চারদিক-দিনটি ছিল শুধুই ভাষার

রাত ১২টা বেজে পাঁচ মিনিট। কোনো এক মানসিক হাসপাতালে এক মানসিক রোগীর ঘুম গেল ভেঙে। তার মনে হলো, এক্ষুনি তাকে একটা নাটক করতে হবে। তাকে একটা নাটক পড়তে দেওয়া হলো। সে সাত দিন সাত রাত পড়ল সেই নাটকখানি। তারপর এসে বলল, ‘এখানে অনেকগুলো চরিত্র দেখতে পাচ্ছি। সুন্দর, খুব সুন্দর।


কিন্তু নাটক কোথায়? নাটকের দেখা তো পেলাম না।’ আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক শিশির ভট্টাচার্য্য গল্পচ্ছলে এভাবেই শুরু করেন আলোচনা।
২৪ জানুয়ারি মহান একুশে ফেব্রুয়ারি ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর সি মজুমদার মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ ও ইন্টার কালচারাল ফোরাম যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক যৌথভাবে আয়োজিত ‘বাংলাদেশে ভাষাবিজ্ঞান চর্চা’ বিষয়ক সেমিনার। দিনটি ছিল শুধুই ভাষার। অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের সভাপতিত্বে সেমিনারে পঠিত প্রবন্ধ নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা, পাল্টা সমালোচনা সবই ছিল ভাষাকেন্দ্রিক।
শুরুর গল্পটির সঙ্গে ভাষার একটি চমৎকার সম্পর্ক টানা যায়। আমরা যেমন বায়ুর ভেতর বসবাস করেও টের পাই না তার উপস্থিতি, তেমনি ভাষা নামের বায়বীয় বস্তুটির ভেতরে আমাদের নিরন্তর বাস। অথচ ভাষা কোথায়? আবার পাল্টাভাবে বলতে পারি, কোথায় নেই ভাষা? আমরা যখন কথা বলি তাও ভাষা। আমরা যখন চুপ করে থাকি তাও ভাষা, আবার আমরা যখন দৈহিক-মৌখিক অঙ্গভঙ্গি করি তাও ভাষা। সব চরিত্রের সংলাপ মিলে যেমন নাটক, তেমনি আমাদের উচ্চারিত ধ্বনি, শব্দ, বাক্য, দৈহিক অঙ্গভঙ্গি—এসবের অর্থ—সবকিছুই ভাষা। আর ভাষায় বিজ্ঞানসম্মত আলোচনার শাস্ত্র হলো ভাষাবিজ্ঞান।
সেমিনারে ভাষা নিয়ে এভাবেই জমে উঠেছিল আলোচনা। সেমিনার শুরুর দিকের শুভেচ্ছা বক্তব্যে বিভাগের প্রধান গুলশান আরা বলেন, ‘বাংলা ভাষা আমাদের গৌরব ও অহংকার যেমন, তেমনি পরিচয় ও অস্তিত্বও। আর পরিচয় ও অস্তিত্বের সঙ্গেই জড়িত ভাষাবিজ্ঞান।’ সেমিনারে পঠিত চারটি প্রবন্ধের মধ্যেই বাংলা ভাষার পরিচয় ও অস্তিত্ব ফুটে উঠেছিল সেদিন। ‘বাংলাদেশে ভাষাবিজ্ঞান চর্চা’বিষয়ক সেমিনারের প্রথম প্রবন্ধটি পাঠ করেন যুক্তরাষ্ট্রের এলিয়েন্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইমেরিটাস অধ্যাপক আনোয়ার এস দিল। তাঁর প্রবন্ধে বারবার অনুরণিত হয় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক আবুল কালাম মনজুর মোর্শেদের কথা। তিনি বলেন, ‘ভাষা যে কেবল ভৌগোলিকভাবেই বৈচিত্র্যপূর্ণ তা নয়, ভাষার সামাজিক রূপগুলো আরও বেশি বৈচিত্র্যময়।’ ইংরেজির প্রভাবে বাংলা ভাষার অবস্থা সম্পর্কে তিনি বেশ রঙ্গ করেই বলেন, ইংলিশ থেকে যেমন ইংরেজি তেমনি বাংলিশ থেকেই হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংরেজি। এ যেন বাংলা উপভাষার আরেক নতুন রূপ, ‘মানুষ রেগে গেলেই হরহর গড়গড় করে ইংরেজি বলতে শুরু করে।’ এরূপ মজার মজার উক্তি তাঁর প্রবন্ধটিকে সবার কাছে উপাদেয় করে তুলেছিল।
সেমিনারের দ্বিতীয় প্রবন্ধটি পাঠ করেন ঢাবি ইংরেজি বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী এবং যুক্তরাষ্ট্রের একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আফিয়া দিল। ‘ভাষা মাত্রই অন্যান্য ভাষা হতে শব্দ ঋণ করে। তবে সেটি আমাদের ভাষায় আমরা আমাদের মতো করেই যোগ করে নিই। অর্থাৎ ঋণকৃত শব্দটি আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির মিশেলে উচ্চারিত হয় আমাদের দ্বারা। আরবি ও বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও ঘটেছে তাই।’ বলেন তিনি। অধ্যাপক আনোয়ার এস দিল এবং অধ্যাপক আফিয়া দিল—এ ভাষাবিজ্ঞানী যুগল বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসা থেকেই প্রতিবছর ছুটে আসেন বাংলাদেশে।
সেমিনারে পঠিত তৃতীয় প্রবন্ধটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক মনিরুজ্জামানের। পার্বত্য চট্টগ্রামের বৈচিত্র্যময় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষাবিষয়ক প্রবন্ধটিতে চাকমা তংচঙ্গ্যা, খুশি, লুসাই, ত্রিপুরা প্রভৃতি ভাষার মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে।
‘দেখতে প্রায় এক হলেও তারা কিন্তু মোটেও এক নয়, যেমন এ-কার ()ে, ও-কার ( ো), ঈ-কার ( ী ), ই-কার ( ি)। আবার কাছাকাছি দেখতে হলেও এরাও এক নয়, যেমন ‘ক্ষ’ ও ‘হ্ম’, ‘ত্রু’ ও ‘ক্র’, ‘জ্ঞ’ ও ‘ঞ্ছ’।’ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মহাম্মদ দানীউল হক তাঁর শিশুদের শিক্ষাদানবিষয়ক পঠিত প্রবন্ধে এভাবেই বাংলা ভাষার এক একটি বর্ণকে সম্পর্কিত করেছেন। ‘র্দ্র’, ‘স্ত্র’, ‘স্প্র’ ও ‘স্ক্রু’কে তিনি বেশ মজা করে বলেছেন তিনতলার বর্ণ। আবার কখনো ‘বাক্স’ ও ‘রিক্সা’কে মজা করে বলেছেন ‘বাস্ক’ ও ‘রিস্কা’। ভাষার এই ওলট-পালট আসলেই বেশ মজার মনে হয়েছিল তখন। তবে শিশুদের শিক্ষাদানে এই ওলটপালট যেন না হয়, সেদিকে ছিল তাঁর কড়াদৃষ্টি। ভাষায় দক্ষতা অর্জনে তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন পাঠে আনন্দকে। শিক্ষকের বেত কিংবা মা-বাবার রাঙা চোখকে নয়।
এর পর পরই ছিল সমালোচনার ঝড়। অধ্যাপক মনসুর মূসা, অধ্যাপক আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ, অধ্যাপক জীনাত ইমতিয়াজ আলী, অধ্যাপক শিশির ভট্টাচার্য্যের আলোচনা-সমালোচনার ফাঁকেই কথা হলো বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণীর শিক্ষার্থী আমেনা রিনার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘উচ্চশিক্ষা বলতে শুধু ক্লাসে শিক্ষাদানই বোঝায় না। ক্লাসের বাইরে এ ধরনের সেমিনারের আয়োজন, গবেষণাকর্ম উপস্থাপন শিক্ষার্থীদের জানার বড় সুযোগ।’
সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞানের শিক্ষক সাখাওয়াত আনসারী, সৌরভ শিকদার, সালমা নাসরিন, হাকিম আরিফ, সৈয়দ শাহরিয়ার, মুনীরা বেগম, নাদিয়া নন্দিতা ইসলামসহ বিভাগের শিক্ষার্থীরা। প্রবন্ধ পাঠ, আলোচনা-সমালোচনা, সভাপতির বক্তব্যের পরও সেমিনার ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’।
শান্তা তাওহিদা

No comments

Powered by Blogger.