মহানগর-উত্তরা লেকটি কি বাঁচানো যায়? by মো. আসাদউল্লাহ খান

প্রায় তিন দশক ধরে দারুণ অবহেলা ও চরম উপেক্ষার কারণে পাঁচ কিমি দীর্ঘ এবং ২০০ মিটার প্রশস্ত এ অঞ্চলের অধিবাসীদের প্রাত্যহিক জীবন ও সত্তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা উত্তরার এই প্রাকৃতিক লেকটির অস্তিত্ব আজ বিপন্ন। একসময়কার স্বচ্ছ টলমলে পানিতে ভরা লেকটি আজ আবর্জনার ভাঁগাড়ে পরিণত হয়েছে।


দীর্ঘ দুই দশক ধরে লেকের উভয় পাশে অনেক ড্রেনের মাধ্যমে এই অঞ্চলে স্থাপিত ছোট-বড় শিল্পকারখানা, ডায়িং ফ্যাক্টরির রাসায়নিক বর্জ্য এবং বাসাবাড়ির ব্যবহূত পানি এই লেকে নিকাশ করার ফলে লেকে হাঁটুসমান পানি এখন যেটুকু আছে তা বিবর্ণ, দূষিত এবং বিষাক্ত হয়ে পড়েছে। এককথায় বলতে গেলে এই পানি এখন একধরনের টক্সিক স্যুপ। লেকের পানি থেকে অসহনীয় দুর্গন্ধ উঠে চারদিকের বাতাসে ছড়াচ্ছে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে উত্তরা উপশহরে ঢাকা-টঙ্গী রাস্তার পশ্চিম পাশে বসবাসকারী মানুষ এক দুর্বিষহ যন্ত্রণার শিকার।
বিপুল পরিমাণে বর্জ্য এবং পলিথিন লেকের তলদেশে জমা হওয়ার কারণে লেকের তলায় অভেদ্য স্তর তৈরি হওয়ায় ভূগর্ভস্থ স্তরে পানির অনুপ্রবেশ বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর রিচার্জ হচ্ছে না। উল্লেখ করা যেতে পারে যে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর রিচার্জ না হলে ভূপৃষ্ঠস্থ পানির স্তর বাষ্পীভবন প্রক্রিয়ায় শুকিয়ে যেতে থাকবে। অত্যন্ত দুঃখজনক, সরেজমিনে লেকের পানির অবস্থা পরীক্ষা না করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এই বিষাক্ত পানির লেক মাছ চাষের জন্য লিজ দিয়েছে।
দূষণে ভারাক্রান্ত, বর্জ্যে ভরা পূতিগন্ধময় এই লেকের উভয় পাশের অসহনীয় পরিবেশ এই অঞ্চলের বাসিন্দা তথা শিশুদের স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। উত্তরা অঞ্চলে কোনো বিস্তৃত পার্ক কিংবা শিশুদের খেলাধুলা বা চিত্ত বিকাশের জন্য, এমনকি মানুষের নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য একচিলতে খালি জায়গা রাখা হয়নি। উত্তরা নামে ‘মডেল টাউন’ হলেও ঢাকা শহরের মতো এই উপশহরও কংক্রিটের জঙ্গলে পরিণত হচ্ছে।
এমনই একটা পরিস্থিতিতে এ অঞ্চলের বাসিন্দারা একটু নিঃশ্বাস ফেলার জায়গা খুঁজে পেতে চেয়েছিল উত্তরার এই প্রাকৃতিক লেকটি ঘিরে। এ অঞ্চলের এই বিশাল লেকে স্বচ্ছ পানিপ্রবাহ থাকলে, গাছগাছালিতে ভরা লেকের উভয় পাশের উন্মুক্ত জায়গা ফেন্সিং দিয়ে লেকপাড় বাঁধাই করে দেওয়া হলে, বাসাবাড়ির চার দেয়ালের মধ্যে অবরুদ্ধ অবস্থায় টিভির সামনে বেড়ে ওঠা শিশুরা টিভির কিছু অসুস্থ এবং অধিকাংশ সময়ে ক্ষতিকর বিনোদন ছেড়ে এখানে আসতে পারত। স্কুলে কিংবা বাসাবাড়িতে পড়াশোনার পর এখানে এসে খেলাধুলা ও ছুটোছুটির মাধ্যমে তাদের চিত্তবিকাশ ঘটত। একটি কলুষমুক্ত পরিবেশে মুক্তমন নিয়ে তারা বেড়ে উঠত। আজ উত্তরাসহ এই বিশাল ঢাকা শহরের প্রতিটি অঞ্চলে এ ধরনের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে আমরা আগামী প্রজন্মের জন্য মুক্তিসনদ রচনা করতে পারি। অর্থাৎ এ ধরনের সুস্থ ও কলুষমুক্ত পরিবেশে গড়ে ওঠা শিশু আগামী দিনে অসুস্থ মানসিকতা এবং জিঘাংসাবৃত্তি নিয়ে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করবে না।
আমরা জানি, নাগরিক জীবনে নানা অভিঘাতে বিপর্যস্ত মানুষ প্রাণের উৎস, স্বস্তি এবং জীবনের নির্যাস নেওয়ার জন্য সুযোগ পেলেই নদনদী, লেক, পাহাড়-পর্বত এবং সাগরের পাড়ে ছুটে গিয়েছে। নিউইয়র্ক শহরের হাডসন নদী, শিকাগো শহরে লেক মিশিগান, লন্ডন শহরে টেমস নদী, কানাডার টরন্টো শহরের লেক অন্টারিও এবং টরন্টো শহর থেকে শত কিলোমিটার দূরে নায়াগ্রা লেক আকর্ষণীয় পর্যটন ও বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি ও খ্যাতি লাভ করেছে। বাড়ির কাছে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে উটি লেক, উত্তরাঞ্চলে নৈনিতাল লেক হাজারো ভ্রমণলিপ্সু মানুষকে আকর্ষণ করছে। ভারতের উত্তরাঞ্চলের নৈনিতাল লেক এবং বুন্দেলখন্ডের লেক প্লাসিড দেখে অনেকেই মুগ্ধ হয়েছে এবং নিজের দেশে এমন আকর্ষণীয় স্পট গড়ে উঠুক—মনে মনে এই আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেছে। কালের পরিক্রমায় মানুষের অবহেলা এবং উপেক্ষার কারণে পাহাড়ি ধস ও দূষণে আক্রান্ত হয়ে এই লক্ষ্মীতাল লেক এবং লেক প্লাসিড একসময় মৃত জলাশয়ে পরিণত হয়েছিল। সেখানে কিছু সাহসী, উদ্যোগী ও প্রকৃতিপ্রেমী ব্যক্তি এগিয়ে এসেছেন এসব জলাশয়ে প্রাণ সঞ্চার করার জন্য। ২০০২ সালে ওই সব এলাকার জনগণ ও প্রশাসনের মিলিত উদ্যোগে এ দুটি লেক এখন স্বচ্ছ পানিতে ভরে উঠেছে। সৌন্দর্যপিপাসু ও প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ অপার আগ্রহে ছুটে যাচ্ছে ওই সব এলাকায় জীবনের স্বাদ নেওয়ার জন্য। কিন্তু নিজের বাড়ির আঙিনায় এত বড় একটা প্রাকৃতিক সম্পদ, এত বড় একটা গর্ব এবং গৌরবের অবদান রক্ষা করার কোনো প্রয়াস ও উদ্যোগ আমরা নিতে পারছি না।
বিগত দিনে রাজনৈতিক সরকার এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে লেকটি বাঁচানোর জন্য অনেক আবেদন-নিবেদন ও মিডিয়ায় সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করা হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রী বরাবর উত্তরা লেকটি সংস্কার ও সংস্করণের ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য আবেদন জানানোর অব্যবহিত পরই তাঁর পক্ষ থেকে সাড়া পাওয়া যায়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে রাজউক কর্তৃক একটি প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে উত্তরার এই প্রাকৃতিক লেকটিকে পূর্ব গৌরবে ফিরিয়ে আনার প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে মাত্র। এখন পর্যন্ত কাজ যা হয়েছে তা রাজউক এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মধ্যে ফাইলের আদান-প্রদানে সীমিত রয়েছে।
ফাইল চালাচালিতে কিছুটা অগ্রগতি ও সাফল্য অর্জিত হলেও সম্প্রতি একটি অপ্রত্যাশিত এবং অভাবিত ঘটনায় উত্তরাবাসী আশাহত, বিস্মিত ও হতবাক হয়েছে। উল্লেখ্য, ১৯৯০-পরবর্তী সময় প্রভাবশালীদের মদদে স্বৈরাচারী সরকারের আমলে বিধিবহির্ভূতভাবে এবং রাজউকের মূল মাস্টার প্লান লঙ্ঘন করে উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরের ২০ নম্বর রাস্তার পশ্চিম পাশে লেকের কিনারা ঘেঁষে কিছুসংখ্যক প্লট বরাদ্দ করা হয়। বিধিবহির্ভূতভাবে এভাবে লেকের ওপর প্লট বরাদ্দ করা হলে লেকটি একেবারে ভরাট হয়ে যাবে এবং এলাকায় দারুণ পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দেবে।
মো. আসাদউল্লাহ খান: বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক শিক্ষক ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক।
aukhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.