চারদিক-‘মুক্তিযোদ্ধার মা’
আমার দুই অগ্রজ আশীষ ও অজয় ১৯৬৬ সালের জুলাইয়ে বরিশালের গৈলা গ্রামের দাশের বাড়ির ঘাটে নৌকায় চেপেছিল ২০ কিলোমিটার দূরের এক কলেজে পড়তে যাওয়ার জন্য। মা ও বাবার সঙ্গে আমরা ভাইবোনেরা তাদের বিদায় জানাই। মা শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে হাত নাড়লেন নৌকায় দুই কিশোর সওয়ারির উদ্দেশে।
এর ঠিক পাঁচ বছর পর আমরা তিন ভাই এবং আমাদের বড় ভগ্নিপতি মিহির দাশগুপ্ত মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিই এবং অনেকটা একইভাবে মা-বাবার কাছ থেকে বিদায় নিই। আমরা প্রথমে গেলাম গৌরনদী-কোটালিপাড়া এলাকায় প্রবল দাপটে পাকসেনাদের নাকাল করে চলা হেমায়েত বাহিনীতে। অংশ নিলাম হেমায়েত বাহিনীর সাড়া জাগানো বিভিন্ন অপারেশনে। হেমায়েত বাহিনীতে যখন মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যার তুলনায় অস্ত্রশস্ত্রের অপ্রতুলতা দেখা দিল তখন আশীষদা, অজয়দা ও আমি অন্য বন্ধুদের সঙ্গে চলে গেলাম ভারতে সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য। বাবা-মায়ের সঙ্গে রয়ে গেল আমাদের পাঁচ বোন। এ সময়ও তাঁরা আমাদের বিদায় জানালেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়াটা তাঁদের কাছে ছিল এতটাই প্রত্যাশিত ও স্বাভাবিক যেন আমরা চলেছি কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য। যে পরিবারের তিন সন্তান ও বড় জামাতা মুক্তি বাহিনীতে, তাদের জন্য আশ্রয় পাওয়া সে সময় কতটা কঠিন ছিল, এ প্রজন্মের পক্ষে তা ধারণা করা কঠিন। এক স্থান থেকে আরেক স্থানে, বনজঙ্গলে কিংবা নৌকায় বিলের মধ্যে তাদের দিন-রাত কেটেছে। একসময় মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা তাদের পৌঁছে দিলেন পশ্চিমবঙ্গে। থাকার ব্যবস্থা হলো বারাসতের কাছে দত্তপুকুর নামের একটি বাড়িতে। প্রায় দুই বিঘা জমির একপ্রান্তে সুন্দর একতলা পাকা ভবনটিতে বরিশাল অঞ্চলের মুক্তিবাহিনীর অনেক সদস্য আসতেন নিয়মিত। সন্তানেরা কোথায় কোন অবস্থায় রয়েছে তা জানা নেই। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যেই যেন তাদের খুঁজে পেতেন। ডিসেম্বরে বাঙালির বিজয় অর্জনের পর পশ্চিমবঙ্গে বসবাসরত আমাদের স্বজনদের অনেকেই বলেছিলেন, এখানেই থেকে যাও। বাড়ির মালিক আমাদের জ্যাঠতুতো দাদা জমি-বাড়ি দিয়ে দিতেও আগ্রহ দেখালেন। কিন্তু লাখো মুক্তিযোদ্ধার মতো তাদের সন্তানেরা যে দেশ স্বাধীন করার ক্ষেত্রে জীবন বাজি রেখেছে, নতুন সে দেশে প্রত্যাবর্তনের চেয়ে পরদেশে থেকে যাওয়ার আকর্ষণ কখনোই তাদের কাছে বড় মনে হয়নি। বাবা সত্যরঞ্জন দাশগুপ্ত রাজনীতি করতেন না, কিন্তু গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে যুক্তদের নানাভাবে সহায়তা করতেন। এ কারণে পাকিস্তান আমলে দুইবার তাঁকে কারাযন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে। এ সময় মা আমাদের আট ভাইবোনকে আগলে রেখেছেন, ঠিক সময়ে স্কুলে পাঠিয়েছেন। রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের পাশেও দাঁড়িয়েছেন সাধ্যমতো। একাত্তরে বিজয়ের পর দ্রুততম সময়ে ফিরে এলেন তিনি গৈলার বাড়িতে। ভাইবোনেরা ফিরে গেলাম যার যার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। মুক্তিবাহিনীতে থাকার কারণে পরিবারে কী লাভ হলো সেটা কখনো জানতে চাননি। অথচ পরিবারে তখন নিদারুণ অর্থকষ্ট। টিউশনি করে, পত্রিকা অফিসে চাকরি করে পড়ার খরচ চালাচ্ছি। তা থেকে সামান্য কিছু বাঁচিয়ে বাড়িতে দেওয়া হয়। সে অর্থে টানাটানির সংসারেও মা প্রতিদিন অতিথি আপ্যায়ন করে চলেছেন। গত বছরের এই নভেম্বরে মা যখন আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন, গৌরনদী-আগৈলঝাড়ার মুক্তিযোদ্ধারা দলে দলে এসে আমাদের ভাইবোনদের সান্ত্বনা দিয়েছেন, কেঁদেছেন। তাঁদের সবার এককথা, ‘রেণুকা দাশগুপ্তা ছিলেন সব মুক্তিযোদ্ধার মা’। ওই মুক্তিযোদ্ধাদের কাছেই জেনেছি, একাত্তরে পালিয়ে থাকার কঠিন সময়ও তিনি সাধ্যমতো সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। নিজের ও স্বামীর জন্য রাখা ভাতের থালা মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িয়ে দিয়েছেন। মায়ের হাতে চা খাননি এমন স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মী বা মুক্তিযোদ্ধা খুব কমই ছিলেন। ছেলেরা কেন তাদের জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় পাশে নেই এমন অভিযোগ একবারও কেউ শোনেনি। আমরা ভাইবোনেরা যে যেখানে থাকি, প্রতিবছর শারদীয় দুর্গাপূজায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গৈলায় একত্র হই। এ রেওয়াজ তারাই চালু করেছিলেন। ২০০৩ সালের এপ্রিলে বাবার মৃত্যুশয্যায় তাঁর পাশে ছিলাম আমরা চার প্রজন্মের ৩৪ জন। গ্রামবাসীর জন্য তা ছিল পরম বিস্ময়ের। গত বছর মাকে বিদায় জানালাম আমরা সবাই মিলে। আমাদের জন্য অবাক করা ঘটনা ছিল, বাড়িতে অগণিত নারী-পুরুষের উপস্থিতি। আমাদের অজান্তে তিনি স্থান করেছিলেন সবার মধ্যে। আমাদের জন্য এটাও তো মায়ের বড় উপহার। আজ ১৯ নভেম্বর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের পুনর্মিলন ঘটবে গ্রামের বাড়িতে, যেমন ঘটে প্রতিবছর বাবার স্মরণে। এ পথ তাঁদেরই দেখানো।
অসীম দাশগুপ্ত
অসীম দাশগুপ্ত
No comments