'দুঃসময়ে গুণীজনের পাশে রাষ্ট্র' by ডা. এম এ করীম

গত ১৪ জানুয়ারি মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী শেষে বাড়ি থেকে ঢাকার পথে রওনা দিয়েছিলাম সড়কপথে। তীব্র যানজট। তাবলিগ জামাতের কারণে। আমার খবর শোনার নেশা প্রচুর। গাড়িতে আজকাল এফএম রেডিওর সুবাদে খবর শোনা যায়। খবরে হঠাৎ শুনতে পেলাম বাংলার কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদকে বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘে বাংলাদেশ মিশনে জ্যেষ্ঠ বিশেষ উপদেষ্টা নিয়োগ দিয়েছে।

গাড়িতে আমার সহধর্মিণী ডা. আলেয়া ফেরদৌসি (চিকিৎসকের দৃষ্টিকোণ থেকে) বলে বসলেন, হুমায়ূন ভাই কী এই শরীর নিয়ে চাকরি করতে পারবেন? (জাতিসংঘের ব্যাপারে তাঁর জ্ঞানের স্বল্পতার কারণেই কথাটা সে বলেছে)। সম্ভবত সপ্তম কেমোথেরাপি দেওয়া শেষ হয়েছে অথবা তার আগমুহূর্তে তাঁর এ নিয়োগ সরকার দিয়েছে। এর আগে চিকিৎসার জন্য হুমায়ূন আহমেদ নিউ ইয়র্কে যান। এর কিছুদিন পর আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘে সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে নিউ ইয়র্কে গিয়েছিলেন। তিনি নিজে লেখকের ভাড়া বাসায় লেখককে দেখতে গিয়েছিলেন কাগজ ও কলম নিয়ে। যাতে করে লেখক সেখানে বসেও লেখেন এবং সুস্থ হয়ে দেশে ফিরে এসে লিখতে পারেন আগের মতো। এ দেশের প্রয়োজন হুমায়ূন আহমেদের । হুমায়ূন আহমেদকে বাঙালির যে বড় প্রয়োজন। এ দেশের মানুষ এত তাড়াতাড়ি যে হুমায়ূনকে হারাতে প্রস্তুত নয়। তিনি এ দেশে তুলনাহীন ও অদ্বিতীয়। তাঁর জায়গা পূরণের জন্য কেউ প্রস্তুত হয়নি এখনো। এই তো সেদিন হুমায়ূন লিখলেন, 'জোছনা ও জননীর গল্প'। এটা শুধু উপন্যাস নয়, উপন্যাসের চেয়ে অনেক বেশি কিছু। এ হচ্ছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচিত এক মহাকাব্য। এত সমার্থক ও সুন্দরভাবে আর কেউ কিছু রচনা করতে পারেনি বা কিছু রচিত হয়েছে বলে আমার জানা নেই। বাঙালির ঘরে ঘরে এই মহাকাব্য অতি যত্নে ও মায়ায় রক্ষিত হবে। কোনো জোছনার রাতে বাংলার গ্রাম-প্রান্তরে দাওয়ায় বসে কেউ একজন তাঁর উদাত্ত গলায় পড়বেন এ উপন্যাসের এক একটি অধ্যায়, আর তার পাশে বসে শ্রোতারা চোখের জলে ভাসবে। এই মহাকাব্যে তাদের ফিরিয়ে নেবে স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের সেই মিশ্র সময়ের উনিশ শ একাত্তরে। হুমায়ূন আহমেদের খ্যাতি শীর্ষে। দুই বাংলার অপ্রতিদ্বন্দ্বী সাহিত্যে জগতের নক্ষত্র। সমরেশ বসু, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে ছাড়িয়ে তালগাছের মতো উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। অনেকেই দ্বিধায় পড়েন হুমায়ূন আহমেদকে কি শুধু সাহিত্যিক বলব? না আরো কিছু। হুমায়ূন ঔপন্যাসিক, জাদুকর, চিত্রশিল্পী, গীতিকার, সুরকার, নাট্যকার, চিত্রপরিচালক ও চিত্রনাট্যকার। হুমায়ূন তাঁর পারিবারিক ঐতিহ্য ধরে রেখে আজ সুশীল শ্রেণীর হাত থেকে বই পড়াকে সাধারণ মানুষের মাঝে নিয়ে এসেছে। স্বাধীনতার পর যখন সবাই ভারতীয় লেখা নিয়ে মাতামাতি (পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের) শুরু করেছিল, যখন এ দেশের বাজার ভারতীয় উপন্যাসে ভরপুর তখন একমাত্র হুমায়ূন তাঁদের রুখতে পেরেছিল আর কেউ নন। এবং তখন থেকেই এ দেশের সাহিত্যজগতের নক্ষত্র হুমায়ূন আহমেদ। সেই নক্ষত্রকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বাসভবনে (ভাড়া করা বাসা) দেখতে গিয়ে কাগজ ও কলম দিয়ে এসেই ক্ষান্ত হননি, তাঁকে জাতিসংঘের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দিয়ে বিরল সম্মানে সম্মোহিত করেছেন। আমরা সাধারণত দেখি রাষ্ট্র কতগুলো খেতাব দেন সেগুলো হলো 'একুশে পদক', 'স্বাধীনতা পদক' ও 'জাতীয় অধ্যাপক'। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে মরণোত্তর খেতাব বেশি দিতে। আর জীবিত অবস্থায় যেগুলো দেওয়া হয় সেগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ আওয়ামী বুদ্ধিজীবী নন বা কোনো দলীয় আনুগত্য তাঁর ছিল_এমন কথা কেউ বলতে পারবে না। হুমায়ূন 'সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো' বলতেই তিনি অভ্যস্ত। তবুও মাঝেমধ্যে অনেকেই বলতে শুনেছি ১৯৯১ সালের নির্বাচনে 'দৈনিক বাংলায়' সাক্ষাৎকারে যখন সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেছিলেন আপনি ভোট কাকে দেবেন, তখন নাকি হুমায়ূন আহমেদ 'ধানের শীষে' ভোট দেবেন বলে উল্লেখ করেছিলেন। (সে সময়ে আমি দেশের বাইরে থাকায় পত্রিকাটি পড়ার সৌভাগ্য হয়নি)। আমি যে কথাটা বলতে চাই, তা হলো রাষ্ট্র মত ও পথের পার্থক্য বিবেচনায় না এনে দুঃসময় গুণীজনের পাশে দাঁড়াবে_এটাই কাম্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ ধরনের মনোভাব সব সময় থাকবে বলে আমরা আশা করব। আমি শুনেছি এ রকম আরো দু-তিনজনের পাশে দাঁড়িয়েছেন। এ ধরনের সম্মানে সম্মানিত করেছেন। ভিন্নমতের গুণীজনকেও নাকি তিনি সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন। তাঁর জন্য অবশ্যই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধন্যবাদের যোগ্য। তিনি গল্প, উপন্যাস ও কবিতার বই অবসরে পড়াশোনা করেন। হুমায়ূন আহমেদের বই তো বটেই। তাই এ লেখকের যে বাংলাদেশের এখনো প্রয়োজন, সে উপলব্ধি থেকেই তাঁর এ উদ্যোগ। রাষ্ট্র যদি দুঃসময়ে গুণীজনদের পাশে দাঁড়ায় তা হলে কবি, সাহিত্যিক ও শিল্পীদের আর্থিক ও মানসিক মর্যাদা বাড়বে বৈকি। এ ধরনের উদ্যোগ সর্বত্র প্রশংসনীয়।
লেখক : বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান, বিশিষ্ট পরমাণু চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা।

No comments

Powered by Blogger.