প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রত্যাশিত মান by মো. আসাদুল্লাহ
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার মান নিয়ে শিক্ষাবিদ ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা যখন সংখ্যার চেয়ে শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করার কথা বলছেন, সেখানে সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি সংবাদে বলা হয়েছে, আরো ৯৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আবেদনপত্র জমা পড়েছে, যার মধ্যে ৭৫টি বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে তদন্ত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)।
বর্তমান সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের তিন বছরেরও অধিক সময় পার করেছে। এরই মধ্যে জাতীয় শিক্ষানীতি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস করেছে। সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই হয়তো বেশ কয়টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন পাবে। সেটিও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশে কয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন? এমনিতেই যে ৫৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে, তার মধ্যে গুটিকয়েক বিশ্ববিদ্যালয় মানসম্মত, বাদবাকি নানাবিধ অভিযোগে অভিযুক্ত। ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা, মাত্রাতিরিক্ত টিউশন ফি, আউটার ক্যাম্পাস চালানোসহ সার্টিফিকেট বাণিজ্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সম্পর্কে একটি নেতিবাচক ধারণার জন্ম দিয়েছে। আরো গুরুতর খবর হচ্ছে, অনেকটা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মতো পরিবারের সদস্যদের দিয়ে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হচ্ছে। আমি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধী নই, বরং রাজনীতি ও সেশনজটমুক্ত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য একেকটি মডেল হতে পারে। বলতে দ্বিধা নেই, কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যথেষ্ট সুনামের সঙ্গে পরিচালিত হচ্ছে। সেখানে ইচ্ছা করলেই যে কেউ ভর্তি হতে পারে না। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েই শিক্ষার্থীদের ভর্তি হতে হয়। মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগসহ গবেষণায়ও প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দেয়। এটি নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। কিন্তু গুটিকয়েক মানসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয় দিয়ে তো ৫৫টি বিশ্ববিদ্যালয় বিচার করা অসম্ভব। পাড়ায়-মহল্লায়, জনাকীর্ণ চৌরাস্তার মোড়ে কিংবা সংকীর্ণ গলির সম্মুখে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে শিক্ষার্থী ধরার মহোৎসব কি সমর্থনযোগ্য? এর উদ্দেশ্য কি আদৌ মানসম্মত শিক্ষা প্রদান করা? নাকি যেনতেনভাবে শিক্ষার্থী ভর্তি করে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য হাসিল করা এবং নির্দিষ্ট সময় শেষে একটা সার্টিফিকেট ধরিয়ে দেওয়া? তাই নতুন করে ৭৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবের কথা শুনে মনে কিছু প্রশ্ন জাগে। আমাদের কি সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য আছে, কোন খাতে কী পরিমাণ গ্র্যাজুয়েট দরকার? আমাদের কি বিজ্ঞানের গ্র্যাজুয়েট দরকার আছে? যদি দরকারই হয়, তাহলে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী সংখ্যা আশঙ্কাজনকহারে হ্রাস পাচ্ছে কেন? এ ব্যাপারে আমাদের কোনো জাতীয় দিক নির্দেশনা আছে কি? বর্তমানে চাকরির বাজারে কিছুটা মূল্য আছে বিধায় শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে পছন্দের বিষয় হচ্ছে ব্যবসায় শিক্ষা। এটিই হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে লাভজনক বিষয়। নিকট অতীতে শিক্ষার্থীসহ অভিভাবকদের ব্যবসায় শিক্ষার দিকে একটা বিশেষ আগ্রহ লক্ষ করা যায়। তারা সেদিকেই আগ্রহী হবেন যেদিকে গেলে অন্তত একটা চাকরি পাওয়া যাবে। শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের কি এ ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো দোষ দেওয়া যায়? কিন্তু শুধু ব্যবসায় শিক্ষার জোয়ার দিয়েই কি জাতির সব ধরনের প্রয়োজন মেটানো সম্ভব? আমাদের অর্থনীতির কথা বিবেচনায় নিলে হাজার হাজার বিজনেস স্নাতক ডিগ্রিধারীর কর্মক্ষেত্র কোথায়? আমাদের আমদানিনির্ভর অর্থনীতি কি এই স্নাতকদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে সক্ষম?
আওয়ামী লীগের বিগত আমলে পাঁচ বছরে মাত্র তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। সর্বশেষ ২০০৬ সালে দুটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হয়। সরকারের গত তিন বছরে এখন পর্যন্ত একটিরও অনুমোদন দেওয়া হয়নি, যদিও কয়েকটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, যে বা যারা সনদ-বাণিজ্য করবে তাদের অনুমোদন দেবে না সরকার। ইউজিসির চেয়ারম্যান বলেছেন, ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠবে, এমন কোনো প্রতিষ্ঠান তিনি চান না। উচ্চশিক্ষায় মানের প্রশ্নে তিনি কোনো আপস করবেন না। আমরা সেটার বাস্তবিক প্রতিফলন চাই। ঢাকা শহরে বর্তমানে ৪২টি বেসরকারি এবং সাতটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এ ছাড়া ঢাকায় যানজট, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, সময়ে-অসময়ে তুচ্ছ কারণে ছাত্র অসন্তোষ এবং এর রেশ ধরে সড়ক অবরোধ ও ভাঙচুরের মতো ঘটনা বাড়ছে। এসব কারণে রাজধানীতে আর কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনুমতি না দেওয়ার ব্যাপারে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে। তার মানে ধরেই নেওয়া যায়, নতুন যেসব বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হবে, তা হবে সব ঢাকার বাইরে। এমনিতেই রাজধানীতে অবস্থিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যাপারে নানাবিধ অভিযোগ রয়েছে। হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে অর্থের বিনিময়ে সনদপত্র প্রদানের মতো ঘটনা খোদ রাজধানীতে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটছে (দৈনিক জনকণ্ঠ, জানুয়ারি ২০, ২০১২)। তাহলে ঠাকুরগাঁও বা পঞ্চগড়ে অথবা যশোরে যে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হবে সেটার মান কিভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে? মাননিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে অবশ্যই ইউজিসির প্রসঙ্গ আসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা, প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা এবং বিভিন্ন কার্যক্রম দেখাশোনার জন্য ১৯৭৩ সালে প্রেসিডেন্টের এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে ইউজিসি প্রতিষ্ঠা করা হয়। তখন মাত্র ছয়টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। পরবর্তী সময়ে উচ্চশিক্ষার ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে ১৯৯২ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয় এবং বর্তমানে মোট সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৮৮টি। ইউজিসির দায়িত্ব ও কর্মপরিধি আগের তুলনায় বহুগুণে বৃদ্ধি পাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই ৮৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননিয়ন্ত্রণের বিষয়টিও প্রশ্নবিদ্ধ।
লেখক : শিক্ষক, ঢাকা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (ডুয়েট)
ashadullah.bd@gmail.com
No comments