স্কুলে লেখাপড়া-বিদ্যাদায়গ্রস্ত অভিভাবক বনাম কর্তৃপক্ষ by তাহসিনা আখতার
সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের নামটি দেখেই চোখ আটকে যায়। আমার মতো যাঁরা এখান থেকে পড়াশোনা করেছেন, তাঁদের কাছে এটি অতিপ্রিয় একটি নাম। ১৯৮৮ সালে স্কুলের সঙ্গে শেষ যোগাযোগ, এখন ২০১১। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং এক মেয়ের মা।
কিছুদিন বিলেতে ছিলাম। সেই সুবাদে আমার মেয়েও কিছুদিন ব্রিটেনে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছে। সম্প্রতি দেশে ফিরে মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করাতে গিয়ে কিছু অভিজ্ঞতা হলো। মনে হলো, ১৯৮৮ সালের ভিকারুননিসা আর আজকের ভিকারুননিসার মধ্যে অনেক তফাত। এখন লটারি করে ছাত্রীদের ভর্তি করানো হয়। মেয়েকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াব বলে সে রকম একটি স্কুলের খোঁজই নিচ্ছিলাম। দেশের তথাকথিত প্রথম ১০টি স্কুলের প্রধান শিক্ষক/শিক্ষিকার সঙ্গে একজন অভিভাবক হিসেবে দেখা করতে পারিনি। শুনেছি, যোগাযোগ বা ওপরের হাত থাকলে তদবির করে বাচ্চা ভর্তি করানো যায়। যথেষ্ট পরিমাণের উঁচু লেভেলের লোক থাকা সত্ত্বেও আমি সাধারণ অভিভাবক হয়েই দুটি স্কুলে দরখাস্ত জমা দিই।
একটি স্কুল থেকে বের হওয়ার পর মনে পড়ে, আমি দরখাস্তে প্রিন্সিপাল বানানটাই ভুল করেছি। আমি জানি না, কেন এত বিচলিত ও ভীত ছিলাম। তবে আমার জীবনে আমি কখনোই ভিখারি ছাড়া এমন পরিস্থিতিতে কাউকে পড়তে দেখিনি। স্কুলের গেট থেকেই চিরকুটে ফোন নম্বর ধরিয়ে দিয়ে বিদায় হতে হয় এসব স্কুল থেকে। উন্নত বিশ্বের তিনটি স্কুলে আমি আমার মেয়েকে সৌভাগ্যক্রমে পড়িয়েছি। সেখানে শিক্ষা নিয়ে এ রকম হয়রানি একজন বিদেশি নাগরিক হয়েও আমাকে পোহাতে হয়নি। প্রতিটি স্কুলের মান, পাঠ্যক্রম মোটামুটি একই। বাড়ির সবচেয়ে কাছের স্কুলে যেতে হয়েছে। আসন খালি থাকলে পরদিনই ক্লাস, না থাকলে নিকটবর্তী পরের স্কুলে যেতে হবে। সবচেয়ে আগে যে হাসিমুখটি দেখা গেছে তা হলো, স্কুলটির হেড টিচারের। বিলেতের সেই স্কুলগুলো নিয়মশৃঙ্খলা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং উপস্থিতির ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর। উপযুক্ত কারণ ছাড়া বাচ্চা স্কুলে অনুপস্থিত থাকতে পারে না। অন্যথায় বিশেষ সংস্থায় সেই ছাত্র/ছাত্রীটির বিস্তারিত বিবরণ চলে যায় এবং প্রয়োজনে আইনি ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। মোটকথা, একটি শিশু সাবালক না হওয়া পর্যন্ত স্কুল তার জন্য আনন্দদায়ক, আধুনিক এবং নিরাপদ একটি স্থান।
আমি নিজেও লন্ডনের একটি মাধ্যমিক স্কুলে এবং একটি কমিউনিটি স্কুলে এক বছর পড়িয়েছি। সেখানে দেখেছি কীভাবে শিশুদের প্রতিটি বিষয়ের পাঠ্যক্রম ছাড়াও স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা, প্রাথমিক চিকিৎসা প্রভৃতি সম্পর্কে জানতে হয়। বিলেতের এই শিক্ষাব্যবস্থায় কোনো ত্রুটি নেই, তা বলব না। তবে অভিজ্ঞতায় বুঝি, বিলেতের এই শিক্ষাব্যবস্থা অনেক বেশি কাম্য এবং স্বাভাবিক। আমাদের দেশে শিক্ষাব্যবস্থা যেভাবে চলছে তা অত্যন্ত অস্বাভাবিক এবং গোটা জাতির জন্য অস্বাস্থ্যকর। এর মধ্যেও বিলেতে শিশু যৌন বিকৃতি বা নির্যাতনের ঘটনা যে ঘটেনি, তা নয়। তবে সেই দেশের সরকার এবং গণমাধ্যম কঠোর হাতে সেসব বিকৃতমনা শিক্ষক/শিক্ষিকাকে আপসহীনভাবে শায়েস্তা করেছে। এখনো স্কুলগুলোতে বিভিন্ন রকম সংস্কারকাজ চলছে। কিন্তু আজকে আমাদের এই দেশ ও জাতি যে অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছি, তাতে বোঝা যায় না কে বেশি ক্ষমতাধর—একটি স্কুলের প্রধান, না দেশের প্রধানমন্ত্রী!
কত ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা আজ দেশে প্রচলিত? কমপক্ষে ১৩ রকম। একটি শিশুকে শুরুতেই বিভাজনের দিকে ঠেলে দেওয়া। বাংলা, ইংরেজি, বাংলার ইংরেজি ভার্সন, মাদ্রাসাশিক্ষা, কিন্ডারগার্টেন শিক্ষা, উঁচুমানের শিক্ষা, কোচিং শিক্ষা, প্রাইভেট পড়া, এনজিও শিক্ষা, কমিউনিটি বিদ্যালয় শিক্ষা—আরও কত কী? সত্যিই স্বাধীন এই দেশ! স্বাধীনতার অপূর্ব অপব্যবহার, অপূর্ব আমাদের শিক্ষানীতি! আগে জানতাম, রাজনীতিতেই শুধু দুর্নীতি, এখন দেখছি কোথায় নেই দুর্নীতি। বিদ্যালয়ের মতো পবিত্র স্থান যেখানে মায়ের মমতার পরই শিশুর বেড়ে ওঠার সিঁড়ি, সেখানেও চলছে অনৈতিক বাণিজ্য।
এই পরিমল ধরের ঘটনায় এখন বুঝতে পারি, এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতেই হয়তো স্কুলটিতে পুরুষ শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হতো না। এটি পুরুষদের হেয় করার জন্য নয়। বরং কিছু পুরুষ যাতে তাদের লুকানো বিকৃত আকাঙ্ক্ষা উঠতি বয়সের মেয়েদের ওপর প্রয়োগ করতে না পারে, এসব তারই কর্মপরিকল্পনার অংশ ছিল।
পাশাপাশি আরও কিছু বিষয় আমাদের প্রিয় অভিভাবকদের না বললেই নয়। কিছু ছেলেমেয়ে বাইরে চলাফেরা করে, এমনকি কোচিং সেন্টার বা শিক্ষকের কাছে পড়তে যায় এমন সব পোশাক পরে, যা আমার সংস্কৃতির সঙ্গে বেমানান। শালীন বা মার্জিত পোশাক মানে এই নয় যে সবাই বোরকা বা হিজাব পরবে বা ছেলেরা লম্বা প্যান্টেই থাকবে। একটা বয়সের পর অভিভাবকদের তাঁর সন্তানদের পোশাকের দিকে নজর দেওয়া উচিত।
একজন পরিমল ধর চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ব্যর্থতা। পরিমলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ছাত্রীদের কেন আন্দোলন করতে হলো? এই প্রশ্নটিও ভাবিয়ে তোলে। মেয়েদের স্কুলে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার আগে তাঁর অতীত কেন খুঁজে দেখা হয়নি, এটি আরেকটি প্রশ্ন। আবার অভিজাত স্কুলে পড়ার পরও কোচিং করতে কেন শিক্ষার্থীকে শিক্ষকের কাছে যেতে হয়, সেটি বিস্ময়কর প্রশ্ন। এই চিত্র প্রায় সব স্কুলে। তার মানে দাঁড়ায়, শ্রেণীকক্ষের লেখাপড়া চলে গেছে কোচিং সেন্টারে, প্রাইভেট টিউটরের কাছে। তাহলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ভবিষ্যৎ কী? এটা ভাবতে গেলে তালগোল পাকিয়ে যায়, নিজেকে বড়ই অসহায় মনে হয়।
তাহসিনা আখতার, শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
moni_maliha@yahoo.com
একটি স্কুল থেকে বের হওয়ার পর মনে পড়ে, আমি দরখাস্তে প্রিন্সিপাল বানানটাই ভুল করেছি। আমি জানি না, কেন এত বিচলিত ও ভীত ছিলাম। তবে আমার জীবনে আমি কখনোই ভিখারি ছাড়া এমন পরিস্থিতিতে কাউকে পড়তে দেখিনি। স্কুলের গেট থেকেই চিরকুটে ফোন নম্বর ধরিয়ে দিয়ে বিদায় হতে হয় এসব স্কুল থেকে। উন্নত বিশ্বের তিনটি স্কুলে আমি আমার মেয়েকে সৌভাগ্যক্রমে পড়িয়েছি। সেখানে শিক্ষা নিয়ে এ রকম হয়রানি একজন বিদেশি নাগরিক হয়েও আমাকে পোহাতে হয়নি। প্রতিটি স্কুলের মান, পাঠ্যক্রম মোটামুটি একই। বাড়ির সবচেয়ে কাছের স্কুলে যেতে হয়েছে। আসন খালি থাকলে পরদিনই ক্লাস, না থাকলে নিকটবর্তী পরের স্কুলে যেতে হবে। সবচেয়ে আগে যে হাসিমুখটি দেখা গেছে তা হলো, স্কুলটির হেড টিচারের। বিলেতের সেই স্কুলগুলো নিয়মশৃঙ্খলা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং উপস্থিতির ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর। উপযুক্ত কারণ ছাড়া বাচ্চা স্কুলে অনুপস্থিত থাকতে পারে না। অন্যথায় বিশেষ সংস্থায় সেই ছাত্র/ছাত্রীটির বিস্তারিত বিবরণ চলে যায় এবং প্রয়োজনে আইনি ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। মোটকথা, একটি শিশু সাবালক না হওয়া পর্যন্ত স্কুল তার জন্য আনন্দদায়ক, আধুনিক এবং নিরাপদ একটি স্থান।
আমি নিজেও লন্ডনের একটি মাধ্যমিক স্কুলে এবং একটি কমিউনিটি স্কুলে এক বছর পড়িয়েছি। সেখানে দেখেছি কীভাবে শিশুদের প্রতিটি বিষয়ের পাঠ্যক্রম ছাড়াও স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা, প্রাথমিক চিকিৎসা প্রভৃতি সম্পর্কে জানতে হয়। বিলেতের এই শিক্ষাব্যবস্থায় কোনো ত্রুটি নেই, তা বলব না। তবে অভিজ্ঞতায় বুঝি, বিলেতের এই শিক্ষাব্যবস্থা অনেক বেশি কাম্য এবং স্বাভাবিক। আমাদের দেশে শিক্ষাব্যবস্থা যেভাবে চলছে তা অত্যন্ত অস্বাভাবিক এবং গোটা জাতির জন্য অস্বাস্থ্যকর। এর মধ্যেও বিলেতে শিশু যৌন বিকৃতি বা নির্যাতনের ঘটনা যে ঘটেনি, তা নয়। তবে সেই দেশের সরকার এবং গণমাধ্যম কঠোর হাতে সেসব বিকৃতমনা শিক্ষক/শিক্ষিকাকে আপসহীনভাবে শায়েস্তা করেছে। এখনো স্কুলগুলোতে বিভিন্ন রকম সংস্কারকাজ চলছে। কিন্তু আজকে আমাদের এই দেশ ও জাতি যে অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছি, তাতে বোঝা যায় না কে বেশি ক্ষমতাধর—একটি স্কুলের প্রধান, না দেশের প্রধানমন্ত্রী!
কত ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা আজ দেশে প্রচলিত? কমপক্ষে ১৩ রকম। একটি শিশুকে শুরুতেই বিভাজনের দিকে ঠেলে দেওয়া। বাংলা, ইংরেজি, বাংলার ইংরেজি ভার্সন, মাদ্রাসাশিক্ষা, কিন্ডারগার্টেন শিক্ষা, উঁচুমানের শিক্ষা, কোচিং শিক্ষা, প্রাইভেট পড়া, এনজিও শিক্ষা, কমিউনিটি বিদ্যালয় শিক্ষা—আরও কত কী? সত্যিই স্বাধীন এই দেশ! স্বাধীনতার অপূর্ব অপব্যবহার, অপূর্ব আমাদের শিক্ষানীতি! আগে জানতাম, রাজনীতিতেই শুধু দুর্নীতি, এখন দেখছি কোথায় নেই দুর্নীতি। বিদ্যালয়ের মতো পবিত্র স্থান যেখানে মায়ের মমতার পরই শিশুর বেড়ে ওঠার সিঁড়ি, সেখানেও চলছে অনৈতিক বাণিজ্য।
এই পরিমল ধরের ঘটনায় এখন বুঝতে পারি, এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতেই হয়তো স্কুলটিতে পুরুষ শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হতো না। এটি পুরুষদের হেয় করার জন্য নয়। বরং কিছু পুরুষ যাতে তাদের লুকানো বিকৃত আকাঙ্ক্ষা উঠতি বয়সের মেয়েদের ওপর প্রয়োগ করতে না পারে, এসব তারই কর্মপরিকল্পনার অংশ ছিল।
পাশাপাশি আরও কিছু বিষয় আমাদের প্রিয় অভিভাবকদের না বললেই নয়। কিছু ছেলেমেয়ে বাইরে চলাফেরা করে, এমনকি কোচিং সেন্টার বা শিক্ষকের কাছে পড়তে যায় এমন সব পোশাক পরে, যা আমার সংস্কৃতির সঙ্গে বেমানান। শালীন বা মার্জিত পোশাক মানে এই নয় যে সবাই বোরকা বা হিজাব পরবে বা ছেলেরা লম্বা প্যান্টেই থাকবে। একটা বয়সের পর অভিভাবকদের তাঁর সন্তানদের পোশাকের দিকে নজর দেওয়া উচিত।
একজন পরিমল ধর চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ব্যর্থতা। পরিমলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ছাত্রীদের কেন আন্দোলন করতে হলো? এই প্রশ্নটিও ভাবিয়ে তোলে। মেয়েদের স্কুলে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার আগে তাঁর অতীত কেন খুঁজে দেখা হয়নি, এটি আরেকটি প্রশ্ন। আবার অভিজাত স্কুলে পড়ার পরও কোচিং করতে কেন শিক্ষার্থীকে শিক্ষকের কাছে যেতে হয়, সেটি বিস্ময়কর প্রশ্ন। এই চিত্র প্রায় সব স্কুলে। তার মানে দাঁড়ায়, শ্রেণীকক্ষের লেখাপড়া চলে গেছে কোচিং সেন্টারে, প্রাইভেট টিউটরের কাছে। তাহলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ভবিষ্যৎ কী? এটা ভাবতে গেলে তালগোল পাকিয়ে যায়, নিজেকে বড়ই অসহায় মনে হয়।
তাহসিনা আখতার, শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
moni_maliha@yahoo.com
No comments