বিশেষ সাক্ষাৎকার-আশা করি সরকারের অবস্থান বদলাবে by মাহবুবুর রহমান
সম্প্রতি জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন ঢাকায় জলবায়ু সম্মেলনে যোগ দিতে এসে নির্বাচনের বিষয়ে সরকার ও বিরোধীদের মধ্যে দূরত্ব কমানোর লক্ষ্যে সংলাপের আহ্বান জানান। এ বিষয়েআওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ওবায়দুল কাদের এবং বিএনপির স্থায়ীকমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমানের অভিমত তুলে ধরা হলো।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান ও মশিউলআলম প্রথম আলো জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন সম্প্রতি ঢাকা সফরে এসে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎকালে বলেন, সংলাপে বসতে হবে। দেশের মানুষও মনে করে, সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সংলাপ হওয়া প্রয়োজন। আপনি কী বলেন?
মাহবুবুর রহমান জাতিসংঘের মহাসচির বান কি মুনের সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফর বেশ ভালো হয়েছে। এর আগে ২০০৮ সালে যখন তিনি এ দেশ সফরে এসেছিলেন, তখন আমাদের রাজনীতিতে বেশ সংকটময় সময় কাটছিল। এবারও তাঁর সফরকালে বাংলাদেশ রাজনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে; এখনকার সংকট বোধকরি আগের চেয়ে অনেক গভীর। অবশ্য জাতিসংঘের মহাসচিবের বাংলাদেশ সফরের সঙ্গে এ রাজনৈতিক সংকটের কোনো সম্পর্ক নেই; তিনি এসেছিলেন জলবায়ু বিপন্ন দেশগুলোর জোটের এক বৈঠকে যোগ দিতে। বৈঠকের বাইরে বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গেও তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছে, তাঁদের মধ্যে রাজনৈতিক বিষয়ে কথাবার্তা হয়েছে। বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে নিজের ও দলের উদ্বেগের কথা জাতিসংঘের মহাসচিবকে জানিয়েছেন।
প্রথম আলো কী উদ্বেগ?
মাহবুবুর রহমান উদ্বেগ হচ্ছে, সামনের নির্বাচন কীভাবে অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন অবশ্যই হতে হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ। এ জন্য আমাদের একটা ব্যবস্থা ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় এর আগে তিন তিনটি নির্বাচন হয়েছে; নির্বাচনগুলো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে; কখনো আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছে, কখনো বিএনপি বিজয়ী হয়েছে এবং প্রতিটি সরকারই নিজেদের মেয়াদ শেষ করে আবার নির্বাচনে গেছে। এখন আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নেই। বর্তমান সরকার একতরফাভাবে সংবিধান সংশোধন করে ব্যবস্থাটি বাতিল করেছে। তাই আমাদের উদ্বেগ হচ্ছে, সামনে কীভাবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
প্রথম আলো সে জন্য উভয়পক্ষের মধ্যে আলাপ-আলোচনা প্রয়োজন।
মাহবুবুর রহমান দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি অসুস্থ হয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কেউ কাউকে সহ্য করতে পারে না। হিংসা, বিদ্বেষ, সংঘাতের রাজনীতি চলছে। কিন্তু এভাবে তো গণতন্ত্র হয় না। গণতন্ত্রের জন্য দরকার পরমতসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের প্রবণতা। সবচেয়ে বড় কথা, দেশ ও জনগণের স্বার্থে ন্যূনতম কতকগুলো বিষয়ে সব রাজনৈতিক দলকে একমত হতে হয়। এটা আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনুপস্থিত। আজ ৪০ বছরেও এ ঐতিহ্য গড়ে ওঠেনি। এসব সমস্যা থেকে উত্তরণের একটা বিকল্প উপায় হিসেবেই কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার প্রবর্তন ঘটেছিল, যদিও বিএনপি সেই সময় এ বিষয়ে প্রথমে রাজি ছিল না। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় আমরা দেখতে পাচ্ছি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ছাড়া অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আর কোনো পন্থা নেই। সে জন্যই বিএনপি একটি অবস্থান নিয়েছে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন না হলে সে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। এই অবস্থানে দাঁড়িয়ে আমাদের দল একটা আন্দোলনের দিকে এগোচ্ছে। অন্যান্য সমমনা দলও এ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হচ্ছে।
প্রথম আলো তাহলে বিএনপি শুধু আন্দোলনই করে যাবে? সংলাপে বসবে না?
মাহবুবুর রহমান না, তা নয়। জাতিসংঘের মহাসচিব যেমন বলেছেন, সংলাপের মাধ্যমে একটা সমাধান বের করতে হবে। আমিও তাই মনে করি, আমার দল বিএনপিও তাই মনে করে। গণতন্ত্রের কথাই তো হলো আলাপ-আলোচনা থাকতে হবে, দ্বার রুদ্ধ করার অবকাশ নেই। বিএনপি অবশ্যই এ বিষয়ে আলোচনায় বসতে চায়। কিন্তু আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যদি বলা হয় যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয়ে গেছে, এ নিয়ে আর আলোচনা করার সুযোগ নেই, তাহলে কীভাবে সংলাপ হতে পারে? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নেই, দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে—এটাই চূড়ান্ত, এ বিষয়ে আর কোনো আলোচনার সুযোগ নেই। আমি মনে করি, এটা গণতান্ত্রিক মানসিকতার পরিচয় নয়। বরং এতে বিস্মিত হতে হয়, কারণ আলোচনার সূত্রপাত ঘটানোর উদ্যোগ যেখানে সরকারেরই নেওয়া উচিত, সেখানে সরকারপ্রধান বলছেন, আলোচনার কোনো সুযোগ নেই।
প্রথম আলো আগামী বছরের এপ্রিলে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। সরকারের সঙ্গে আপনাদের যদি কোনো রকমের যোগাযোগ না থাকে, তাহলে সরকার একাই কমিশনারদের নিয়োগ দেবে। আপনারা কি তা মেনে নেবেন?
মাহবুবুর রহমান আমরা আশা করব, সামনে যাদের নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ দেওয়া হবে, তাঁরা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবেন, সব প্রশ্নের ঊর্ধ্বে থাকবেন। সরকার একাই নিয়োগ দিলে সেটা হবে না; সে জন্য সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে হবে। প্রধান বিরোধী দল হিসেবে বিএনপির মতামত তো অবশ্যই নিতে হবে। বিএনপির কাছে গ্রহণযোগ্য না হলে নির্বাচন কমিশনের সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে, কারণ বিএনপি নির্বাচনে সবচেয়ে বড় দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দলের একটি। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচন কমিশন গঠন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়, প্রধান বিরোধী দলের মতামত ছাড়া নির্বাচন কমিশনে নতুন নিয়োগ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে না, এবং এতে করে রাজনৈতিক সমস্যা আরও ঘনীভূত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাবে।
প্রথম আলো কিন্তু আপনারা যদি এই অবস্থানেই অটল থাকেন যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ছাড়া আপনারা নির্বাচনে কোনোভাবেই অংশ নেবেন না, এটাই আপনাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত, তাহলে নির্বাচন কমিশনে নতুন নিয়োগ বা অন্যান্য বিষয়ে আর আলোচনার কী থাকে?
মাহবুবুর রহমান না, আমি এ রকম মনে করি না। আমি মনে করি, আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে গণতান্ত্রিক সংকট থেকে উত্তরণ, সুষ্ঠু নির্বাচন, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া। এটাই যদি লক্ষ্য হয়, এবং আমরা যদি এই লক্ষ্যের প্রতি আন্তরিক হই, ঐকান্তিক হই, একনিষ্ঠ হই, তাহলে একটা সমাধান বেরিয়ে আসবেই। তবে আমাদের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি চলছে, সেখানে আপনার এই প্রশ্নের জবাব পাওয়া যাবে না।
প্রথম আলো ধরা যাক, সরকারি দল অনড় অবস্থান নিল যে অন্তত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে তারা আর কোনো ধরনের আলোচনায় যাবে না। তাহলে আপনারা কি এমন চেষ্টা করবেন না, যাতে সরকার আলোচনায় বসতে বাধ্য হয়? এদিকে আপনারা যাবেন, নাকি একদম সরকারের পতন ঘটানোর আন্দোলন চালাবেন?
মাহবুবুর রহমান না, না। পতন কথাটা নেতিবাচক, ধ্বংসাত্মক। এটি কোনো ভালো কথা নয়। আমরা ইতিবাচকভাবে চিন্তা করি, আমরা গঠনমূলকভাবে এগোতে চাচ্ছি। আমরা চাচ্ছি, রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের জন্য নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা, স্বাধীন নির্বাচন কমিশন। আমরা কিন্তু ইতিমধ্যে আন্দোলনে আছি...
প্রথম আলো সে আন্দোলন তো আলোচনায় বসার দাবিতে আন্দোলন নয়, আপনারা তো বলছেন এখনই সরকারকে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে নির্বাচন দিতে হবে।
মাহবুবুর রহমান আমি মনে করি, সরকার চোখ-কান বন্ধ করে নেই, সরকার উটপাখি নয়, সরকারের উটপাখির মতো হওয়া উচিত নয়। আমি আশা করছি, আমাদের আন্দোলনের যৌক্তিক দাবির পেছনে জনগণের সমর্থন দেখে সরকার চাপটা অনুভব করবে, তার অবস্থান বদলাবে। এটাই তো গণতন্ত্রের কথা, এটাই তো যুক্তির কথা। আন্দোলনের ব্যাপকতার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হবে যে এটা শুধু বিএনপির কথাই নয়, এটা জনগণেরও দাবি। যখন তারা বুঝতে পারবে যে সারা বাংলাদেশে এটা ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, তখন সরকার আলোচনায় বসার প্রয়োজন বোধ করবে। তখন তারা বলবে, আসুন আমরা সংলাপে বসে আলাপ-আলোচনা করে সমাধান বের করি।
আমি মনে করি, এটার জন্যই আমাদের আন্দোলন। আমাদের আন্দোলন জ্বালাও-পোড়াও করে নৈরাজ্য সৃষ্টি করা বা জনজীবন দুর্ভোগ সৃষ্টি করার জন্য নয়। বাংলাদেশে ইতিমধ্যে অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে, অর্থনৈতিক দিক দিয়ে আমরা অনেক পিছিয়ে গেছি। সুতরাং সেসব ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য একটা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে, গঠনমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে, দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি সাধনের চেষ্টা করতে হবে। আমি মনে করি, অবশ্যই সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হবে। সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে বলে আর কোনো উপায় নেই, তা তো নয়। জাতীয় স্বার্থে, দেশকে রাজনৈতিক সংকট থেকে উদ্ধার করতে প্রয়োজনে সংবিধানে আবারও সংশোধনী আনা হবে।
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
মাহবুবুর রহমান ধন্যবাদ।
মাহবুবুর রহমান জাতিসংঘের মহাসচির বান কি মুনের সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফর বেশ ভালো হয়েছে। এর আগে ২০০৮ সালে যখন তিনি এ দেশ সফরে এসেছিলেন, তখন আমাদের রাজনীতিতে বেশ সংকটময় সময় কাটছিল। এবারও তাঁর সফরকালে বাংলাদেশ রাজনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে; এখনকার সংকট বোধকরি আগের চেয়ে অনেক গভীর। অবশ্য জাতিসংঘের মহাসচিবের বাংলাদেশ সফরের সঙ্গে এ রাজনৈতিক সংকটের কোনো সম্পর্ক নেই; তিনি এসেছিলেন জলবায়ু বিপন্ন দেশগুলোর জোটের এক বৈঠকে যোগ দিতে। বৈঠকের বাইরে বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গেও তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছে, তাঁদের মধ্যে রাজনৈতিক বিষয়ে কথাবার্তা হয়েছে। বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে নিজের ও দলের উদ্বেগের কথা জাতিসংঘের মহাসচিবকে জানিয়েছেন।
প্রথম আলো কী উদ্বেগ?
মাহবুবুর রহমান উদ্বেগ হচ্ছে, সামনের নির্বাচন কীভাবে অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন অবশ্যই হতে হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ। এ জন্য আমাদের একটা ব্যবস্থা ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় এর আগে তিন তিনটি নির্বাচন হয়েছে; নির্বাচনগুলো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে; কখনো আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছে, কখনো বিএনপি বিজয়ী হয়েছে এবং প্রতিটি সরকারই নিজেদের মেয়াদ শেষ করে আবার নির্বাচনে গেছে। এখন আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নেই। বর্তমান সরকার একতরফাভাবে সংবিধান সংশোধন করে ব্যবস্থাটি বাতিল করেছে। তাই আমাদের উদ্বেগ হচ্ছে, সামনে কীভাবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
প্রথম আলো সে জন্য উভয়পক্ষের মধ্যে আলাপ-আলোচনা প্রয়োজন।
মাহবুবুর রহমান দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি অসুস্থ হয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কেউ কাউকে সহ্য করতে পারে না। হিংসা, বিদ্বেষ, সংঘাতের রাজনীতি চলছে। কিন্তু এভাবে তো গণতন্ত্র হয় না। গণতন্ত্রের জন্য দরকার পরমতসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের প্রবণতা। সবচেয়ে বড় কথা, দেশ ও জনগণের স্বার্থে ন্যূনতম কতকগুলো বিষয়ে সব রাজনৈতিক দলকে একমত হতে হয়। এটা আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনুপস্থিত। আজ ৪০ বছরেও এ ঐতিহ্য গড়ে ওঠেনি। এসব সমস্যা থেকে উত্তরণের একটা বিকল্প উপায় হিসেবেই কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার প্রবর্তন ঘটেছিল, যদিও বিএনপি সেই সময় এ বিষয়ে প্রথমে রাজি ছিল না। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় আমরা দেখতে পাচ্ছি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ছাড়া অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আর কোনো পন্থা নেই। সে জন্যই বিএনপি একটি অবস্থান নিয়েছে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন না হলে সে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। এই অবস্থানে দাঁড়িয়ে আমাদের দল একটা আন্দোলনের দিকে এগোচ্ছে। অন্যান্য সমমনা দলও এ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হচ্ছে।
প্রথম আলো তাহলে বিএনপি শুধু আন্দোলনই করে যাবে? সংলাপে বসবে না?
মাহবুবুর রহমান না, তা নয়। জাতিসংঘের মহাসচিব যেমন বলেছেন, সংলাপের মাধ্যমে একটা সমাধান বের করতে হবে। আমিও তাই মনে করি, আমার দল বিএনপিও তাই মনে করে। গণতন্ত্রের কথাই তো হলো আলাপ-আলোচনা থাকতে হবে, দ্বার রুদ্ধ করার অবকাশ নেই। বিএনপি অবশ্যই এ বিষয়ে আলোচনায় বসতে চায়। কিন্তু আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যদি বলা হয় যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয়ে গেছে, এ নিয়ে আর আলোচনা করার সুযোগ নেই, তাহলে কীভাবে সংলাপ হতে পারে? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নেই, দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে—এটাই চূড়ান্ত, এ বিষয়ে আর কোনো আলোচনার সুযোগ নেই। আমি মনে করি, এটা গণতান্ত্রিক মানসিকতার পরিচয় নয়। বরং এতে বিস্মিত হতে হয়, কারণ আলোচনার সূত্রপাত ঘটানোর উদ্যোগ যেখানে সরকারেরই নেওয়া উচিত, সেখানে সরকারপ্রধান বলছেন, আলোচনার কোনো সুযোগ নেই।
প্রথম আলো আগামী বছরের এপ্রিলে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। সরকারের সঙ্গে আপনাদের যদি কোনো রকমের যোগাযোগ না থাকে, তাহলে সরকার একাই কমিশনারদের নিয়োগ দেবে। আপনারা কি তা মেনে নেবেন?
মাহবুবুর রহমান আমরা আশা করব, সামনে যাদের নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ দেওয়া হবে, তাঁরা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবেন, সব প্রশ্নের ঊর্ধ্বে থাকবেন। সরকার একাই নিয়োগ দিলে সেটা হবে না; সে জন্য সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে হবে। প্রধান বিরোধী দল হিসেবে বিএনপির মতামত তো অবশ্যই নিতে হবে। বিএনপির কাছে গ্রহণযোগ্য না হলে নির্বাচন কমিশনের সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে, কারণ বিএনপি নির্বাচনে সবচেয়ে বড় দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দলের একটি। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচন কমিশন গঠন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়, প্রধান বিরোধী দলের মতামত ছাড়া নির্বাচন কমিশনে নতুন নিয়োগ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে না, এবং এতে করে রাজনৈতিক সমস্যা আরও ঘনীভূত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাবে।
প্রথম আলো কিন্তু আপনারা যদি এই অবস্থানেই অটল থাকেন যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ছাড়া আপনারা নির্বাচনে কোনোভাবেই অংশ নেবেন না, এটাই আপনাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত, তাহলে নির্বাচন কমিশনে নতুন নিয়োগ বা অন্যান্য বিষয়ে আর আলোচনার কী থাকে?
মাহবুবুর রহমান না, আমি এ রকম মনে করি না। আমি মনে করি, আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে গণতান্ত্রিক সংকট থেকে উত্তরণ, সুষ্ঠু নির্বাচন, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া। এটাই যদি লক্ষ্য হয়, এবং আমরা যদি এই লক্ষ্যের প্রতি আন্তরিক হই, ঐকান্তিক হই, একনিষ্ঠ হই, তাহলে একটা সমাধান বেরিয়ে আসবেই। তবে আমাদের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি চলছে, সেখানে আপনার এই প্রশ্নের জবাব পাওয়া যাবে না।
প্রথম আলো ধরা যাক, সরকারি দল অনড় অবস্থান নিল যে অন্তত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে তারা আর কোনো ধরনের আলোচনায় যাবে না। তাহলে আপনারা কি এমন চেষ্টা করবেন না, যাতে সরকার আলোচনায় বসতে বাধ্য হয়? এদিকে আপনারা যাবেন, নাকি একদম সরকারের পতন ঘটানোর আন্দোলন চালাবেন?
মাহবুবুর রহমান না, না। পতন কথাটা নেতিবাচক, ধ্বংসাত্মক। এটি কোনো ভালো কথা নয়। আমরা ইতিবাচকভাবে চিন্তা করি, আমরা গঠনমূলকভাবে এগোতে চাচ্ছি। আমরা চাচ্ছি, রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের জন্য নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা, স্বাধীন নির্বাচন কমিশন। আমরা কিন্তু ইতিমধ্যে আন্দোলনে আছি...
প্রথম আলো সে আন্দোলন তো আলোচনায় বসার দাবিতে আন্দোলন নয়, আপনারা তো বলছেন এখনই সরকারকে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে নির্বাচন দিতে হবে।
মাহবুবুর রহমান আমি মনে করি, সরকার চোখ-কান বন্ধ করে নেই, সরকার উটপাখি নয়, সরকারের উটপাখির মতো হওয়া উচিত নয়। আমি আশা করছি, আমাদের আন্দোলনের যৌক্তিক দাবির পেছনে জনগণের সমর্থন দেখে সরকার চাপটা অনুভব করবে, তার অবস্থান বদলাবে। এটাই তো গণতন্ত্রের কথা, এটাই তো যুক্তির কথা। আন্দোলনের ব্যাপকতার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হবে যে এটা শুধু বিএনপির কথাই নয়, এটা জনগণেরও দাবি। যখন তারা বুঝতে পারবে যে সারা বাংলাদেশে এটা ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, তখন সরকার আলোচনায় বসার প্রয়োজন বোধ করবে। তখন তারা বলবে, আসুন আমরা সংলাপে বসে আলাপ-আলোচনা করে সমাধান বের করি।
আমি মনে করি, এটার জন্যই আমাদের আন্দোলন। আমাদের আন্দোলন জ্বালাও-পোড়াও করে নৈরাজ্য সৃষ্টি করা বা জনজীবন দুর্ভোগ সৃষ্টি করার জন্য নয়। বাংলাদেশে ইতিমধ্যে অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে, অর্থনৈতিক দিক দিয়ে আমরা অনেক পিছিয়ে গেছি। সুতরাং সেসব ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য একটা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে, গঠনমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে, দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি সাধনের চেষ্টা করতে হবে। আমি মনে করি, অবশ্যই সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হবে। সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে বলে আর কোনো উপায় নেই, তা তো নয়। জাতীয় স্বার্থে, দেশকে রাজনৈতিক সংকট থেকে উদ্ধার করতে প্রয়োজনে সংবিধানে আবারও সংশোধনী আনা হবে।
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
মাহবুবুর রহমান ধন্যবাদ।
No comments