদ অধেবেশন ছিল না বলে, অধ্যাদেশ আকারে এটি জারি করা যেত। কিন্তু কেন সরকার তা করতে রাজি হলো না, তা আমাদের বোধগম্য নয়।
এ ছাড়া আইনের মাধ্যমে কমিটি কী অনুসন্ধান করবে তা নির্ধারিত থাকলে অতীতের ভুলত্রুটি ও বিতর্ক এড়ানো যেত। যেমন—বর্তমান সরকারের আমলে অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে তথ্য কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন ও মানবাধিকার কমিশনে যেসব নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাঁদের অনেকের বিরুদ্ধেই দলপ্রীতির অভিযোগ রয়েছে।
আইনের মাধ্যমে অনুসন্ধান কমিটির কার্যপদ্ধতিও নির্ধারিত করা যেত। আইনে স্বচ্ছ পদ্ধতিতে কমিশনের কার্যক্রম পরিচালনা করার নির্দেশনা থাকলেও অনেক বিতর্ক এড়ানো যেত। দ্বিতীয় প্রশ্ন, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কেন নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হলো না? নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাবে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশ সংসদের কার্য উপদেষ্টা কমিটির কাছে এবং কার্য উপদেষ্টা কমিটি নিয়োগের জন্য চূড়ান্ত নামের তালিকা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরণের কথা। যে সরকার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ওপর আস্থা স্থাপনের লক্ষ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করল, সে সরকার কোন যুক্তিতে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের এ কাজে সম্পৃক্ত করা থেকে বিরত থাকল? কার্য উপদেষ্টা কমিটিকে যুক্ত না করা হলেও কেন প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীর অন্তত একজন করে প্রতিনিধিকে অনুসন্ধান কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হলো না? উপযুক্ত ব্যক্তিদের কমিটিতে রাখার সুপারিশ যেহেতু রাষ্ট্রপতির প্রস্তাবে ছিল, তাই এটি সহজেই করা যেত।
আর অনির্বাচিত ব্যক্তিদের নিয়েই যদি অনুসন্ধান কমিটি হবে, তাহলে এতে গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করা হলো না কেন? তা করা হলে কমিটি আরও গ্রহণযোগ্যতা পেত।
তৃতীয় প্রশ্ন, কেন বিচারপতিদের অনুসন্ধান কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হলো? অনেকেরই স্মরণ আছে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে মামলার সংক্ষিপ্ত আদেশে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বিচার বিভাগকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার থেকে দূরে রাখার আকুতি জানিয়েছিলেন। বিচার বিভাগের ওপর বিরূপ প্রভাবের করণেই তা করা হয়েছিল। তাই বর্তমান কমিটিতে দুজন বিচারপতিকে অন্তর্ভুক্ত করার কোনো যুক্তি খুঁজে পাই না।
এ ছাড়া উচ্চ আদালতে অনেক বিচারক থাকতে কেন প্রধান বিচারপতি এই দুজন বিচারপতির নাম অনুসন্ধান কমিটিতে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব করলেন? অত্যন্ত সংকোচের সঙ্গেই বলছি, এই দুজন বিচারপতির একজন বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্যানেলে ঢাকা বারের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এবং জুন মাসে হাইকোর্টের বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান (নিউ এজ, ২৮ জানুয়ারি ২০১২)। এ ছাড়া কমিটির আরেকজন সদস্যের বিরুদ্ধেও দলপ্রীতির অভিযোগ রয়েছে।
আমাদের অন্য আরেকটি প্রশ্ন, কেন সরকার রাষ্ট্রপতির প্রস্তাব উপেক্ষা করে তাঁর প্রতি অমর্যাদা প্রদর্শন করল? কেন দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানকে অনুসন্ধান কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হলো?
সরকার অবশ্য বলতে পারে যে অনুসন্ধান কমিটিতে শুধু সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদেরই অন্তর্ভুক্ত করেছে। তা-ই যদি হয়, তাহলে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে যুক্ত করা হলো না কেন? আমাদের প্রধান ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার তো বহু সময়, শ্রম ও মেধা ব্যয় করে কমিশনকে একটা মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং প্রতিষ্ঠানটির ওপর তাঁদের এক ধরনের ‘মালিকানাবোধ’ সৃষ্টি হয়েছে। ফলে তাঁরা সাধারণত চাইবেন না বিতর্কিত ব্যক্তিরা নিয়োগ পেয়ে এর সুনাম নষ্ট করে—এতে তাঁদের ‘লিগেসি’ বা যোগ্য উত্তরাধিকারের প্রশ্ন জড়িত। এ ছাড়া সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন বলেই কি কমিশনের সচিবালয়ের পরিবর্তে মন্ত্রিপরিষদের ওপর কমিটিকে সাচিবিক সহায়তা প্রদানের দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে?
সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হলেই কোনো ব্যক্তি সৎ ও সাধু হয়ে যান না। আমাদের সংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগপ্রাপ্ত অনেক ব্যক্তির বিরুদ্ধেই দলপ্রীতির অভিযোগ রয়েছে। এসব ব্যক্তি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের ঢালের আড়ালে থেকে দলপ্রীতির চর্চা করেন, যার দীর্ঘমেয়াদি পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। কারণ এর মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর নাগরিকদের আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়।
এটি সুস্পষ্ট যে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্কের মধ্য দিয়ে অনুসন্ধান কমিটি গঠিত এবং এর যাত্রা শুরু হয়েছে। তদুপরি অতীতের অনুসন্ধান কমিটিগুলোর পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ নবগঠিত কমিটির সামনে একটি বড় চ্যালেঞ্জের সৃষ্টি করেছে। চ্যালেঞ্জটি হলো—একটি নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন করা। স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার ভিত্তিতে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমেই কমিটি এ চ্যালেঞ্জে উত্তীর্ণ হতে পারবে।
পশ্চিমের অনেক দেশেই ‘সানশাইন ল’ রয়েছে। এমন আইনের ফলে সীমিত কিছু বিষয় ছাড়া সরকারি প্রতিষ্ঠানের সব সিদ্ধান্তই প্রকাশ্য সভায় গ্রহণ করতে হয়। এর মূল উদ্দেশ্য হলো সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। তাই আমরা প্রস্তাব করছি অনুসন্ধান কমিটির সভাগুলো উন্মুক্ত করার জন্য, যাতে রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা এগুলোতে উপস্থিত থাকতে পারেন।
স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার আরেকটি পন্থা হতে পারে—অনুসন্ধান কমিটির বিবেচনাধীন ও রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করা নামগুলো এবং সুপারিশের পেছনে যুক্তিসহ প্রকাশ করা। তা করা হলে বিবেচনাধীন ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যদি কারও কোনো গুরুতর অভিযোগ থাকে, তা প্রকাশ পাবে এবং যোগ্য ব্যক্তিদের কমিশনে নিয়োগের পথ সুগম হবে। এ লক্ষ্যে কমিটি গণশুনানিরও ব্যবস্থা করতে পারে। কমিটির যেহেতু নিজ কার্যপদ্ধতি নির্ধারণের এখতিয়ার রয়েছে, তাই কমিটি চাইলেই এর কার্যক্রমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে পারবে।
আমরা আশা করি যে অনুসন্ধান কমিটি তার ওপর অর্পিত গুরুদায়িত্বের কথা এবং দায়িত্বটি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতার সঙ্গে পালন না করার পরিণতি সম্পর্কে সজাগ থাকবে। আমরা জানি, আমাদের বিদ্যমান রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির কারণে কমিটি যাঁদের নামই প্রস্তাব করুক না কেন, বিরোধী দল বিনা দ্বিধায় তাঁদেরকে প্রত্যাখ্যান করবে। তবে দলনিরপেক্ষ নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের কাছে যদি অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে কমিশনে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা বিতর্কিত বলে প্রতীয়মান হন, তাহলে আমরা আরও গভীর সংকটের দিকে ধাবিত হব, যা জাতির জন্য কোনোভাবেই মঙ্গল বয়ে আনবে না।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।
No comments